বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৮৪ সালে কৃষিবিদ্যা পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন । হয়তো কবি সে অর্জিত বিদ্যায় বাংলার কৃষককূলের ভাগ্য বদলাতে চেয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যে বাংলাকে গভীর ভাবে ভালোবাসতেন সেটি নতুন করে প্রমাণ করবার দরকার নেই।
কৃষকসমাজ বাংলার প্রাণ। আজও। বাংলার কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হোক-এটি যে কোনও সচেতন বাঙালির মনের একান্ত প্রার্থনা। যাক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবির চোখে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন ইংল্যান্ডের উজ্জ্বল সব দিনরাত্রি ।
তা সত্ত্বেও কবির কাছে এশিয়ার একপ্রান্তে পড়ে-থাকা আলুথালু বাংলার রৌদ্র এবং জোছনা উজ্জ্বল মনে হল বেশি। কবি লিখেছেন-
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় এমন উজল ধারা,
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ, এমন কালো মেঘে
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে।
বাঙালি বলেই কবি বাংলার বর্ষার বিখ্যাত কাজল কালো মেঘের কথাও উল্লেখ করেছেন। বছর তিনেক ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন কবি। English rainy season সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে, ... তথাপি কবির আবেগ উথলে উঠল বাংলার বর্ষার কালো মেঘে ।
যে কবি লিখেছেন-
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে ...
এই অতি কোমল চরণটিতে গ্রামবাংলার জনমানুষের মাটিঘেঁষা ছবিটিই যেন ফুটে উঠেছে, ফুটে উঠেছে বঙ্গীয় জনপদের মানুষের সরল জীবনধারা। ... এই মৃত্তিকালগ্ন জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শন সম্বন্ধেও প্রশ্ন জাগে মনে। সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করি। ১৮৬৩ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে, যে নদীয়া জেলা বাঙালি সাধক শ্রীচৈতন্যদেবের সাধনভূমি। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যদেব গানে গানে ঈশ্বরবাদী প্রেমের জোয়ারে নদীয়াকে প্লাবিত করেছিলেন; ... যে নদীয়ার metaphysical ভাবজগৎ বাউলশ্রেষ্ঠ লালনের মানসভূমি সৃষ্টি করেছিল ।
লালন বাঙালির আধ্যাত্বিক গুরু। যে লালনের গানের বাণী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়া, পাখির ডাকে জেগে ওঠা’ গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে গভীর ভাবে -
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামের হবে অখ্যাতি
নাম শুনেছি পতিত পাবন
তাইতে দেই দোহাই ...
বলেছি কবি বিলেত ছিলেন। কাজেই কবি যখন লেখেন -
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি। ।
তখন ধরে নেওয়া যায় যে- কথাগুলি কেবলি আবেগপ্রসূত নয়, এর বাস্তব ভিত্তি রয়েছে।
‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’,- কবি বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়েই এই উক্তি করেছেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ অবশ্য কখনও বিলেত যাননি। তথাপি তিনি লিখেছেন- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/পৃথিবীর মুখ খুঁজিতে যাই না আর’ (রূপসী বাংলা) ... জীবনানন্দের এই উপলব্দি কি কেবলি আবেগ নির্ভর? অবেগ নির্ভর ঠিকই - তবে সত্য। কেননা, জীবনানন্দের অগ্রজ বিলেত ফেরত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাস্তবতার আলোকে ‘বাংলা কে সকল দেশের রানী’ বলেছেন। অন্যত্র আবার জীবনানন্দ লিখেছেন: ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও / আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব’ (রূপসী বাংলা)
বাংলা যে সকল দেশের রানী-এবং জীবনানন্দ সেটি ঠিক উপলব্দি করেছেন, এবং বাংলা ছেড়ে কোথাও চলে যেতে চাননি।
যে বাংলা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের সুগম্ভীর উচ্চারণ ... তোমাতে (বাংলায়) বিশ্বময়ী ... বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ...
এভাবেই বিশ্বজগতে বাংলার বিশিষ্টতা নিয়ে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ মনিষা অভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
আর নজরুল?
এক্সট্রোভার্ট বলেই নজরুল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উচ্চকিত হয়ে বলেছেন ...
ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি। ।
এই দেশেরই মাটি জলে,
এই দেশেরই ফুলে-ফলে,
তৃষ্ণা মিটাই, মিটাই ক্ষুধা
পিয়ে এরই দুধের বাটি। ।
কাজেই ধরে নেওয়া যায়-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি ...
এই কথাটা কেবলি আবেগপ্রসূত নয়। সত্য।
২
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষে ফিরে এসেছিলেন ১৮৮৬ সালে। তারপর সরকারি চাকরি তে যোগ দিলেন, বিবাহ করলেন। ৩ বছর বিলেত ছিলেন।
কলকাতার গোঁড়া হিন্দু সমাজ কবিতে বলল প্রায়শ্চিত্ত করতে ।
কবি প্রায়শ্চিত্ত করতে অস্বীকার করলেন।
শুরু হল কবিকে একঘরে করার ষড়যন্ত্র। শুরু হল কবিকে অসাধু ভাষায় বাক্যবাণে জর্জরিত করা । কিন্তু, কবিকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
প্রসন্ন রইলেন।
কেন?
কবির প্রাণের গভীরে অদ্ভূত এক কোমলতা ছিল বলেই সংকীর্ণমনারা শত চেষ্টা করেও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কে লাঞ্ছিত করতে পারেনি ... কবির প্রাণের গভীরে অদ্ভূত এক কোমলতা ছিল ... কেননা, কবি লিখেছেন-
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখি, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে।
তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে। ...যে মানুষটির হৃদয় এ রকম একটি নির্মল কোমল চিত্রকল্প ধারণ করতে পারে ... সেই মানুষটিকে সংকীর্ণমনারা কি করে পরাজিত করে?
কবি পাষাণ-হৃদয় হলে ঠিকই ভেঙে পড়তেন।
কবিরা তো পাষাণ-হৃদয় হন না।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মন যেমন ছিল নরম কোমল তেমনি কল্পনাপ্রবণ। লিখেছেন-
ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। এই চরণটি বিস্ময়কর।
স্মৃতি বলতে কি কবি বাংলার হাজার বছরের বিস্ময়কর ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বুঝিয়েছেন? যে ইতিহাসের প্রারম্ভে নিষাদ নামে এক কালোবর্ণ জাতি করতোয়া আর বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে অরণ্য-জঙ্গল পরিস্কার করে একদা গড়ে তুলেছিল পুন্ডুনগর আর চন্দ্রকেতুগড়, যে নগরে মহামতি বুদ্ধ তাঁর জীবনবোধ প্রচার করে বেড়িয়েছিলেন খ্রিস্টের জন্মেরও ৫০০ বছর আগে, যে জীবনবোধ উঁকি দিয়েছিল নবম-দশম শতকের তান্ত্রিক বৌদ্ধ কবির দুরূহ কাব্যভাষায়, ... বুদ্ধের জীবনবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত পাল যুগ কেবল বাংলারই নয়, বিশ্বসভ্যতার গৌরব, ওই সময়েই বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন বাংলার জ্ঞানসাধনার প্রতীক, সেন যুগের শৈব রাজারা বাংলায় অশ্রুতপূর্ব ঐশ্বরিক বিশ্বাসের বীজ প্রোথিত করেছিলেন, ত্রয়োদশ শতকের এলমে তাসাউফপন্থী ওলি-আউলিয়াদের দিল-কাঁপানো জিকির বাংলার গ্রামাঞ্চলে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে সেন আমলের ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যে কোণঠাসা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মনে জ্বেলেছিল আশার আলো-খুলে দিয়েছিল অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের এক নবতর সম্ভাবনার দুয়ার-সেই অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই ষোড়শ শতকের মহৎপ্রাণ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ হয়ে উঠেছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, ... আর ... উনবিংশ শতকের একজন লালন-এর অচিন পাখি পুষবার যন্ত্রণা, কবিতার জন্য একজন রবীন্দ্রনাথের বিনিদ্র রজনী যাপন, ... কুড়ি শতকের নজরুল নামে একজন সৈনিকের বিদ্রোহী হয়ে জ্বলে ওঠার ক্রমিক দৃশ্যপট, একজন আত্মমগ্ন দার্শনিক জীবনানন্দের ‘বোধ’, একজন জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ ...
এমনতরো সুমহান সাংস্কতিক ধারাবাহিকতা বিশ্বে বিরল। এই কথাটিই নজরুল তার একটি গানে বলেছেন -
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হলো নিখিল ভুবন, দিব্য পরিপাটি।
এই দেশেরই ধুলায় পড়ি
মানিক যায়রে গড়াগড়ি
বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙানো
এই দেশেরই জীবন কাঠি। ।
কবিরা ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করেন বটে, তবে কবিরা কখনোই মিথ্যে বলেন না।
নজরুল যে লিখেছেন-
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হলো নিখিল ভুবন, দিব্য পরিপাটি। ।
তা মিথ্যে নয়।
আর স্বপ্ন?
আবহমান বাংলা তো স্বপ্ন দিয়েই তৈরি। নদীবহুল বাংলায় বারবার বানের জলে আমাদের খড়ো ঘরগুলি ভেসে যায় ।
আমরা স্বভূমে হই উদ্বাস্তু । তবুও বাঁচার স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্ন উড়ে যায় বাংলার বিখ্যাত ফাল্গুন সন্ধ্যার অস্থির বাতাসে । যে স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে আমের বনে - বাংলার চৈত্র দিনের মধ্যাহ্নে । তবুও সে অধরা স্বপ্ন শব্দরূপে ঠাঁই করে নেয় রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে ... যে স্বপ্ন তিরতির করে কাঁপে একটি ছিন্নমূল কিশোরীর কাজল কালো চোখের গভীরে ... রোজ সন্ধ্যায় যে স্বপ্ন ফেরি হয় কলকাতার ধর্মতলার সুরেন ব্যানার্জী রোডে কিংবা ঢাকার রমনা পার্কের আলো-আঁধারিতে ...
...এই দুঃখার্ত বিশাল বাংলা তো স্বপ্ন দিয়েই তৈরি।
তা সত্ত্বেও এই স্মৃতিময় স্বপ্নের দেশটিই বিশ্বের সেরা ... সকল দেশের রানী।
ইউরোপ ফেরত বিদগ্ধ শিক্ষিত সজ্জন বাঙালি কবির এই প্রত্যয়।
আমরাও কবির সঙ্গে একমত হই এবং গভীর আবেগ বোধ করি।
যে কবি লিখেছেন-
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ
ও মা তোমার চরণদুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আমলে, অর্থাৎ সেই উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিংশ শতকের প্রারম্ভে বাঙালি সমাজে যৌথ পরিবারের শান্তি সুখ ছিল।
আজ দু- বাংলায় যৌথ পরিবার ভাঙছে। সুখের লাগি পৃথক ঘর পেতে সুখি হওয়া যাচ্ছে না আর। তবে আমাদের কালেও তো স্নেহ ভালোবাসার কমতি নেই। পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য বাবা কি ভাই বিদেশ-বিভূঁয়ে কাটাচ্ছে মানবেতর বন্দি জীবন । মা অনাহার থেকে দু-মুঠো খাবার তুলে দিচ্ছে প্রাণপ্রিয় সন্তানের মুখে।
এই পরম মানবিক দৃশ্যটি কি মিথ্যে?
আমরা জানি মিথ্যে নয়।
তাহলে?
৩
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ
ও মা তোমার চরণদুটি বক্ষে আমার ধরি,
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মৃত্যুকে তুচ্ছ মনে করে কেবলমাত্র মায়ের চরণদুটি বক্ষে ধরে যুদ্ধে গিয়েছিল বাংলার সাহসী ছেলেরা। সেই ভয়াল যুদ্ধের বছরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি ছিল অশেষ প্রেরণার উৎস । যে কারণে স্বাধীনতার পর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ ... গানটি কে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহন করার কথা বিচেনা করা হয়েছিল।
যা হোক।
বাংলাদেশের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এক গুরুতর আশঙ্কার কথা ।
বাংলাদেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহল আজ দেশজ সম্পদ পাচারের জন্য বিদেশি শক্তির মদদে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের তেলগ্যাস সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়ে লাভবান হতে চায়। এই নীতিবর্জিত শ্রেণিটিই স্মৃতি বিজরিত ঐতিহাসিক সোরওয়ার্দী উদ্যানটি গলফকোর্সে পরিনত করতে চেয়েছিল! দেশপ্রেমিক বাঙালির তীব্র প্রতিবাদে তা সম্ভব হয়নি। এই স্বার্থান্বেষী মহলটি ঐতিহাসিক সোরওয়ার্দী উদ্যানটি গলফকোর্সে পরিনত করতে চেয়েছিল ... কারণ এরা নজরুলের মতো বিশ্বাস করে না-
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হলো নিখিল ভুবন, দিব্য পরিপাটি।
এই অসৎ লুটেরা predator শ্রেণির একটি লক্ষ হল নতুন প্রজন্ম কে দেশিও সম্পদ লুঠতরাজের বিষয়ে সম্পূর্নরূপে প্রতিক্রিয়াহীন এবং নির্লিপ্ত রাখা । বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠছে না বলে এটি তারা সহজেই করতে পারছে। দেশপ্রেমের প্রোজ্জ্বল শিখাটি জ্বালিয়ে রাখতে হলে ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার বিকল্প নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় মূল্যবোধের।
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ
ও মা তোমার চরণদুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।
এই তিনটি চরণ মূল্যবোধের উজ্জ্বল নিদর্শন। অথচ, নতুন প্রজন্মের সাহিত্যের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলেই তেলগ্যাস লুন্ঠন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে নির্লিপ্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে। কুড়ি শতকের দেশাত্ববোধক সাহিত্য ও সংগীত ফাঁসীর মঞ্চের দিকে নির্ভীক পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে ভারতবর্ষজুড়ে মাস্টারদা সূর্যসেনসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরির্দশনে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তরুণ প্রভাষকের কাছে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র কপি চেয়েছিলেন।
যা হোক। নতুন প্রজন্মকে সাহিত্যমুখি করে তোলার কিছু সমস্যাও আছে। বিদেশি মিডিয়ার অভিঘাতে নতুন প্রজন্মের ক্রমশ রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে। এর ওপর উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনুকরণপ্রিয় অ-বঙ্গীয় অসার জীবনধারা মধ্যবিত্তশ্রেণিতে সংক্রামিত হচ্ছে। এই শ্রেণিটি বিশ্বাস করে না-
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হলো নিখিল ভুবন, দিব্য পরিপাটি।
সব কিছুর ওপর বাংলা ভাষার ওপর বিদেশি ভাষার আগ্রাসন তো আছেই। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার দৌরাত্ম চোখে পড়ে বেশি । একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি আজ বিত্তশালী মারোয়াড়ি সংস্কৃতির দাপটে কোণঠাসা। দু’বাংলাতেই সমৃদ্ধশালী বাংলা সাহিত্য যেন ক্রমেই
কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। অথচ, ইতিহাসচর্চা, সাহিত্যচর্চা ব্যতীত মূল্যবোধ গড়ে ওঠা সম্ভব না।
যে মূল্যবোধ দেশের খনিজ সম্পদ লুঠপাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তরুণ সমাজকে অফুরন্ত প্রেরণা যোগায়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটি তে গভীর দেশপ্রেমতত্ত্ব নিহিত বলে এই সঙ্কটের মুহূর্তে গানটির ভূমিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে অপরিহার্য বলে মনে হয়। গানটিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গভীর স্বদেশ প্রেম ফুটে উঠেছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিশ্বাস করতেন ... এই স্বপ্নময় স্মৃতিময় বাংলাই বিশ্বের সেরা, এর সবুজ সজল প্রকৃতি সুন্দর, বাংলার মানুষ স্নেহপ্রবন এবং সহজসরল, বাংলাই সকল দেশের রানী। বিশ্বসভায় বাংলার মর্যাদা ভিন্নতর ... এবং এই গভীর দেশপ্রেম আমাদের কি এই উপলব্দিতে পৌঁছে দেয় না যে বাংলার যাবতীয় সম্পদের মালিক এ দেশের জনগন-আর কেউ না!
এই কারণেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কালজয়ী গানটির প্রাসঙ্গিকতা আজও স্বাধীন বাংলাদেশে ফুরোয়নি, উপরোন্ত গানটি অনিবার্যভাবে সাম্রাজ্যবাদী আন্দোলনে রাখতে পারে গভীর ভূমিকা ।
নতুন প্রজন্ম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কালজয়ী গানটি হৃদয়ে ধারণ করুক! লড়াই করুক নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! যে লড়াই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আমৃত্যু লুঠেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে করেছেন দেশাত্ববোধক সাহিত্য ও সংগীত রচনার মাধ্যমে । সে জন্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কে অশেষ দুঃখ দুর্দশার শিকার হতে হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার বারবার বদলির আদেশ দেয়। ১৯১২ সালে কবি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন । ততদিনে কবির প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মৃত।
কবি চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করতে বাধ্য হন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১৩ সালের ১৭ মে শনিবার এই মহান দেশপ্রেমিক কবি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
উৎসর্গ: হামিদ মীর। বাঙালির পরম বন্ধু।
তথ্যসূত্র:
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্বন্ধে তথ্য করুণাময় গোস্বামীর লেখা ‘বাংলা গানের বিবর্তন’ বইটি থেকে নিয়েছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।