যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণহত্যা নিয়ে পত্র-পত্রিকায়, ব্লগে অনেক লেখা ও আলোচনা হয়েছে এবং আশা করি আরো লেখা হবে যা গণহত্যার সাথে প্রকৃত জড়িতদের খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে; ত্বরান্বিত করবে একাওরের জঘণ্য গণহত্যার বিচারের পথ। আমি একজন আইনের ছাত্র। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যা, মানবসত্বার বিরুদ্ধে অপরাধ- এসব কিছু আমার পড়াশোনার মধ্যেই পড়ে। সঙ্গত কারণেই, পত্রিকায় এবং ব্লগে প্রকাশিত ত্রতদ্ সম্পর্কিত কলামগুলো আমি যথাযথ মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি।
গত ২৫ শে মার্চ শ্রদ্ধেয় কলাম লেখক হাসান ফেরদৌস- এর ”আর্চার ব্লাড: একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি” পড়তে গিয়ে প্রথম লাইনেই থমকে যাই।
শর্মিলা বসু নামে একজন গবেষক (!?) দাবী করেছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে কোন গণহত্যা হয়নি! যে বইটিতে শর্মিলাবসু এই মিথ্যাচার করেছেন সেটির নাম ”ডেড রেকনিং: মেমরিজ অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার” ।
১৯৪৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয় ’জেনোসাইড কনভেনশন’ শীর্ষক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ১৯৪৮ সালের ’সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ ছিল ইচ্ছার অভিব্যক্তি; পক্ষান্তরে, ’জেনোসাইড কনভেনশন’ ছিল করণীয়ের রূপরেখা, অর্থ্যাৎ গণহত্যার অপরাধের মোকাবেলায় রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কর্তব্য নির্ধারণের প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের পর থেকে ১৯৯৩ সালে পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত ’হেগ ট্রাইবুন্যাল’- এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গণহত্যার মতো জঘণ্য মহাপাপ মোকাবেলায় যে দু’টি আলোকপ্রদীপ আমরা দেখতে পাই এর একটি, ষাটের দশকে ভিয়েতনামে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল কর্তৃক গঠিত ”ভিয়েতনামে যুদ্ধাপরাধ বিচারের গণ-আদালত”, যেখানে জাঁ পল সার্এে -সহ সারা বিশ্বের খ্যাতনামা শিল্পী-লেখকম-লী যোগ দিয়েছিলেন এবং অপরটি হলো ১৯৭৩ সালের ১৯ ই জুলাই বাংলাদেশে গৃহীত ”ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুন্যাল) অ্যাক্ট” (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন)। জেনোসাইড কনভেনশনের (১৯৪৮) অনুচ্ছেদ এক(১) থেকে ছয়(৬) বিবেচনায়, গণহত্যার বিচার বর্তায় জাতীয় সরকার এবং সেই সাথে জাতিসংঘের ওপর।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনটি এক উজ্জ্বল নক্ষএ, যা পরবর্তীতে ’জেনোসাইড কনভেনশন’ (১৯৪৮) এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (১৯৯৮) এর মধ্যকার সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
গবেষক (!) শর্মিলা বসুর প্রতি জিজ্ঞাসা রইল, তার বিস্তর ঘাঁটাঘাটি ও তথ্য উদ্ধার অভিযানে আন্তর্জাতিক তাৎপর্যপূর্ণ আইনটি (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন) কি একবারও নজরে পড়েনি? আর যদি নজরে পড়েই থাকে তাহলে আইনটির মূল উদ্দেশ্য (মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠণ, অগ্নিসংযোগ এবং পরিকল্পিত গণহত্যা সমূহের বিচার) যে অপরাধসমূহেরর বিচার করা, সেই অপরাধসমূহ কি এতটাই নির্মমশূণ্য ছিল যে গণহত্যার আওতায় তা আনা যাবে না?
পিনোশে মামলায় (১৯৯৯) লর্ড ব্রাউন-উইলকিনসন মন্তব্য করেছিলেন, ”১৯৪৫ এর পর থেকে ব্যাপক আকারের যে কোন ধরনের নির্যাতনই হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ”
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত করতে বড় বড় লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা কিংবা বিস্তর কাগজপত্র ঘাঁটার দরকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল একাওরের ভয়াবহ অপকর্মসমূহের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে নিভৃতে কেঁদে যাচ্ছে। সেই সব প্রবল সšএস্ত দিন পার করে আসা বাঙালিদের সাথে আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে ১৯৭১ এ নিত্যনৈমিওিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ানো মানবসত্বার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধসমূহ।
একাওরের গণহত্যাকে যারা স্বীকার করে না; যারা সমগ্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে একটা ”অভ্যন্তরীণ গন্ডগোল” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়. তাদের দাবীর বিরুদ্ধে সরব না হওয়াটা হবে মানবসওার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘঠনের একটি পথ সুগম করার সমতুল্য; এবং একই সাথে তা ৩০ লাখ শহীদ বাঙালির আত্মার অপমানের শামিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।