একা ছিলাম না সাথে ছিল কিছু জোনাকি
আমাদের বাড়িতে কখনো আমার সম বয়সী কোন মেয়ে মেহমান হয়ে আসেনি । অন্তত আমার স্মৃতির পাতা উল্টালে এমন কোন ঘটনার কথা আমার মনে পড়েনা । স্কুলে ও কখনো কোন মেয়ে বান্ধবি আমার ছিলনা , সুতরাং দেখতে শিশু বা আন্টি মনে হয় এমন কাউকে ছাড়া আমার সামনে কোন মেয়ে মানেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি । এমনিতে আমি ছেলে হিসেবে খারাপ না , খুব ভাল ছাত্র আমি কখনো ছিলাম না কিন্তু ফলাফল যা বলে তা হল,আমি অন্তত খারাপ ছাত্র না । চেহারা ছিনেমার হিরোদের মত না হলে ও আয়নার সামনে দাড়িয়ে কখনো খারাপ কিছু দেখিনি ।
সুতরাং নিজের সম্পর্কে যদি বলতে বলা হয় তাহলে আমি এক বাক্যে বলব ভাল । তখন সদ্য কলেজ়ে ভর্তি হয়েছি । বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে রেজাল্ট ভাল হওয়া সত্যে ও ঢাকা বা দূরের কোন কলেজে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পড়া হয়নি । স্থানীয় একটি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়া শুনা চালিয়ে যেতে লাগলাম । নতুন কলেজ,সব নতুন মুখ ।
ভীতরে ভীতরে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিলাম । ক্লাশ থাকলে কলেজে যাই ছুটি হলে বাড়ি ফিরে এসে অস্থির সময় কাটাই । এভাবেই আমার দিন চলে যাচ্ছিল । গ্রীষ্মের ছুটি হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি,ক্লাশ তেমন একটা হয়না তবুও সময় কাটানোর জন্য যাওয়া । এক সকালে ক্লাশে যাওয়ার জন্য বাড়িতে থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাড়িয়েছি ।
রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ কি মনে করে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি,চাচাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তার মাথায় একটা ডানা কাটা পরী দাঁড়িয়ে আছে । ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম,ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি । শিউর হওয়ার জন্য আবার তাকালাম । এবার চোখে চোখ পড়ে গেল ।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগালাম চাচাদের বাড়িতে কে এমন আসতে পারে যাকে আমি চিনিনা? ছোট একটা চাচাতো বোন আছে ক্লাশ ফাইভে পড়ে,ও ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই । তাহলে কি এমন কোন আত্মীয় যে কিনা এর আগে এই বাড়িতে আসেনি ! ভাবতে ভাবতে আবার তাকালাম,এবারো ধরা খেয়ে গেলাম;দেখলাম সকালের সোনা রোদ ম্লান করে দিয়ে সারা মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । বুকের ভীতর এবার চার্চের ঘন্টা ধ্বনি বাজতে লাগল । আমার দু’পা নিথর হয়ে গেল । হার্ট এ্যাটাক করতে যাব এমন সময় নিপা এসে আমাকে বাঁচাল ।
নিপা স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে “ভাইয়্যা শুনে যা” বলে আমাকে ডাকল । দুরূ দুরূ বুকে এগিয়ে গেলাম এক খন্ড জলন্ত অগ্নি শিখার দিকে । নিপা আমাকে যা বলল তার মর্মাথ হল মেয়েটি ওদের খালাতো বোন শহরে থাকে,এই প্রথম নিপাদের বাড়িতে বেড়াতে এল এবং দুই দিন পর নিপাকে নিয়ে শহরে ফিরে যাবে । কোন রকমে নামটা জ়ীজ্ঞাসা করলাম । উত্তর এল “তন্দ্রা” ।
তারপর ক্লাশে যাচ্ছি এবং পরে কথা হবে এই বলে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচলাম । সারা পথ তন্দ্রার ভাবনায় মন আচ্ছন্ন হয়ে রইল । বাড়িতে ফিরে এলাম যখন তখন দুপুরের রোদ প্রায় মরে এসেছে । স্নানাহার শেষ করে শুয়ে শুয়ে তন্দ্রার সাথে কথা বলার জন্য সাহস সঞ্ছয়ের চেষ্টা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ভাইয়্যা ভাইয়্যা চিৎকারে তন্দ্রা দেবী পালিয়ে গেল ।
চোখ খুলে দেখি নিপা দাঁড়িয়ে আছে আর ওর ঠিক পিছনে বাস্তবের তন্দ্রা মুচকি মুচকি হাসছে । ফ্রেশ হয়ে ফিরে দেখি মা তন্দ্রা আর নিপাকে নাস্তা দিয়েছে । আমিও হালকা কিছু খেয়ে ওদের নিয়ে হাটতে বের হলাম । অনেক কথা হল,অনেক হাসি আর গল্পে মুখরিত অসম্ভব সুন্দর একটা বিকেল কাটলো । যদিও বেশিরভাগ সময় আমি শ্রোতা আর তন্দ্রা ছিল বক্তা ।
সন্ধায় ওদের দু’জনকে বাসায় দিয়ে এসে আমি পড়তে বসলাম । বইয়ের পাতায় বার বার তন্দ্রার শুভ্র মুখটা ভেসে উঠছিল । সারা রাত নির্ঘুম চোখের পাতায় তন্দ্রা যেন রাজত্ত বিস্তার করেছিল । পরদিন একই জায়গায় একই সময়ে আবার দেখা হল দু’জনের । একটা রাত যেন আমাকে অনেকটা বদলে দিয়েছে ।
এক বুক আকুতি নিয়ে ওর চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা । বিকেলে আবার দেখা হবে এই বলে তন্দ্রা বিদায় নিল আর আমি চলে গেলাম কলেজে । কলেজ থেকে ফিরে এসে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম । তন্দ্রাকে আমি মুখে বলতে পারবোনা তাই যা বলার কলমের ভাষায় বলতে হবে । তন্দ্রাকে যা লিখেছিলাম তা ছিল –
“ঘুম হারা চোখ তন্দ্রা খোঁজে
তন্দ্রা কোথায় কোন সুদূরে,
ক্লান্ত দু’চোখ তাকিয়ে দেখে
তন্দ্রা আমার হৃদয় পুরে ।
তন্দ্রা , সে দিন সকালে তোমাকে হঠাৎ দেখে শুধু ভালই লাগেনি কখন যে নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করে এসেছি তা আমি নিজেও জানিনা । শুধু জানি তোমার নিষ্পাপ মুখের শুভ্র আলোটুকু দু’চোখে নিয়ে বাকি জ়ীবন কাটিয়ে দিতে পারব । ”
বিকেলে যথারীতি আমরা তিনজন হাটতে বের হলাম । নিপার চোখ ফাঁকি দিয়ে চিঠিটা তন্দ্রার হাতে দিয়ে দিলাম । আরো একটি নির্ঘুম রাতের প্রহর ।
নিপাদের ঘরে গিয়ে দেখি তন্দ্রা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের ঘরে আসার জন্য বের হচ্ছে । আমাকে সাথে নিয়ে তন্দ্রা আমাদের ঘরে এল মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য । বিদায় পর্ব শেষ করে সবাই বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । নিপা চাচার সাথে এক রিক্সায় আর তন্দ্রা আমার সাথে । রিক্সায় বসে তন্দ্রা আমার হাতে একটুকরো কাগজ দিয়ে বলল এখানে নয় বাসায় গিয়ে পড়বেন ।
বিদায় বেলায় তন্দ্রার সাথে বেশি কথা বলতে পারিনি । বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরে এসে তন্দ্রার চিঠিটা পড়তে বসলাম । তন্দ্রার উত্তর ছিল – “যে তোমার হৃদয় পুরে আছে তাকে কখনো দূরে যেতে দিওনা । ”তন্দ্রা এখন আর আমার কাছ থেকে বেশি দূরে নয় । এখন হাত বাড়ালেই আমি তার ছোঁয়া পাই ।
আমার ঘুম কেড়ে নেয়া তন্দ্রা ফিরে এসেছে স্বপ্ন হয়ে,ভালবাসার প্রথম শ্রাবণ হয়ে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।