আমারে দিবো না ভুলিতে
আশির দশকের কথা। আমরা যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন আমাদের একটি বিশেষ বিনোদন ছিল খাওয়াদাওয়া। সেটি চায়নিজ, হাজির বিরিয়ানি বা নীরবের ভাজি-ভর্তা। টিউশনির টাকা, পত্রিকায় লেখার বিল বা বৃত্তির টাকা—অবধারিতভাবে আমাদের গন্তব্য কোনো রেস্টুরেন্ট। হিজ হিজ হুজ হুজ।
এসবের মধ্যে আমাদেরই এক বন্ধু ১০০ টাকা জমলে একটি টেলিফোনের জন্য দরখাস্ত করত। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিটিটিবির (এখনকার বিটিসিএল) ফোনের অনেক চাহিদা। তারপর আমরা পাস করে বের হলাম। আমাদের পকেটে সুন্দর কাগজে জীবনবৃত্তান্ত। আর আমাদের ওই বন্ধুর কাছে বেশ কিছু ডিমান্ড নোট (টেলিফোনের বরাদ্দপত্র), ঢাকার বিভিন্ন স্থানের।
মতিঝিলে তখন টেলিফোন সংযোগ অনেক টাকায় বিক্রি হয়। আমাদের সেই বন্ধুটি তার কয়েকটি ডিমান্ড নোট বিক্রি করে দিল—তাতে তার জোগাড় হয়ে গেল প্রাথমিক মূলধন। আমাদের ওই বন্ধুটি এখন একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান! আমাদের সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল শুরু থেকেই। নিজে কিছু একটা করবে ভেবেছিল, সে জন্য ছাত্রজীবনে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং সম্পূর্ণ নিজের উদ্ভাবনী বুদ্ধিতে ব্যবসার পুঁজি জোগাড় করেছে।
উদ্যোক্তা হতে হলে আসলে এমনটি হতে হয়।
থাকতে হয় সাহস। আমাদের দেশে অনেকের ধারণা, ভালো উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমে কিছুদিন চাকরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়—এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ, চাকরি করলে চাকরির অভিজ্ঞতা হয়, উদ্যোক্তার নয়!
চাই সৃজনশীলতা
নিজেই নিজের স্বপ্নপূরণে নামতে হলে অবশ্যই উদ্যোক্তা হতে হবে। উদ্যোগ দুই রকমের হতে পারে—ব্যবসায়িক আর সামাজিক। এখানে আমরা দ্বিতীয়টি নিয়ে আলাপ করব না।
যেকোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু বা সফল করার জন্য দরকার সৃজনশীলতা, চটজলদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কাজে নেমে পড়া।
ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে সৃজনশীলতার কী সম্পর্ক? সমানুপাতিক। মানে যারা বেশি সৃজনশীল, তাদের বিকাশও বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো নতুন কোনো কিছুর প্রতি মানুষের আগ্রহ। সেটি তথ্যপ্রযুক্তির নতুন কোনো পণ্য হতে পারে আবার হতে পারে নতুন কোনো বিজ্ঞাপনের ধারণা।
প্রচলিত ব্যবসায়ও দারুণভাবে সফল হতে হলে সেখানে সৃজনশীলতা প্রয়োগ করতে হয়। তবে যারা সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে হাজারটা চিন্তা করে, তাদের পক্ষে বেশি দূর যাওয়াটা সম্ভব নয়। বেশি কাজ মানে বেশি ভুলের সুযোগ এবং সবচেয়ে জরুরি হলো, সেটিকে সংশোধনের সুযোগ। কাজেই সত্যিকারের কর্মী মানুষ কখনো বেশি ভাবনা-চিন্তা করে না। কাজ করতে করতে এগিয়ে যায়।
শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের জন্য এ কথাটি বেশি প্রযোজ্য! কাজ করতে হলে প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়তেই হবে। শুরুতে সেটি একটি ল্যাপটপ হতে পারে, একটি ব্রিফকেস হতে পারে, বড় ভাইয়ের অফিসের একটি টেবিল হতে পারে। কিন্তু লাগবে। দ্রুত সেটিকে একটি সাংগঠনিক রূপ দিতে হবে—ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।
খুবই জরুরি ঠিকানা না থাকলে দুটির কোনোটিই হবে না। আবার অনেকে নানা কিছু ভেবে অনেক সম্ভাবনার হিসাব-নিকাশ করতেই থাকে। তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। তবে উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি লাগে সাহস। সাহস করে নেমে পড়তে হবে, তাহলেই হবে।
পুঁজি আর প্রশিক্ষণ
উদ্যোক্তা হতে হলে পুঁজি লাগে, ব্যবসার ধারণা লাগে আর লাগে বিভিন্ন পদ্ধতি বা কাজের ধরন জানা। অনেকের ধারণা, ব্যবসা করতে হলে এত পুঁজি লাগে যে তা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। কোনো উদ্যোক্তা টাকার অভাবে তার উদ্যোগ শুরু করতে পারেননি, এমনটি কিন্তু সত্য নয় (স্বপ্ন নিয়ের ১৬ মার্চ প্রকাশিত দুজন সফল উদ্যোক্তার পুঁজি সংগ্রহের কথা ভাবো)। শুরুর পুঁজি নানা জায়গা থেকে আসতে পারে। এ লেখার শুরুর গল্পটা আবার পড়ো।
অথবা ভাবো আর একজন উদ্যোক্তার কথা যে কিনা তার প্রতিষ্ঠান করার প্রথম পুঁজি তার ৪০ জন বন্ধুর প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে জোগাড় করেছে। কাজেই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব দিয়ে পুঁজি সংগ্রহ হতে পারে। তবে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার আগে হিসাব-নিকাশ ঠিকমতো করতে হবে। এ ছাড়া সরকারেরও নানা উদ্যোগ রয়েছে। যেমন কর্মসংস্থান ব্যাংক।
সেখানে কেবল নিজের আইডিয়া, সাফল্যের সম্ভাবনা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জমা দিয়ে স্বল্পপুঁজি সংগ্রহ করা যায়। রয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা স্বল্প বা মাঝারি উদ্যোগে আর্থিক ঋণ দেয়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের রয়েছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং সেই সঙ্গে আর্থিক সহায়তা।
বিদেশে এ ক্ষেত্রে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি থাকে, যারা কিনা ‘শুরুর দিকের’ (স্টার্টআপ) কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশেও বর্তমানে দুটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি কাজ করছে।
এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তো আছেই। তবে ব্যাংকের ঋণের সঙ্গে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির আর্থিক বিনিয়োগের পার্থক্যটা জেনে নিলে ভালো হয়।
আরেকটি উপায় হলো, প্রথমে পড়াশোনা বা চাকরির পাশাপাশি বাড়তি উপার্জন করা। বর্তমানে মুক্ত পেশায় (ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্স) কাজ করে নিজেদের প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করেছে এমন কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠান দেশেই গড়ে উঠেছে।
যে উদ্যোগই নাও না কেন, মূল কাজের ওপর নিজের বা নিজেদের কর্তৃত্ব থাকতে হবে।
কারণ, ব্যবসার মূল বিষয়গুলো বুঝতে হলে সেখানে নিজের দখল থাকাটা অবশ্যই জরুরি। সে জন্য প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। প্রশিক্ষণ হবে মূল কাজের বা কারিগরি প্রশিক্ষণ। আরেকটি হলো, উদ্যোক্তাবিষয়ক কাজকর্মের প্রশিক্ষণ। ঢাকার উত্তরার ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন চেম্বারের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছাড়াও অনেক প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ
উদ্যোক্তা হতে হলে সবচেয়ে ভালো হতে হয় সামাজিক যোগাযোগে। কারণ, তাতে নেটওয়ার্ক বড় হয়। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা শুরুর দিকের কোম্পানিগুলোর পক্ষে বিপণনের জন্য বিজ্ঞাপনে অর্থ খরচ করা সম্ভব হয় না। প্রথম দিকের কাজগুলো ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে জোগাড় হয়ে থাকে। আজকাল ইন্টারনেটের কারণে খুব অল্প খরচে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়।
তারপর, আমরা যখন নিজেরা একটি নতুন শার্টও কিনতে চাই, তখন পরিচিতজনের কাছেই প্রথম জিজ্ঞাসা করি। কাজে নেমে পড়ার পর প্রথম কাজ হবে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব—সবাইকে তোমার উদ্যোগের কথা জানিয়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে নতুন নতুন সম্পর্ক তৈরি করা। কারণ, সেটি কোনো না কোনোভাবে কাজে আসবে। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ।
সেটিকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
পড়তে হবে, জানতে হবে
সব সফল উদ্যোক্তাকেই প্রচুর পড়তে হয়। শুরুর দিকে ভেঙে না পড়ার জন্য, তারও আগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য। সময় নিয়ে পড়ে ফেল জেসিকা লিভিংস্টোনের ফাউন্ডার অ্যাট ওয়ার্ক: স্টোরিজ অব স্টার্টআপ’স আরলি ডেজ বা রেশমি বশালের স্টে হ্যাংগ্রি, স্টে ফুলিশ। এখনকার যুগের ব্যবসার নানা দিক বোঝার জন্য পড়তে হবে জেফ ডার্ভিসের হোয়াট উড গুগল ডু এবং গিতা পিরামলের বিজনেজ মহারাজসহ যত বই পড়া সম্ভব।
সংবাদপত্র পড়ার সময় অর্থনীতির পাতার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
চাই সাহস
সাহসকে পুঁজি করে নেমে পড়ো রাস্তায়।
কারণ, পথে নামলেই কেবল পথ চিনতে পারবে।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শুভকামনা।
চাই আত্মবিশ্বাস
সৈয়দ রেজওয়ানুল কবির
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন
আপন প্রচেষ্টায় স্বনির্ভর হওয়ার অন্যতম একটি খাত এসএমই।
প্রয়োজন শুধু নিজেকে বদলে দেওয়ার বাসনা এবং পরিশ্রমী মানসিকতা। রাষ্ট্রীয় আয়ের শতকরা ২৫ ভাগ আসছে এসএমই খাত থেকে। এসএমই ফাউন্ডেশন সাধারণত যেসব খাতে উদ্যোগ নিয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, রূপচর্চা কেন্দ্র, কৃত্রিম গয়না ও ফ্যাশন, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, বুটিকশিল্প, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাপিং ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত।
কেউ যদি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমাদের কাছে আসে, আমরা প্রথমেই তাকে নিয়ে আলোচনায় বসি। তার কী কী পরিকল্পনা আছে সেগুলো গুরুত্বসহকারে শুনি।
আমরা ওই খাতের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য সমস্যা—দুটোই তাকে জানাই। এরপরও যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে সে সেটা করবে, আমরা তখন জানতে চাই কোন এলাকায় সে কাজটা করবে। এরপর সেই এলাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর সাথে আমরা পরামর্শ ও আলোচনা করি। উদ্যোগটা তাদের পছন্দ হলে তারা আমাদের জানায়। এভাবে একজন উদ্যোক্তাকে আমরা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই।
এর বাইরে প্রধান যে কাজটা এসএমই ফাউন্ডেশন করে, তা হলো উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কেননা, সফল উদ্যোক্তা হতে হলে প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।