আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পহেলা বৈশাখেও যাঁরা রাজনীতির গন্ধ পান, তাঁদের মূর্খ তো বটেই, অসুস্থ বলার ইচ্ছা যদি কারো হয় তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না--সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

পহেলা বৈশাখেও যাঁরা রাজনীতির গন্ধ পান, তাঁদের মূর্খ তো বটেই, অসুস্থ বলার ইচ্ছা যদি কারো হয় তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। পহেলা বৈশাখ তো সাংস্কৃতিক; সে আমাদের সংস্কৃতির অংশ এবং আজকের ব্যাপার নয়, অনেককালের, এখনকার রাষ্ট্র যখন ছিল না তখনো সে ছিল এবং আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সংস্কৃতি নিজেই কি রাজনীতি-নিরপেক্ষ বা রাজনীতি-বহির্ভূত, বিশেষ করে আজকের বিশ্বে? সে প্রশ্নের কাছে আমরা একটু পরেই আসছি। আপাতত এটা স্মরণ করা যাক, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারিকেও অনেকে বলেন কেবলই সাংস্কৃতিক।

তাঁদের যুক্তিটা এই রকমের যে একুশে ফেব্রুয়ারি তো ভাষার ব্যাপার, ভাষার দাবিতে লড়াই, তাকে আবার রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো কেন। একুশ সাংস্কৃতিক অবশ্যই, সংস্কৃতির প্রধান যে উপাদান, ভাষা, আগ্রাসনের মুখে তাকে রক্ষা করার জন্যই একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের চরিত্রটা তো ছিল পরিপূর্ণরূপেই রাজনৈতিক। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হয়েছে আমাদের, সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য। রাষ্ট্র তখন আমাদের বিরুদ্ধপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে, তার সংস্কৃতি বিরুদ্ধতার জন্য; এবং প্রমাণিত হয়েছে, সংস্কৃতির পক্ষে সম্ভব নয় রাজনীতির বাইরে যাওয়া। বিশেষ করে আজকের দিনে, রাষ্ট্রীয় বাহু যখন অত্যন্ত দীর্ঘ এবং প্রচারমাধ্যমের ওপর যখন তার নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত।

একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে অবশ্য পহেলা বৈশাখের পার্থক্য রয়েছে। সেটা মোটেই অস্পষ্ট নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি আধুনিককালের এবং বিশেষ রাজনৈতিক কারণেই তার উদ্ভব ঘটেছে; অপরদিকে পহেলা বৈশাখ অনেকদিনের ঐতিহ্য। আরো বড় কথা, পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়নি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেমনটা করতে হয়েছে। কিন্তু তখনকার রাষ্ট্র যে পহেলা বৈশাখের পক্ষে ছিল তা তো নয়।

বিরুদ্ধেই ছিল। পহেলা বৈশাখের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইহজাগতিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিকতা, সর্বোপরি বাঙালিত্ব; তখনকার রাষ্ট্র এসব গুণকে নিতান্ত দোষের বলে জ্ঞান করত। ওই রাষ্ট্রের চেহারা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছিল একাত্তর সালে, যে বছর বাংলাদেশের কোথাও পহেলা বৈশাখ পালিত হয়নি। পালিত না হওয়ার কারণটা স্পষ্টতই ছিল রাজনৈতিক। আমরা বছর গণনা বৈশাখের হিসাবে করি না, করি জানুয়ারির হিসাবে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে করি, ব্যক্তিগতভাবেও করি; উভয় ক্ষেত্রেই উৎসাহটা আসে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশে চালু হয়েছে সেটা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ মানুষকে একাধারে মুনাফালোভী ও ভোগবাদী করে। সেটাই ঘটছে। ব্যক্তি মুনাফা খুঁজে হয়রান হচ্ছে, আর মুনাফার সঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা জড়িত।

এ ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষা যেমন অধিক মূল্যবান বাংলা ভাষার তুলনায়, পহেলা জানুয়ারিও তেমনি অধিক গুরুত্বপূর্ণ পহেলা বৈশাখের তুলনায়। বৈশাখ তাই পেছনে পড়ে থাকে, জানুয়ারি থাকে সামনে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক ও গ্রামের বাসিন্দারা অবশ্য বৈশাখকে খুবই চেনে। কেননা, বৈশাখ তাদের শ্রম, উৎপাদন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা আজ প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন, গুরুত্বহীন মানুষেরা নয়।

বৈশাখ ওই গুরুত্বহীনদের কাছে খুবই প্রখর ও জাগ্রত। কিন্তু তারা তো নেতৃত্বে নেই। নেতৃত্বে যারা আছে তারা জানুয়ারিকে মেনে চলে, বৈশাখের জন্য তোয়াক্কা করে না। এতে যে রাজনীতি নেই এটা কে বলবে? সর্বক্ষেত্রে যারা আজ নেতৃত্বে রয়েছে তারা ওখানে বসেছে বিশেষ রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার কারণেই, ব্যবস্থাটা বদলে গেলে নড়চড় হতো, অনেকেই নিচে পড়ে যেত। পহেলা বৈশাখের আসল শত্রু কিন্তু স্থানীয় নয়, সেটা বৈশ্বিক।

সে হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ। সেই পুরনো সাম্রাজ্যবাদ। বাজার দখল নয়, ভূমি দখল। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পেছনে তো কোনো কারণ নেই, অজুহাতও নেই, একটি ছাড়া যে সেখানে তেল আছে, আর মার্কিনিদের হাতে ক্ষমতা আছে। সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে এক করে দেবে, পদানত করতে উদ্যত হবে এবং তারা নিজের মুনাফালোভী ও ভোগবিলাসী পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিতে চাইবে।

মানুষ আজ আর নিরাপদ নয়, ব্যক্তি মানুষ নয়, সমষ্টিগত মানুষও নয়। রাষ্ট্রের ভেতর রয়েছে পুঁজিবাদীরা, যারা সাম্রাজ্যবাদের অনুচর বটে। এই অনুচররা পহেলা জানুয়ারি চেনে, স্থানীয় নববর্ষ চেনে না। সংস্কৃতি মোটেই রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। সে কাজ করে জনগণের পক্ষে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।

স্বৈরাচার রাষ্ট্রের ভেতরে থাকে, থাকে রাষ্ট্রের বাইরেও। যেখানেই থাকুক তার সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধটা রাজনৈতিক এবং মৌলিক। দুয়ের ভেতর সহাবস্থান একেবারেই অসম্ভব। নতুন শতাব্দীর শুরুতে আমরা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ নামে একটি বস্তুর কথা শুনেছি। বস্তুটি যে কী তা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনি।

মার্কিনিদের ইরাক আক্রমণ কিন্তু চ্যালেঞ্জটিকে ধরিয়ে দিয়েছিল একেবারে হাতেনাতে। চ্যালেঞ্জটি অন্যকিছুই নয়, সাম্রাজ্যবাদ ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদী অজগরের মুখটি খুব বড়। সাম্রাজ্যবাদের চ্যালেঞ্জ মানুষের মনুষ্যত্বের ওপর আক্রমণ। আর যাকে মনুষ্যত্ব বলি সে তো আকাশে থাকে না, থাকে না সমুদ্রেও, থাকে সংস্কৃতিতে।

সংস্কৃতিই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য সেই জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করতে হবে; বিচ্ছিন্নভাবে নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে। বিশ্বব্যাপী আজ যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা ও ঐক্য গড়ে উঠেছে তার একটা রাজনৈতিক চরিত্র আছে, থাকতেই হবে এবং সেটা ক্রমাগত দৃঢ়তর হবে; কিন্তু এর অভ্যন্তরে যা রয়েছে, সেটা সাংস্কৃতিক। সংস্কৃতিই হচ্ছে চূড়ান্ত সত্তা। কিভাবে লড়া যাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে? লড়তে হবে জনমত সৃষ্টি করে এবং সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে। সব দেশে আলাদাভাবে এবং সব দেশ মিলে।

মার্কিন ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের বিষয়টা সামনে এসেছিল। বর্জন কঠিন, কেননা, পণ্যের ওপর নির্ভরতা অনেক গভীরে চলে গেছে। তা ছাড়া কেবল নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বর্জন করলেই তো চলবে না, যে রুচি ও অভ্যাস গড়ে উঠেছে তাও পরিত্যাগ করা দরকার। এ ব্যাপারটাও সাংস্কৃতিক বটে। ইংরেজি ভাষা ব্যবহার, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উন্নয়ন, প্রগতিশীলতা ইত্যাদির যেসব ধারণা আমরা গড়ে তুলেছি, তা কেবল বাইরের ব্যাপার নেই, মস্তিষ্কেও প্রবেশ করে বসে আছে।

আজকে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যেমন নৈতিকভাবে, তেমনি সাংস্কৃতিকভাবেও। লক্ষ্য থাকবে আরো একটা। কেবল বর্জন নয়, আমরা সৃষ্টিও করব। আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে, দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। অর্থনৈতিকভাবে আত্দনির্ভরশীল হতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা যে যুদ্ধ করেছি, সেটা অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদী বিশ্বের অধীনে যাওয়া এবং নিজেদের দেশে পুঁজিবাদকে বিকশিত করার জন্য নয়। আমরা চেয়েছিলাম প্রকৃত মুক্তি; ভেতরে ও বাইরের পুঁজিবাদ যে মুক্তি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তিটা কেন চাই? না, ভোগবাদিতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য নয়। ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হব এমন ইচ্ছা থেকেও নয়। চেয়েছি আসলে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

সেই সংস্কৃতিকে যেখানে রক্ষিত আছে আমাদের নিজস্বতা ও আত্দপরিচয়, রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিকতা; আছে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে আত্দীয়তা, আছে দেশপ্রেম, আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। পহেলা বৈশাখ আমাদের ওই সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরে একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে, এসে সংগ্রামের পথটিকে আরো পরিষ্কার করে দিয়েছে। পহেলা বৈশাখ সাংস্কৃতিক, আর সে জন্যই তার পক্ষে সম্ভব নয় অরাজনৈতিক হওয়া। তার রাজনীতি প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, অর্থাৎ নববর্ষ যাতে সব মানুষের হয়, প্রত্যেকের জীবনে আনন্দ ও অগ্রগতি নিয়ে আসে সেই লক্ষ্যে এগোনোর।

এ রাজনীতি নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠার এবং নিজস্বতার ওপর ভর করে বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এতে রয়েছে পুঁজিবাদের মুনাফালোভ ও ভোগবাদিতা পরিহারের আহ্বান। পুঁজিবাদ আরো একটি ভয়ঙ্কর কাজ করে, ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজ থেকে এবং পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে। পহেলা বৈশাখ আমাদের বলে সংলগ্ন হতে, ঐক্যবদ্ধ হতে এবং প্রোথিত থাকতে সংস্কৃতির ভূমিতে। পহেলা বৈশাখে মেলা হয়, কিন্তু তাতে বাণিজ্য প্রধান হয়ে ওঠে না, প্রাধান্য থাকে মিলনের ও আনন্দের।

আমাদের জন্য মিলনের ও আনন্দ করার মতো সর্বজনীন অবকাশ বড় অল্প, পহেলা বৈশাখ সেখানেও জরুরি। পহেলা বৈশাখের শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ, যারা মানব সভ্যতারও শত্রু বটে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পহেলা বৈশাখকে অরাজনৈতিক বলি কোন সাহসে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।