প্রগিশীল, মুক্তমনা, সমঅধিকার এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী
ক্যান্সারে আক্রান্ত আমার স্ত্রী সীমা’র চিকিৎসার জন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত তিনবার মুম্বাইয়ে যাবার সুবাদে বাংলাদেশের যেসব ক্যান্সার রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন তাদের অনেকের সাথেই সেখানে আমাদের দেখা হয়েছে। তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওখানে চিকিৎসা করতে গিয়ে বাংলাদেশিদেরকে যেসব সমস্যায় পড়তে হয় সেসব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণালাভে আমরা সক্ষম হয়েছি। সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে- সঠিক চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া, চিকিৎসায় অধিককাল ক্ষেপণ এবং আর্থিক খরচ। এসব ব্যাপারে ইতোমধ্যে আমাদের কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন এবং কয়েকটি উৎস খুঁজে বের করার সুযোগ হয়েছে। তাই বাংলাদেশ থেকে যারা চিকিৎসার জন্য মুম্বাইয়ে যাচ্ছেন, ওখানে তাদের দ্রুত চিকিৎসা এবং ওষুধের মূল্য বাবদ বেশ কিছুটা আর্থিক সাশ্রয়ের প্রয়োজনে নিম্নোক্ত মোবাইল ফোন, ই-মেইল অ্যাড্রেস বা ফেসবুক অ্যাড্রেসের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে পারেন।
মোবাইল: ০১৭৩০৪৪৪৭৮২, ০১৯১২০২৩০৫৩
ই-মেইল:
ফেসবুক অ্যাড্রেস: http://www.facebook.com/bn.adhikary
আসুন আমরা সবাই মিলে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে সুস্থ করে তুলতে এবং তাদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করি।
সময় পেলে নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি পড়ার অনুরোধ করছি। এতে মোটামুটি সবিস্তার কিছু গুরত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে।
[img|http://cms.somewhereinblog.net/ciu/image/139762/small/?token_id=29726c75c49fc5cea123dbacbc1e8a14
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ক্যান্সারই সম্ভবত সবচেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি। এ ব্যাধি সম্পূর্ণরূপে সেরে যাবে এমন নিশ্চয়তা কোন চিকিৎসকই প্রদান করতে পারেন না, বিশেষ করে রোগটি যখন ৩য় বা ৪র্থ স্তরে গিয়ে পৌঁছায়।
কোন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বা কোন চিকিৎসক না হওয়া সত্ত্বেও বিগত পৌনে দু’বছর একজন ভুক্তভোগী হিসেবে আমার এই তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের দুর্ভাগ্য হয়েছে। পরিস্কারভাবে বলা শ্রেয় যে, ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে আমার স্ত্রী- সীমা’র স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত একটি অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে ওর শরীরের ভিন্ন অংশ- সিগময়েড কোলনে ২য় স্তরের ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকা এবং ভারতের মুম্বাইয়ে প্রাপ্ত সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে ওকে সুস্থ রাখা এবং ওর রোগ নিরাময়ে অবিরাম প্রচেষ্টা চালছে। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের পারদর্শী শৈল্য চিকিৎসক ডা: আনিসুর রহমান এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদ্বয় ডা: লক্সমন ওবেসেকারা ও ডা: হাফিজুর রহমার আনসারী এবং মুম্বাইয়ের জগদ্বিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: সুরেশ হরিরাম আদভানির তত্ত্বাধানে যৌথভাবে ওর চিকিৎসা চলছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১২ সালের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অ্যাপোলো হসপিটালস ঢাকার শৈল্য চিকিৎসক এবং ক্যান্সারবিদবৃন্দ খুব যত্ন সহকারে সীমা’র চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন।
সুস্থতা ও রোগ নিরাময়ের ব্যাপারে তাঁরা অত্যন্ত আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তাই সিগময়েড কোলনে অস্ত্রোপচারশেষে প্রথম পর্যায়ের ৮ মাত্রা কেমোথেরাপি দেবার পর অ্যাপোলোর ডাক্তাররা অধীর আগ্রহে ওর রোগ নিরাময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। এর পিছনে মূল কারণ হচ্ছে- প্রথমত, চিকিৎসায় রোগী হিসেবে সীমা’র সহায়তা ও রেসপন্স, দ্বিতীয়ত ওকে বাহ্যিকভাবে দেখলে, রোগ সম্পর্কে না জানলে ওকে ক্যান্সার রোগীতো থাক দূরের কথা, কোন রোগী বলেই মনে হয় না এবং তৃতীয়ত, সাধারণত চিকিৎসাকালীন ক্যান্সার রোগীদের যেসব জটিলতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, ওর বেলায় সেসব খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। তাই পর্যায়ক্রমিক ক্যান্সার চিকিৎসার নিয়ম মাফিক শরীরের কোথাও কোন ক্যান্সার জীবানু বা সেলের উপস্থিতি রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য সীমার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ২০১২ সালের ১৭ নমেভম্বর ওর Positron Emission Tomography - Computed Tomography (PET-CT) স্ক্যান করা হয়। কিন্তু আমাদের বিধি অনেকটা বাম।
কারণ, সর্বাধুনিক এই পরীক্ষায় সীমার লিভারে ছোট-ছোট একাধিক ক্যান্সার সেল- যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় ‘লিভার মেটস- শনাক্ত হয়। ২৪ নভেম্বর PET-CT স্ক্যান রিপোর্ট দেখার পর শ্রীলংকান ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: লক্সমন ওবেসেকারাকে অকেটা বিমর্ষ হতে দেখা যায়। সীমার সামনে তিনি আমাদেরকে বিষয়টি সামান্য বিবৃত করেন এবং তাৎক্ষনিকভাবে বইপত্র ঘেটে দ্বিতীয় পর্যায়ে সীমাকে ৮টি উচ্চ মাত্রার কেমোথেরাপি নেবার চিকিৎসাপত্র লিখে ফেলেন। ডাক্তার রোগীর সামনে স্পষ্ট কিছু না বললেও চিকিৎসা বিষয়ক একটি উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরীয়ান হিসেবে কর্মরত থাকার কারণে রোগের অবনতি সম্পর্কে সীমা বুঝতে পারে। আমাদের মাথায় বাজ পড়ার শামিল হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ একাধিক, বিবৃত করা নিষ্প্রোয়জন। সে যা-ই হোক, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে দেশের বাইরে- সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক বা মুম্বাইয়ে দ্বিতীয় মতামতের ভিত্তিতে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। তাই বাসায় ফিরে উল্লেখিত তিন জায়গার কোথায় সবদিক মিলিয়ে সীমাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা করানো সুবিধা হবে তা জানতে বিভিন্ন মাধ্যম ও মহলে যোগাযোগ শুরু করি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের বাইরে ইন্টারনেট- বিশেষ করে ফেসবুকে এ সম্পর্কে তথ্য জানাতে বন্ধুদেরকে অনুরোধ জানাই। এতে বেশ ভাল সাড়া মিলে।
একাধিক বন্ধু-বান্ধব ফোন, ই-মেইল এবং ফেসবুকে নানা প্রকার তথ্য দিয়ে সহায়তায় এগিয়ে আসেন। সীমা’র চাকুরির সুবাদে ও নিজেও চিকিৎসার দ্বিতীয় মতামতের ব্যাপারে অনেক ডাক্তারের সাথে আলাপ করে। সব মতাতম এবং তথ্য যাচাই করে আমরা মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল এবং ভারতের পদ্মভূষণ খেতাবপ্রাপ্ত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: সুরেশ হরিরাম আদভানি’র পরামর্শ নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সে মোতাবেক সবকিছু গোছগাছ করে ২২ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখ ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে একরাত কোলকাতা অবস্থান করে ২৩ ডিসেম্বর রাতে মুম্বাই পৌঁছি। পরের দিন, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, ওখানে চিকিৎসা করাতে কমপক্ষে ২ মাস সময়ের হবে- যা বিভিন্ন কারণে আমাদের জন্য মোটেও সম্ভব ছিল না।
তাই এ পর্যায়ে আমি ও সীমা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর কথা মাথা থেকে বাদ দিয়ে ডা: আদভানিকে দেখানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে যেসব বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার মুম্বাই যেতে বিভিন্নভাবে সহায়তা যুগিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকেই অন্তত একবার যেন ডা: আদভানি’র সাথে আমরা দেখা করতে ভুল না করি তা বলে দিয়েছিলেন- তা সীমা’র চিকিৎসা টাটা মেমোরিয়াল বা অন্য যেখানেই করানো হোক না কেন। এদের মধ্যে কেউবা নিজে, আবার কারোবা আপনজন কোন না কোন সময়ে ক্যান্সার রোগী হিসেবে টাটা মেমোরিয়াল অথবা ডা: আদভানির চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে দু’জন এমনও বলেছেন- টাটা মেমোরিয়াল এবং ডা: আদভানির নিকট চিকিৎসা গ্রহণের পর আরো উন্নত চিকিৎসার আশায় তারা উন্নত দেশে গেলে ওখানকার চিকিৎসকরা ডা: আদভানির পরামর্শই যথার্থ বলে মত প্রদানপূর্বক সেভাবেই চিকিৎসা চালিয়ে যাবার নির্দেশদান করেন। তাছাড়া ইন্টারনেট ঘেটে এবং অন্যান্য বিভিন্ন সূত্রে আমি ডা: আদভানি সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানতে পারি, যেমন- দীর্ঘদিন যাবত মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং তাঁর প্রচেষ্টাতেই ক্যান্সার চিকিৎসায় উক্ত হাসপাতালের প্রভূত উন্নতিসাধন ও বিশ্বব্যাপী খ্যাতিলাভ, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিশ্বে যে কোনও নতুন ওষুধ আবিষ্কারে পর্যবেক্ষণোত্তর তাঁর মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ আবশ্যকীয়, নিরলস কর্মপ্রয়াস ও সফলতার মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার- প্রথমে ‘পদ্মশ্রী’ এবং পরবর্তীতে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত হওয়া ইত্যাদি।
তাই আমরা নির্দ্বিধায় আগেই ঢাকা থেকে করে রাখা অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জসলক হাসপাতালে ডা: আদভানিকে দেখানোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সে কথায় পরে আসছি।
দেশে ও দেশের বাইরে এই জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই আমাদেরকে নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগীদের সচারাচার যেমনটি ঘটে থাকে- তেমনটি আমাদের বেলাতেও কোনই ব্যতিক্রম নয় যে, ব্যয়বহুল এই দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা-খরচ নির্বাহ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধ্যাতীতভাবে ধারদেনা করে আমরা সীমা’র চিকিৎসা প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছি এবং তা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, তা আমাদের জন্য যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন।
সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য, সহযোগিতা এবং প্রচেষ্টায় সীমা এখনোবধি স্বাভাবিক জীবনযাপনসহ ওর সরকারি দপ্তরে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং সাধ্যাতীত সীমা’র চিকিৎসা খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে সেই প্রথম থেকেই সবসময় আমাদের মাথায় একটি বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা অব্যাহত রেখে এই রোগের চিকিৎসা খরচ কতটা পরিমাণ এবং কীভাবে কমানো যেতে পারে। এতে আমরা দেখেছি- ক্যান্সার রোগ সারাতে কেমোথেরাপি প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ওষুধের ধারণাতীত উচ্চমূল্য হচ্ছে খরচের অন্যতম প্রধান খাত। আমাদের দেশে এ জাতীয় ওষুধের দুর্মূল্যের কারণগুলো হচ্ছে- দুষ্প্রাপ্যতা এবং একক আমদানিকারক।
সীমা’র ক্যান্সার চিকিৎসার প্রথম থেকেই আমাদের ধারণা ছিল- কোন না কোনভাবে এমন কোন একটি সূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে- যার মাধ্যমে কিছুটা হলেও স্বল্পমূল্যে ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে।
তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সূত্র ও উৎসে যোগাযোগ করে আমরা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। মূল কারণ ঐ একই- ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা এবং একক আমদানিকারক। সে যাহোক, হাল না ছেড়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে চিকিৎসার জন্য সীমাকে নিয়ে যখন ভারতের মুম্বাইয়ে যাই, তখন হ্রাসকৃত মূল্যে ওষুধ ক্রয়ের বিষয়টি আমরা মাথায় রাখি। কারণ বড় দেশ বিধায় সে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধ প্রস্তুত বা আমদানি, সরবরাহ ও ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বিস্তৃত ও কিছুটা উন্নতও বটে। তাই ওখানে এরকম একটি সুযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয় বলে আমাদের মনে হয়েছে।
আর এই সুযোগের মূল তরিকা হতে পারে সঠিক উৎস বা সূত্র খুঁজে বের করা- যে ব্যাপারে আমরা অনেকটা মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টায় ছিলাম। এতে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত তিনবার সীমা’র চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবার তৃতীয়বারে চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি সুযোগ সৃষ্টিতে সফলতা আসে। কীভাবে এই সুযোগ সৃষ্টিতে সফলতা আসে সকলের জ্ঞাতার্থে তার ঘটনা পরম্পরা সারসংক্ষেপ এখানে বিবৃত করছি।
২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের জসলক হাসপাতালে ডা: আদভানি দ্বিতীয় পর্যায়ে সীমা’র ১২ ডোজ কেমোথেরাপি নেবার চিকিৎসাপত্র লিখে দিয়ে পরের দিন ২৮ ডিসেম্বর বেলা ১০টায় মূল চিকিৎসা, অর্থাৎ প্রথম ডোজ কেমোথেরাপি নিতে তাঁর সাথে দেখা করতে বলেন। তিনি জানালেন দিনের বেলা তিনি যেখানে রোগী দেখেন সেখানেই কেমোথেরাপি নেবার উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে।
২৮ ডিসেম্বর সীমাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বেলা ১১টা নাগাদ ডা: আদভানির সাথে দেখা করি। তাঁর পরামর্শ অনুসারে ওখানকার ‘ডে কেয়ার অ্যাঞ্জেলস্’ নামক কেমোথেরাপি সেন্টারে ঐ দিন দ্বিতীয় পর্যায়ের ১২ ডোজের প্রথম ডোজ কেমোথেরাপি দেয়া হয়। ঐ হাসপাতাল ভবনেই অবস্থিত ফার্মেসি থেকে সব ওষুধ সরবরাহ করা হয়। সেখানে ভারতীয় রূপীতে পরিশোধিত মূল্য বাংলাদেশের টাকায় হিসেব কষে আমি ঢাকায় ফোন করে এক বন্ধুকে উচ্চমূল্যের মূল ওষুধ ‘অ্যাভাস্টিন-এর দাম আমাকে জানাতে বলি। সে বাংলাদেশে ঐ ওষুধের একমাত্র বৈধ আদামদানিকার ও বিক্রেতার কাছ থেকে দাম জেনে তা আমাকে জানালে তুলনা করলে দেখা যায়- ঐ ফার্মেসিতে ওষুধের দাম আমাদের দেশের চেয়ে কিছুটা কম হলেও আমি যতটা আশা করেছিলাম ততটা কম নয়।
আমার মনে হল- সঠিক উৎসে পৌঁছানোর সূত্র খুঁজে বের করতে পারলে আরও কম দামে ওষুধ পাওয়া সম্ভব। কারণ, সাধারণত হাসপাতাল ভবনে অবস্থিত ফার্মেসিগুলোতে ওষুধের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হয়ে থাকে। তাই আমি সূত্র সন্ধানের চেষ্টায় থাকি। কিন্তু প্রথমবারের মত মুম্বাইয়ে গিয়ে কী করে এ ধরনের উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব তা বারবার আমার মাথায় ঘুরতে থাকে!
সে যাহোক, সীমা’কে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ২০১২ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রথম পর্বে ফোলফক্স নামের কেমোথেরাপি দেয়া হয়। কেমোথেরাপির মূল ইনজেকশন এই ফোলফক্সের সাথে আনুসঙ্গিক অন্যান্য ইনজেকশন, স্যালাইন, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ওষুধের সবকিছুই ঐ সময় অ্যাপোলো হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসি থেকে গলাকাটা দামে সরবরাহ করা হয়।
অ্যাপোলো’র ফার্মেসিতে না পাওয়ার কারণে শুধুমাত্র পোর্ট নিডলটি আমরা বাইরের একজন বিশ্বস্ত ডাক্তারের নিকট থেকে কিনে নিতাম, তাও গলাকাটা দামেই। যাহোক, মুম্বাইয়ে ডা: আদভানি সীমাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে অ্যাভাস্টিন নামের মূল কেমোথেরাপি ইনজেকশন, সহযোগী ইরনোটিক্যান ইনজেকশন এবং সাথে জেলোডা নামের খাবার ট্যাবলেটের চিকিৎসা-পরামর্শদান করেন। আমি হিসাব কষে দেখলাম- এই দুই প্রকার ইনজেকশন, জেলোডা ট্যাবলেট এবং পোর্ট নিডল মুম্বাই থেকে কিনে নিলেই সব মিলিয়ে বেশ কিছু অর্থের সাশ্রয় হবে। ডা: আদভানির দেয়া ১২ ডোজ কেমোথেরাপির মধ্যে প্রথম ডোজটি ‘ডে কোয়ার অ্যাঞ্জেলস্’-এ নিয়ে পোর্ট নিডলসহ আরও পাঁচ ডোজ কেমোথ্যারাপি ঢাকায় নেবার জন্য উপরোউল্লেখিত দুই প্রকার ইনজেকশন ও জেলোডা ট্যাবলেট কিনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং সে তোমাবেক ওখানে অর্ডার প্লেস করি। উল্লেখ্য, ১২ ডোজ কেমোথেরাপির মধ্যে ৬ ডোজ নেবার পর, অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের চিকিৎসার মাঝামাঝি সময়ে সীমাকে ডা: আদভানি আবার দেখা করতে বলেন বিধায় আমি অর্ধেক পরিমাণ ওষুধ ঐ সময় কিনে আনার ব্যবস্থা করি এবং পরবর্তীতে, অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালের মার্চ মাসে যখন পুনরায় ডাক্তার দেখাতে মুম্বাইয়ে আসতে হবে তখন বাকি ওষুধ কিনবার পরিকল্পনা মাথায় রাখি।
২৮ ডিসেম্বর (২০১২) ‘ডে কেয়ার অ্যঞ্জেলস্’-এ সীমা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ডোজ কেমোথেরাপি নেবার দিনই ওষুধের অর্ডার প্লেস করি। সে মোতাবেক মূল ইনজেকশন, অর্থাৎ অ্যাভাস্টিনসহ অন্যান্য কয়েকটি ওষুধ ও পোর্ট নিডল কিছুটা কম মূল্যে পেয়ে যাই। যথাসময়ে হস্তগত হবার ফলে ওষুধ সমেত আমরা ১ জানুয়ারি (২০১৩) রাতে মুম্বাই থেকে রওয়ানা হয়ে ২ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছি। কিন্তু, মধ্যসত্ত্বভোগীকে অপসারণ করার বিষয়টি আমার মাথায় রয়েই যায়। এরপর ডা: আদভানির পরামর্শ মোতাবেক দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ২য় থেকে ষষ্ঠ ডোজ কেমোথেরাপি শেষে কিচিৎসার মাঝামাঝি পর্যায়ে সীমাকে নিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে ১৯ মার্চ ২০১৩ তারিখ মুম্বাই গিয়ে পৌঁছি।
পরের দিন- ২০ মার্চ ডা: আদভানিকে দেখানো এবং কয়েকটি পরীক্ষা করার পর ২২ মার্চ সেই ‘ডে কেয়ার অ্যাঞ্জেলস্’-এ ৭ম ডোজ কেমোথেরাপি দেয়া হয়। আমার মাথায় মূল সরবরাহকারীর নিকট থেকে হ্রাসকৃত মূল্যে ওষুধ ক্রয়ের সেই একই চিন্তা । তবে টাকার স্বল্পতার কারণে পোর্ট নিডলসহ ১২ ডোজের বাকি আরও ৫ ডোজ ওষুধের কিছু পরিমাণ পূর্বের মূল্যে মুম্বাই থেকে নিয়ে আসতে পারি, আর বাকিটা আমাকে ঢাকা থেকে সেই উচ্চমূল্যেই ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ১২ ডোজ কেমোথেরাপি নেওয়া শেষ হবার ১ মাস পর ডা: আদভানি সীমাকে পুনরায় তাঁর সাথে সাক্ষাতের পরামর্শদান করেন। সে মোতাবেক আমরা ২ জুলাই ২০১৩ তারিখে তৃতীয়বারের মত মুম্বাই গিয়ে পৌঁছি।
নিয়ম মাফিক এবারও বেশ কিছু বড় ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাশেষে সেগুলো ৫ জুলাই ডা: আদভানিকে দেখানো হলে তিনি সীমাকে তৃতীয় পর্যায়ে ৮ ডোজ কেমোথেরাপি চিকিৎসার এবং সবগুলো ডোজ শেষ হবার ১ মাস পর তাঁর সাথে দেখা করার পরামর্শদান করেন। এ পর্যায়ের কেমোথেরাপির মূল ইনজেকশন হচ্ছে- আরব্যুটাক্স। সহযোগী ইনজেকশনসহ অন্যান্য ওষুধ আগেরগুলোই ডাক্তার বহাল রাখেন। ঐ দিনই, অর্থাৎ ৫ জুলাই ‘ডে কেয়ার অ্যাঞ্জেলস্’-এ তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম ডোজ কেমোথেরাপি সীমাকে দেয়া হয়। ওখানকার কর্তব্যরত ম্যানেজারের কাছ থেকে জানতে পারি আরব্যুটাক্স দুষ্প্রাপ্য ওষুধ বিধায় বাংলাদেশে এটি নাও পাওয়া যেতে পারে।
সাথে-সাথে এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রায় সকল প্রকার ওষুধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আমদানিকারক কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারের নিকট ফোন করে জানতে পারি তারা আরব্যুটাক্স আমদানি করেন না এবং অন্য কেউ আমদানি করেন কিনা তাও তার জানা নেই। ঢাকার বন্ধুকে এই ইনজেকশনের প্রাপ্যতার খবর নিয়ে আমাকে জানাতে অনুরোধ করি। বন্ধু আগাম জানিয়ে দিলেন তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি মুম্বাই থেকেই আরব্যুটাক্স কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তার জানামতেও বাংলাদেশে কেউ আরব্যুটাক্স আমদানি করে না। পাশাপাশি আমি ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ফার্মাসিস্টকে ফোন করলে তিনিও জানান বাংলাদেশে কেউ এই ইনজেকশন আমদানি করে না। তবে তাদের হাসপাতালে কেমোথেরাপি নিতে আসা রোগীদের জন্য তারা নিজেরাই আরব্যুটাক্স আমদানির ব্যবস্থা করে থাকেন।
কিন্তু এ জন্য তাদের নিকট কমপক্ষে ১৫ দিন আগে অর্ডার প্লেস করতে হয়। এ সবের অর্থ হচ্ছে- সেই গলাকাটা দামের ফাঁফর। এমতাবস্থায় আমরা মুম্বাই থেকেই পুরো ওষুধ ক্রয় করে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এ পর্যায়ে আমি মধ্যসত্ত্বভোগী বাদ দেয়ার প্রতি জোর দেই। প্রথম দুইবারের সূত্রগুলো ধরে আমি অগ্রসর হতে থাকি এবং এক পর্যায়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যেতে, অর্থাৎ মুম্বাই থেকে সারা ভারতে ওষুধ সরবরাহকারী একটি উৎসের সন্ধান পেতে সক্ষম হই।
ব্যবসায়িক নীতিতে সাধারণত সরবরাহকারী কেউ কোন প্রান্তিক ক্রেতার নিকট ওষুধ বিক্রি করে না। তাই উক্ত সরবরাহকারীকে আমাদের নিকট সরাসরি ওষুধ বিক্রিতে রাজি করাতে বেশ কসরত করতে হয়। এ কাজে মুম্বাইয়ে তিনবার যাওয়ার সুবাদে ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠা ওখানকার এক বন্ধু বিশেষ সহায়তা করেন। এভাবে ক্রয় করতে পারায় দেখা গেল আরব্যুটাক্স, ইরনোটিকান, জেলোডা এবং পোর্ট নিডলওগুলোর দাম গড়পরতা মুম্বাইয়ের খুচরা বাজারের চেয়ে প্রায় ২৫% কম পড়েছে। আমরা ঐ দিন আংশিক মূল্য পরিশোধ করে পরের দিন গোটা দাম মিটিয়ে ওষুধ ডেলিভারী নেব বলে ওখান থেকে বিদায় নিতে যাব এমন সময় সীমা আমাকে টেনে বসিয়ে দেয়।
আমি অনেকটা হতভম্ব হয়ে চেয়ারে বসে পড়ি। আমরা যে দামে ওষুধ কিনতে পারলাম, অন্য ক্যান্সার রোগীরাও এই দামেই ওখান থেকে ওষুধ কিনতে পারবে কিনা সীমা তা সরবরাহকারীকে জিজ্ঞেস করে বসে। সরবরাহকারী সম্ভবত এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তিনিও অনেকটা হতভম্ব হয়ে চুপ বনে যান। আমিও সীমার প্রস্তাবেরই পুনরাবৃত্তি করি।
কারণ, আমরা জানি এই ব্যবস্থা করা গেলে বাংলাদেশ থেকে মুম্বাইয়ে চিকিৎসা নিতে আসা প্রচুরসংখ্যক ক্যান্সার রোগীর অনেক আর্থিক সাশ্রয় হবে। তারা বাংলাদেশের বাজার মূল্যের চেয়ে কমবেশি ৪০% কম মূল্যে ওষুধ কেনার সুযোগ পাবেন। এটি যে কত বড় সহায়তা তা আমরা বিগত পৌনে দু’বছর যাবত প্রতিনিয়ত টের পেয়ে আসছি এবং ভুক্তভোগী সবাইও তা জানেন। যাহোক, অত্যন্ত আশার কথা- ওষুধ সরবরাহকারী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মানবিকতার দিকটি বিবেচনা করে আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। আমরা অনেকটা খুশি মনে নভি মুম্বাইয়ের ক্ষণিক আবাসস্থলে ফিরে আসি এবং বিষয়টি দেশে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
সে কারণেই এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের অবতারণা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।