আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি



আটাশ দফা আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি আবুল কাসেম ফজলুল হক পূর্বকথা আটাশ দফা : বাংলাদেশে আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মনীতি নামে এই বক্তব্যটি লিখেছিলাম ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে, এবং তখনই স্বদেশ চিন্তা সক্সঘ পুস্তিকা আকারে এটি প্রকাশ করেছিল৷ পুস্তিকাটির প্রচার আরম্ভ করা হয়েছিল ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি৷ প্রথমে ছাপানো হয়েছিল ছয় হাজার কপি এবং মাস ছয়েক পরে আবার ছাপানো হয়েছিল আরো ছয় হাজার কপি৷ ওই পুস্তিকার লেখাটি সামান্য পরিমার্জিত রূপে সংকলিত আছে আমার অবয় ও উত্তরণ গ্রন্থে৷ সেখান থেকে এটি সংকলিত হয়েছে অনুপ সাদি সম্পাদিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থে৷ স্বদেশ চিন্তা সক্সঘ চেষ্টা করেছিল এবং আমার নিজেরও চেষ্টা ছিল যাতে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের, রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের, চিন্তাশীল লেখক-শিল্পীদের ও ছাত্রনেতাদের হাতে এটি পৌঁছে৷ দল-মতের পার্থক্য আমরা বিচার করিনি, আমরা কেবল অনুসন্ধান করেছি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে সম, সর্বজনীন কল্যাণে আগ্রহী, আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন, গ্রহিষ্ণু, প্রগতিপ্রয়াসী, রাজনীতিমনস্ক, সাহসী মন৷ ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও নানা স্থানে শিতি লোকদের মধ্যে_বিশেষ করে ছাত্র-তরুণদের মধ্যে এটি প্রচার করা হয়েছিল৷ চলমান বিপথগামী, অসুস্থ রাজনীতির জায়গায় উত্‍পাদনমুখী, সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনীতি আমরা কামনা করেছিলাম৷ ২০০৫ সালে বিএনপি জোট মতায় ছিল, আর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা ছিল বিরোধী দলে৷ মতাসীন ও মতালিপ্সুদের মধ্যে চলছিল অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া৷ বামপন্থীরা 'ইসু্য ভিত্তিক আন্দোলন' আর মৌলবাদের ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন৷ এনজিওপতিরা এবং সিভিল সোসাইটি সমূহের বুদ্ধিজীবীরা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা উপায়ে রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে তত্পর ছিলেন৷ বিবিসির এবং স্থানীয় প্রচারমাধ্যম সমূহের পূর্ণ সমর্থন ছিল তাঁদের প্রতি৷ ১৯৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকেই অনেক লোকের মুখে নিঃরাজনীতিকরণ ও ফবঢ়ড়ষরঃরপরুধঃরড়হ কথা দুটো শোনা যেত৷ ওই অবস্থায়, আটাশ দফা প্রকাশের বছর-দুই আগে থেকেই, সরকারি দল ও বিরোধী দলের বাইরে, নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন এমন লোকেরা ক্রমাগত বলে চলছিলেন, জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচন (২০০৭) হবে না, সামরিক আইন অথবা জরুরি অবস্থা জারি হবে৷ আমি নিজেও এমনটাই অনুভব করছিলাম৷ বামপন্থী মহল থেকে কার্যকর সৃষ্টিশীল কোনো রাজনৈতিক ধারা আত্মপ্রকাশ করুক এটা আমরা একান্তভাবে চেয়েছিলাম_এখনও চাই৷ ১৯০২ সালে অনুশীলন দল গঠনের সময় থেকে ধরলে বাম ধারা এদেশে চলছে আজ ১০৯ বছর ধরে৷ ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সময় থেকে ধরলে বাম ধারা এদেশে চলছে ৯০ বছর ধরে৷ ১৯৮০-র দশকের প্রথম দিক থেকেই আমি অনুভব করে আসছিলাম যে, এদেশের রাজনীতি বিপথগামী হয়ে চলছে৷ দেশে সামরিক আইন, কিংবা জরুরি অবস্থা, কিংবা বিদেশি শাসন হোক_এটা আমরা চাইনি৷ সুস্থ ধারার নতুন রাজনীতি গড়ে উঠুক_এটাই ছিল আমাদের একান্ত কামনা৷ সেজন্যই আটাশ দফার রচনা, প্রকাশ ও প্রচার৷ জরুরি অবস্থার পটভূমিতে 'নাগরিক কমিটি ২০০৬' নামক একটি সিভিল সোসাইটি ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল 'যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন'৷ আটশ দফা প্রচারিত হওয়ার দুই বছর পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষিত হল৷ এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেল, কিন্তু রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলাল না_উন্নত নতুন কোনো ধারা সৃষ্টিও হল না৷ প্রশ্ন হল, আমাদের চেষ্টার কি কোনো মূল্য নেই? আমাদের চেষ্টা কি ব্যর্থ হয়ে গেছে? স্বদেশ চিন্তা সক্সঘ থেকে আটাশ দফা : বাংলাদেশে আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মনীতি নামে যে পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল সেটিকেই এবার আরো স্পষ্ট রূপ দিয়ে আটাশ দফা : বাংলাদেশে আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি নামে এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ সম্পর্কে মত জানিয়ে আমাদের উপকৃত করেছেন৷ আমি নিজে উদ্যোগী হয়েও কারো কারো মত জেনেছি৷ এর পটভূমি অনেক বিস্তৃত, স্বল্প পরিসরে সেসব কথা উল্লেখ করা সম্ভব হল না৷ আমি প্রথম থেকেই ল করে আসছি, এই বক্তব্যের প্রশংসা, যাঁরা পড়েন সকলেই করেন, এবং প্রশ্ন করেন : এর বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? আমি উত্তর দিই : ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়৷ জনগণ এর বাস্তবায়ন চাওয়ার মতো করে চাইলে অবশ্যই এটি বাস্তবায়িত হবে৷ ১১. ১. ২০১১ আজকের বাস্তবতা প্রিয় দেশবাসী! আমার শ্রদ্ধা, প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন৷ আপনারা জানেন এবং অবশ্যই উপলব্ধি করেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল অবস্থায় নেই৷ বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলার কারণও এখন কমই খুঁজে পাওয়া যায়৷ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে স্বদেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সর্বজনীন কল্যাণবোধ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনের মনোভাব সুলভ নয়৷ অপরদিকে বামপন্থী গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রমতায় যাওয়ার কোনো প্রস্তুতি, এমনকি আকাক্সাও খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এ অবস্থায় রাজনীতির অঙ্গনে যাঁরা আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁরা কাজের কোনো উপায় পান না৷ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান, সাহসী, বিচণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে জাতি হিসেবে আমরা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হতে পারছি না৷ প্রগতির ধারা থেকে বিচু্যত হয়ে রাজনৈতিকভাবে আমরা বিপথগামী হয়ে পড়েছি৷ রাষ্ট্র ও রাজনীতি খারাপ হওয়ার ফলে আমাদের কারো জীবনই ভালো নেই৷ উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই যুগেও ভীষণ দুর্গতির মধ্যে আছি আমরা৷ ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় প্রথমে হিন্দু সমাজে, পরে মুসলমান সমাজে, যে রেনেসাঁস দেখা দিয়েছিল, বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকেই চরম বিশৃক্সখলা ও অপব্যবস্থার মধ্যে তার ধারা রুদ্ধ হয়ে যায়৷ চিন্তার জগতে প্রাধান্য বিস্তার করে চরম অসহিষ্ণুতা, নির্মম চমকপ্রবণতা ও মর্মান্তিক অদূরদর্শিতা৷ বিবিসি রেডিও হয়ে দাঁড়ায় জাতির চিন্তা ও কর্মের দিকনির্দেশক! জমিদারদের নির্দয় শোষণ-পীড়ন-প্রতারণার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী স্থানীয় প্রকৃতির কৃষকবিদ্রোহ, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, বিপ্লববাদী গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, সৃষ্টির প্রেরণায় প্রতি বছর একুশে ফেব্রম্নয়ারি উদযাপন, কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ড, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও নিজেদের স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সা, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা ও উনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ_এসবের মধ্য দিয়ে বিকশিত আদর্শবোধ, উদ্দেশ্যনিষ্ঠা ও সংগ্রামী চেতনার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷ এর মধ্যে চিন্তা ও কর্মের উন্নততর নতুন কোনো ধারা সৃষ্টিও হয়নি৷ প্রিয় দেশবাসী! মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির জীবনে সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ঘটনা৷ জনগণের অভাবনীয় জাগরণ ও সংগ্রামের ফলেই মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব ও সফল হয়েছে৷ ল প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ৷ এ নিয়ে জনগণের গৌরব বোধ করার যথার্থ কারণ আছে৷ তবে এটাও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সীমাবদ্ধতা, অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচু্যতির দিকও আছে৷ ১৯৭২ সালের প্রথম দিক থেকেই ক্রমাগত কেবল ত্রুটি-বিচু্যতির দিকগুলো বিকশিত হয়ে চলছে, মহান দিকগুলোকে বিকশিত করার, অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার চেষ্টা করা হচ্ছে না৷ নতুন নতুন সম্ভাবনাকে ক্রমাগত বানচাল করা হচ্ছে৷ বামপন্থীরা 'ইসু্যভিত্তিক আন্দোলন' ও সরকার-বিরোধী আন্দোলন করলেও নিজেরা রাষ্ট্রমতায় যাওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করেন না৷ বর্তমানে রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবনের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে গর্ব করা হয়, প্রায়শ তা হয় আন্তরিকতাহীন অসার আস্ফালন মাত্র৷ রাজনীতিেেত্র ধর্মের যেমন অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার চলে, তেমনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও চলে অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার৷ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের গৌরবময় সাহসী ভূমিকার কথা বলাই হয় না৷ আর নেতৃত্বের কথা যেভাবে বলা হয় তাতে সত্যের অপলাপ হয় মাত্র৷ যে গণতন্ত্রের কথা বলে বিপুল জাঁকজমকের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় প্রচার চালানো হয়, তা গণবিরোধী শক্তির গণতন্ত্র, দুর্বর্ৃত্তদের গণতন্ত্র, মুত্‍সুদ্দি ধনিক-বণিক-আমলা-এনজিওপতিদের গণতন্ত্র_জনগণের গণতন্ত্র নয়৷ আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা হীন স্বার্থ হাসিল করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রহিসেবে গড়ে উঠতে দিচ্ছে না, এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে 'পৃথিবীর দরিদ্রতম রাষ্ট্র', 'সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র', 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' 'সন্ত্রাসী রাষ্ট্র' ইত্যাদি নানা কথা প্রচার করে আমাদের মনে জাতীয় হীনমন্যতাবোধের জন্ম দিয়েছে৷ সমাজে অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, সহিংসতা ও স্থিতিহীনতা বিস্তারেও তারা তত্পর আছে৷ আর আমরা ক্রমাগত আত্মশক্তিতে আস্থা হারিয়ে চলছি৷ এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিরাট সম্ভাবনা নিয়েও ভালো নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ আজ আত্মপরিচালনায় অসমর্থ; অর্থনৈতিকভাবে জরাগ্রস্ত ও পরনির্ভর; সামাজিকভাবে অপব্যবস্থাকিষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত, সহিংসতা কবলিত, রুগ্ন; নৈতিকভাবে শক্তিহীন, নিঃস্ব এবং মনীষাগতভাবে প্রতিবন্ধী৷ সমাজের স্তরে স্তরে দোর্দও প্রতাপে প্রভুত্ব করে চলছে একটির পর একটি অপশক্তি৷ দেশি অপশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি অপশক্তি৷ দেশে বিরাজ করছে এক মাত্‍স্যন্যায়৷ পরিবেশের পীড়নে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের কোনো মহত্ আকাক্সাই স্বাভাবিক বিকাশের পথ পাচ্ছে না৷ উন্নত নতুন প্রযুক্তির ফলে কৃষিতে উত্‍পাদন বেড়েছে বটে, তবে সাধারণভাবে আমাদের জাতির উত্‍পাদনশক্তি (ঢ়ত্‍ড়ফঁপঃরারঃু) ও সৃষ্টিশক্তি (পত্‍বধঃরারঃু) বিকাশশীল নয়৷ এই পরিস্থিতি বিত্তশালীদের পরিণত করেছে প্রবৃত্তির দাসে আর মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের পরিণত করেছে অবস্থার দাসে৷ শাসকশ্রেণি অবলম্বন করেছে পরিকল্পনাবর্জিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি _ অবাধ প্রতিযোগিতা ও ভোগবাদ, আর বাড়িয়ে চলছে জনগণের দুর্দশা৷ জনগণ বাঁধা পড়েছে অবাঞ্ছিত সব রীতি-নীতির, প্রথা-পদ্ধতির ও বিধি-বিধানের শৃক্সখলে৷ মানুষ ক্রমাগত হারাচ্ছে মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা৷ কিন্তু জীবনের এই রূপই চিরন্তন রূপ নয়৷ আমাদের দেশেও ইতিহাসের সব পর্যায়ে মানুষ এ রকম ছিল না৷ নেতৃত্বও এমন ছিল না৷ ইতিহাসের ধারায় অনেক উত্থান-পতন পার হয়ে আমরা এই অবস্থায় পড়েছি৷ প্রকৃতির বিকাশধারা ও মানবজাতির ইতিহাস ল করলে দেখা যায়, মানুষ শুধুই প্রাকৃতিক নিয়মের, সামাজিক প্রথা-পদ্ধতির ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের শৃক্সখলে বাঁধা অবস্থার দাস নয়, প্রবৃত্তির দাসও মানুষ নয়৷ নিজের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির সদ্ব্যবহার দ্বারা সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে সম্মিলিত চেষ্টায় মানুষ হয়ে উঠতে পারে অবস্থার প্রভুও৷ আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে আমরা অবস্থার প্রভু হয়ে উঠতে পারব৷ মানুষের মধ্যে দুঃখ, বঞ্চনা, ভয়, ঘৃণা ও অশান্তি সৃষ্টির শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে সমপ্রীতিময়, সুখকর, আশাপ্রদ, সমৃদ্ধ, সুন্দর অবস্থা সৃষ্টির শক্তিও৷ শুভকর শক্তিটিকে আজো ভালো করে কাজে লাগানো হয়নি৷ তবে যেটুকু হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় এক উন্নত পৃথিবীতে জীবন ও পরিবেশ কত সুন্দর হতে পারে৷ মানুষ যদি সম্মিলিতভাবে মানবীয় গুণাবলিকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে, সেই সঙ্গে পরিবেশকে উন্নত করতে সচেষ্ট হয় তাহলে মানুষ এমন এক উচ্চতায় পেঁৗছবে যা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারি না৷ দারিদ্র্য, ভয়, রোগ-শোক, অন্যায়, অপ্রেম ও নিষ্ঠুরতা লোপ পাবে, এবং আশা ও সাহস আর সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতিশীলতা অবসান ঘটাবে অন্ধকার রাত্রির৷ একা একলা নিঃসঙ্গ মানুষ দুর্বল, অসহায়, অপূর্ণ৷ নিঃসঙ্গ, দুর্বল, অসহায় ও অপূর্ণ থাকা অন্যায়৷ সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ও সংগঠিত হওয়া মানুষের কর্তব্য৷ মানুষ এক প্রজন্মে যা পারে না, প্রজন্মের পর প্রজন্মের চেষ্টায় তা পারে৷ সাফল্যের মর্মে থাকে সঙ্কল্প ও সক্সঘশক্তি, সাধনা ও সংগ্রাম৷ উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত এসব আমাদের ছিল; কিন্তু এখন নেই৷ তখনকার মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফলে জাতীয় ও সামাজিক জীবনে আমাদের কিছু মহান অর্জন ছিল৷ কিন্তু সেই অর্জনগুলোকে পর্যন্ত আমরা রা করতে পারিনি৷ রাজনীতির অঙ্গনে আদর্শ ও কর্মসূচি ভিত্তিক দল গঠন না করা, কোনো প্রগতিশীল সাংগঠনিক শক্তি গড়ে না তোলা, রাজনীতিতে নীতিহীন, আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, হীন-স্বার্থেন্বেষী, দলছুট নেতাদের আর আমলা-ব্যবসায়ী-এনজিওপতি ও সেনাপতিদের প্রাধান্য বিস্তার এবং রাজনীতিকে একদফা-ভিত্তিক নিরেট মতার লড়াইয়ে পর্যবসিত করা, টেলিভিশন ইন্টারনেট ইত্যাদি অতু্যন্নত প্রযুক্তিকে গণবিরোধী কাজে ব্যবহার করা, সর্বোপরি রাষ্ট্রের একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীদের ডেকে আনা ইত্যাদির ফলে আত্মশক্তি হারিয়ে রাজনৈতিকভাবে আমরা হয়ে পড়েছি নিঃস্ব, নির্জীব ও অপশক্তিকবলিত৷ প্রিয় দেশবাসী! দেশি ও বিদেশি অপশক্তিকে পরাজিত করার এবং উন্নত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে আমাদের দরকার নতুন ইচ্ছাশক্তি ও সঙ্কল্প, নতুন কর্মসূচি ও কর্মনীতি, নতুন চিন্তা-ভাবনা ও নেতৃত্ব, নতুন সাধনা ও সংগ্রাম৷ আমাদের শক্তি আছে, কিন্তু শক্তিকে কাজে লাগাবার মতো সংগঠন নেই৷ দেশে সম্পদ আছে, কিন্তু প্রতিকূল সরকারের কারণে সম্পদের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না৷ এ অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নত অবস্থা প্রবর্তনের জন্য জাতীয় জীবনে আজ দরকার নবনির্মাণের কর্মসূচি ও কর্মনীতি৷ কর্মসূচি ও কর্মনীতি হল আমরা কী করব এবং কীভাবে করব, তারই নির্দেশ _ নিজেদের জন্য নিজেদেরই তৈরি করা নির্দেশ৷ কর্মসূচি ও কর্মনীতি অবলম্বন করে গড়ে তুলতে হবে সংগঠন, আন্দোলন, নেতৃত্ব ও সম্ভবপর সর্ববৃহত্ গণঐক্য৷ গণআন্দেলনের মধ্য দিয়ে তৈরি করতে হবে জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার ও গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্ত৷ বাংলাদেশে আজ দরকার এমন এক কর্মসূচি ও কর্মধারা যা হয়ে উঠবে আমাদের জাতীয় ল এবং সর্বসাধারণের মনে জাগাবে নতুন আশা, সাহস ও কর্মস্পৃহা৷ আটাশ দফা প্রণয়ন ও প্রচারের মূলে কাজ করেছে আমাদের এই উপলব্ধি৷ এই ইশতিহারের মর্মে আছে বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির এবং বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল, শক্তিমান, সমৃদ্ধিমান গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার স্বতোত্‍সারিত তাগিদ৷ গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্র কায়েম হলে তাতে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত নির্বিশেষে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকলেরই উন্নত জীবনের এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক সম্পর্কের প্রকৃষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হবে৷ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অপব্যবস্থাকিষ্ট, দুর্বল ও রুগ্ন হওয়ার ফলে আমাদের সকলের জীবনই বিপর্যস্ত৷ বাস্তবে প্রতিটি সমস্যাই অন্য অনেক সমস্যার সঙ্গে জড়িত এবং প্রতিটি সমস্যার রূপ অত্যন্ত জটিল৷ সরকারের কেন্দ্রীয় পরিচালনা ছাড়া আলাদা-আলাদাভাবে কোনো সমস্যারই পর্যাপ্ত সমাধান সম্ভব নয়৷ সমাজের প্রতিটি অঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত কাজের যেমন দরকার আছে, তেমনি দরকার আছে গোটা জাতির সকল সমস্যা ও সম্ভাবনাকে একসঙ্গে নিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ জাতীয় পরিকল্পনা অবলম্বনের ও কেন্দ্রীয় পরিচালনারও৷ কার্যেেত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন আর কেন্দ্রীয় পরিচালনা ও সামঞ্জস্য_কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ আটাশ দফায় আমাদের সঙ্কট, সম্ভাবনা ও করণীয় বিষয়াবলির একটি রূপরেখা মাত্র প্রদান করা হচ্ছে৷ যিনি যে বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, যিনি যে বিষয় জানেন, যিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সে বিষয়ে মত প্রকাশে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনমত গঠনে ও সক্সঘশক্তি সৃষ্টিতে প্রয়াসপর হতে হবে৷ আমাদেরকে আমাদেরই উন্নত করতে হবে৷ সর্বজনীন কল্যাণে সকলকেই ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে৷ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সাংগঠনিক কাজ এমনভাবে করতে হবে যাতে গভীর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জাতির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়৷ আমরা নিজেরা সক্রিয় হয়ে আমাদের অবস্থা উন্নত না করলে কেউ আমাদের অবস্থা উন্নত করে দেবে না৷ আটাশ দফায় আমাদের চেষ্টা, আমাদের জাতীয় মুক্তি_ বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার এবং প্রত্যেক নাগরিকের সার্বিক উন্নতির সম্ভবপর শ্রেষ্ঠ উপায় নির্ণয় করা৷ এতে আরো অনেক বিষয় যোগ করার সুযোগ আছে, প্রয়োজনও আছে৷ তাছাড়া প্রতিটি বিষয় নিয়েই আরো বিস্তৃত ও গভীর আলোচনা-সমালোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দরকার৷ নানাভাবে তা করতে হবে৷ একের কাজ নয়, সকলে মিলে করতে হবে৷ প্রিয় দেশবাসী! আটাশ দফার শেষ কয়েকটি দফায় এর বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে কিছু কথা আছে৷ সকলেই অনুভব করবেন যে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য গণবিরোধী রাজনীতি ও গণবিরোধী নেতৃত্বের জায়গায় জনগণের রাজনীতি ও জনগণের নেতৃত্ব (ষবধফবত্‍ংযরঢ় ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ত্ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব) অপরিহার্য৷ আসুন আমরা সকলে মিলে সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করি৷ এদেশের মানুষ, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, জমিদারতন্ত্র-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভু্যত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তা করেছিল৷ আটাশ দফা বাস্তবায়িত করতে হবে জনগণের সরকার (মড়াবত্‍হসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ত্ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব) প্রতিষ্ঠা করে৷ তার জন্য অবশ্যই গঠন করতে হবে এমন রাজনৈতিক দল যে-দল অর্জন করবে সরকার গঠনের এবং গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্র গড়ে তোলার ও পরিচালনার যোগ্যতা৷ প্রিয় দেশবাসী! জাতীয় জীবনের সকল উন্নতির মূলে কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক উন্নতি৷ সকল কাজের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনো জাতির বিশৃক্সখল রাজনৈতিক জীবনে কার্যকর প্রগতিশীল সুশৃক্সখল রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন করা৷ সেই কঠিন কাজে আমাদের সফল হতে হবে৷ যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা (১৯৫৪), আওয়ামী লীগের ছয় দফা (১৯৬৬), ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা (১৯৬৯) আর বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় প্রণয়ন করা হয়েছে এই আটাশ দফা৷ আজকের বাস্তবতা ভিন্ন৷ সেই ভিন্নতার দিকে ল রাখা হয়েছে৷ অতীতের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচু্যতি অতিক্রম করে আমাদের পেঁৗছতে হবে বৃহত্তর ও মহত্তর সাফল্যে৷ আসুন আটাশ দফা অবলম্বন করে আমরা বাংলাদেশে জনগণের সম্ভবপর বৃহত্তম ঐক্যের, সম্মিলিত সঙ্কল্প ও সক্সঘশক্তির, অবিচল সাধনা ও অপরাজেয় সংগ্রামের সূচনা করি৷ আটাশ দফা নিয়ে জনগণের সংগ্রাম সূচিত হলে এবং মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হলে ১৯৫০-এর দশকের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশ দফা আন্দোলন, ১৯৬০-এর দশকের ছয় দফা ও এগারো দফা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভু্যত্থান ইত্যাদির মতো ঐতিহাসিক ঘটনা অবশ্যই ঘটবে৷ তবে এখনকার ভিন্ন বাস্তবতায় আন্দোলনের রূপ ও প্রকৃতি ভিন্ন হবে৷ শান্তিপূর্ণ উপায়ে ল অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে হবে৷ আটাশ দফার বাস্তবায়ন আমাদের প্রথম গন্তব্য, এতেই আমাদের অভিযাত্রা শেষ হবে না, সর্বজনীন কল্যাণের ব্রত নিয়ে আমরা এগিয়ে চলব একের পর এক নতুন নতুন গন্তব্য নির্ধারণ করে৷ আটাশ দফা সম্পর্কে সকল মহল থেকে মতামত আশা করি৷ মূল বক্তব্যের সঙ্গে প্রাপ্ত মতামত সমন্বিত করে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ও জনগণের সংগ্রামী ভূমিকার উপর নির্ভর করে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা হবে৷ যুগে যুগে দেশে দেশে তরুণরাই প্রগতির সংগ্রামে অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে৷ আমাদের দেশেও আধুনিক যুগের ইতিহাসে যেমন, গোটা ইতিহাসেও তেমনি যুবশক্তিই পালন করেছে অগ্রযাত্রীর ভূমিকা৷ আজকের দুর্দিনেও যুবশক্তি অবশ্যই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে পিছিয়ে থাকবে না৷ যুবশক্তির সঙ্গে যুক্ত হবে সারা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষ৷ হাজারো বিভ্রান্তির মধ্যেও পৃথিবীর দেশে দেশে উন্নত নতুন ভবিষ্যত সৃষ্টির জন্য জনগণের সংগ্রাম চলছে৷ অপশক্তি যত প্রবলই হোক, জনগণের সংগ্রাম থেমে নেই৷ জনগণের উন্নত নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের শর্তও তৈরি হচ্ছে৷ ইতিহাসের গতিধারা ল করে আমরা বিশ্বাস করি, উত্‍পাদনশীল, সৃষ্টিশীল, প্রগতিপ্রয়াসী, মুক্তিকামী, সংগ্রামী জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী৷ নানা স্বার্থের আর নানা আদর্শের প্রতিযোগিতার মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক সংশ্লেষণের (ঃযবংরং-ধহঃর-ঃযবংরং-ংুহঃযবংরং) দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের গড়ে তুলতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্রের ও জনগণের বিশ্বব্যবস্থার আদর্শকে৷ মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি ১. জাতীয় উন্নতির আকাক্সা ও আত্মশক্তির অনুশীলন সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের ল েজনমনে জাতীয় উন্নতির আকাক্সা জাগাতে হবে এবং জনগণের মন থেকে জাতীয় হীনমন্যতাবোধ দূর করতে হবে৷ নতুন আশা-আকাক্সা দিয়ে জাতিকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে৷ এ উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সংগঠনের ভেতরে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত আত্মগঠনের অনুশীলন চালানো হবে, এবং দেশব্যাপী জনগণের মানসিকতা পরিবর্তনের ল েদীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করা হবে৷ জাতীয় হীনমন্যতাবোধ জাতির অন্তর্গত দুর্বলতা ও পারিপাশ্বর্িক বৈরী বাস্তবতাকে ভিত্তি করে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে৷ জাতির ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, শ্রমশক্তি ও সম্পদের সদ্ব্যবহার দ্বারা জাতির আত্মগত ও পারিপাশ্বর্িক অবস্থার উন্নতি সাধন করা যায়৷ যাঁরা নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন, তাঁরা নতুন সংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলবেন এবং এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নিয়ে কাজ করবেন৷ জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় সংস্কৃতির চর্চাকে এবং জাতীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার ও জনজীবনের সংগ্রামকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা জাতির আত্মবিশ্বাসের মানসভিত্তি রচনা করবেন৷ অতীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গির বদলে তাঁরা গ্রহণ করবেন ভবিষ্যতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি৷ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে তাঁরা গ্রহণ করবেন ইতিবাচক_গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি৷ জনগণের চিত্তোত্‍কর্ষ ও জাতীয় আত্মবিশ্বাসের জন্য শিতি তরুণদের বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের নানা বিষয়ের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ পড়তে উত্‍সাহিত করবেন৷ দেশের সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত রাখবেন৷ জাতির আত্মশক্তি বৃদ্ধির জন্য বাইরের জগত থেকে প্রয়োজনীয় ও সম্ভবপর চিন্তাগত ও বস্তুগত সবকিছু আহরণ করার মনোভাব গড়ে তুলবেন৷ সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিজ্ঞানসম্মত বহুত্ববাদী সমন্বয়ের (ঢ়ষঁত্‍ধষরংঃরপ ংুহঃযবংরং) দৃষ্টিভঙ্গি তাঁরা অবলম্বন করবেন৷ বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় মার্কিন 'আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি'-কে অন্ধভাবে মেনে চলার যে কর্মনীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা সর্বতোভাবে পরিহার করার জন্য জনগণের জীবন-জগতদৃষ্টিতে দরকার যুগান্তকারী পরিবর্তন৷ জাতীয় হীনমন্যতাবোধের মূলে কাজ করে সমাজে মানুষের মধ্যে সামাজিক আকর্ষণের (ংড়পরধষ ধভভরহরঃু) অভাব৷ সামাজিক আকর্ষণের অভাবে সমাজের সংহতি হ্রাস পায়_সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানাদিতে দেখা দেয় শিথিলতা, কেন্দ্রানুগতার অভাব, বিযুক্তি ও বিচ্ছিন্নতা (ধষরবহধঃরড়হ, বংঃত্‍ধহমবসবহঃ)৷ সাধারণত একে বলা হয় সামাজিক অবয়৷ এতে জাতীয় চেতনা দুর্বল হয়, জাতি দুর্বল হয়৷ এই অবস্থার মনোগত কারণের ভিত্তিতে রয়েছে বস্তুগত কারণ_বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণ৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই অবয়ের কাল দেখা দেয়৷ সে অবস্থায় জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়৷ আমাদেরও তাই করতে হবে৷ অধিকন্তু ব্যক্তির সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গুণাবলি বৃদ্ধির জন্য গ্রহণ করতে হবে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম৷ যে সরকার আমরা প্রতিষ্ঠা করব সেই সরকারের অর্থায়নে এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াসে একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি, বিআইডিএস, সিপিডি, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তার শাখা সমূহ, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ও তার শাখাসমূহ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ছায়ানট, উদীচী, চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, বিজ্ঞান গবেষণাগার, আণবিক শক্তি কমিশন, বিজ্ঞান জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ, পাবলিক লাইব্রেরি ও তার শাখাসমূহ, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর পরিচালিত সমিতি সমূহ, গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার ও তার শাখাসমূহ, পর্যটন কর্পোরেশন, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং অন্য সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি নিয়ে একযোগে কাজ আরম্ভ করলে স্বল্প সময়ে এই ল অর্জন করা যাবে৷ নতুন সরকারের আমলে নতুন জাতীয় প্রচারনীতি নিয়ে টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র সাময়িকপত্র ইত্যাদি প্রচারমাধ্যম একাজে ব্রতী হলে ল অর্জন সহজসাধ্য হবে৷ শিাব্যবস্থাকে অনুকূল রূপ দেওয়া হলে স্থায়ী সাফল্য অর্জন করা যাবে৷ সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করা হলে, জনগণের সরকার কায়েম করা হলে এবং সকল েেত্র প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন ও কেন্দ্রীয় পরিচালনার মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করা হলে সবই সম্ভব হবে৷ কিন্তু এই সবকিছুই এখন প্রতিকূল৷ বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় মনুষ্যত্ব নিষ্ক্রিয়, বর্বরতা সক্রিয়৷ নতুন সরকারের মূল ল হবে পরিবেশকে মনুষ্যত্বের অনুকূলে রূপান্তরিত করা৷ ২. দুনর্ীতি ও সহিংসতা : নৈতিক চেতনা ও সামাজিক ন্যায়বিচার দুর্নীতি ও সহিংসতা দূর করার জন্য এসবের মূল কারণ যতটা সম্ভব দূূর করা হবে৷ সরকারি সকল সংস্থায়, বিভাগে ও প্রতিষ্ঠানে বিধি-বিধান পরিবর্তন করে সুব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে এবং পর্যায়ক্রমে সামাজিক ন্যায়বিচার বাড়ানো হবে৷ ন্যায়নীতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত প্রগতিশীল ধারণা বিকশিত করে এবং নতুন আইন প্রবর্তন করে সুস্থ, স্বাভাবিক, নতুন ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম চালানো হবে৷ ন্যায়বিচার বাড়িয়ে সামাজব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে যাতে মানুষের নৈতিক চেতনা সু্স্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে৷ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক েেত্র বিরাজমান সীমাহীন অন্যায় (রহলঁংঃরপব) ও সার্বিক অপব্যবস্থাই দুর্নীতি ও সহিংসতার মূল কারণ৷ শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দ্বারা দুর্নীতি দমনের চেষ্টায় কোনো সুফল হচ্ছে না৷ দুর্নীতি ও সহিংসতা যতটা সম্ভব দূর করার জন্য আটাশ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন অপরিহার্য৷ বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের কেন্দ্রীয় তাড়না ব্যক্তিপর্যায়ে অধিক থেকে অধিকতর সম্পত্তি ও মতার মালিক হওয়া৷ এ-ব্যবস্থা মানুষের সামাজিক গুণাবলি বিকাশের পরিপন্থী৷ টাকা এ-সমাজে এতই শক্তিশালী যে, টাকার সামনে মহত্তম মানবিক গুণাবলিও অসহায়৷ সমাজে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে কেবল মানুষের তি করার শক্তিই শক্তি বলে স্বীকৃত _ কল্যাণ করার শক্তির কোনো স্বীকৃতি নেই৷ এ-সমাজে মানুষের নৈতিক চেতনা নির্জিত, বিকারপ্রাপ্ত, ীয়মান৷ 'সুবচন নির্বাসনে', 'সত্ মানুষের ভাত নেই', 'শয়তানের সাথে পারা যায় না', 'জোর যার মুল্লুক তার', 'মাত্‍স্যন্যায়' ইত্যাদি কথাকে লোকে নিতান্ত স্থূল অর্থে মেনে নিয়েছে৷ মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতা, আর 'নৈতিক বিবেচনা বর্জিত মুক্তবুদ্ধিচর্চা'-র এই বাস্তবতায়, একদিকে দেখা যায় সম্পদ ও মতার গতি একচেটিয়াকরণের দিকে_উচ্চশ্রেণিতে দেখা যায় সীমাহীন প্রাচুর্য, ভোগ-বিলাস, অপচয়, অপব্যয়, অনাচার, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, ভয়, উদ্বেগ-উত্‍কণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা; এবং অপরদিকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের বঞ্চনা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, কুশিা, অসহায়তা ও ভাগ্যনির্ভরতা৷ রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তরে স্তরে বিরাজ করছে দুবর্ৃত্তদের কর্তৃত্ব, জবরদস্তি ও শক্তিপ্রয়োগ৷ দুঃশীল লোকেরা প্রতিনিয়ত মানুষকে ঠকাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে৷ ধনী ও গরিবের বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে৷ বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা মূলত দুর্নীতি ও সহিংসতার অনুকূলে প্রবর্তিত আইন-কানুনের উপর প্রতিষ্ঠিত৷ অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া রূপেই দেখা দেয় সহিংসতা৷ শাসক শ্রেণির লোকদের অন্যায়_আবিচার ও শোষণ-পীড়নের প্রতিক্রিয়া রূপে সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠে সহিংস৷ অপব্যবস্থাকিষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত, সহিংসতাকবলিত সমাজে মানুষ উদ্বেগ-উত্‍কণ্ঠায় ভুগতে ভুগতে কর্মনৈপুণ্য ও কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলে, মানবিক গুণাবলিও হারাতে থাকে (ফবযঁসধহরুধঃরড়হ)৷ বাংলাদেশেও এটাই দেখা যাচ্ছে৷ এ অবস্থায়, শাসক শ্রেণির যে অংশ যখন মতায় থাকে সেই অংশ তখন নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতি ও সহিংসতা দমনের জন্য সুবিধামতো প্রচলিত বিধি-বিধানকে কাজে লাগানো, কঠোর থেকে কঠোরতর আইন জারি করা, পুলিশ-মিলিটারির কোনো কোনো বাহিনীকে সীমাহীন মতা দিয়ে কিন হার্ট অপারেশন, এন্কাউন্টার ও ক্রস ফায়ারের কথা বলে বিনা-বিচারে কথিত সন্ত্রাসীদের হত্যা করা, আদালত কারাগার ও ফাঁসিকাষ্ঠ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি চালিয়ে থাকে৷ শাসক শ্রেণির মতাসীন ও মতাবহির্ভূত উভয় অংশেরই কিছু লোক দুর্নীতি ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের বিভিন্ন চক্রে 'গড ফাদার' হিসেবে কাজ করছে৷ পুলিশ বিভাগ এবং বিচার বিভাগও এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷ প্রচলিত দণ্ডনীতি ও তার প্রয়োগ শাসক শ্রেণির নিরাপত্তা রায় সীমাবদ্ধ, সর্বজনীন কল্যাণের বিবেচনা এতে অল্পই আছে৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) পর অবাধ প্রতিযোগিতার মধ্যে পৃথিবী জুড়ে চলছে অপশক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের কাল৷ প্রায় সব রাষ্ট্রে অপশক্তির মোকাবিলায় মানুষ অসহায়৷ মানুষের মধ্যে আগের আদর্শবোধ ও নৈতিক চেতনা আর নেই৷ সাধারণ মানুষ সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ নয়৷ এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের থাবা বিস্তার করে আছে আজকের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি মার্কিন যুদ্ধবাজ পরাশক্তির একান্ত অনুগত৷ কোনো কোনো গোষ্ঠী দুর্নীতি নিয়ে ব্যবসা করছে৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে 'পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ' বলে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত যে প্রচার চালায়, তা কি আদৌ দুর্নীতি দূর করার সহায়ক? অপব্যবস্থার মধ্যে ন্যায়নীতি ও সুব্যবস্থার ল ছাড়া কেবল দুর্নীতিবিরোধী প্রচার চালালে তাতে এক দল দুর্নীতিবাজের স্থলাভিষিক্ত হয় আর এক দল দুর্নীতিবাজ, আর জনগণ হয়ে পড়ে দুনর্ীতিবাজদের হাতে জিম্মি এবং নৈরাশ্যবাদী৷ অপব্যবস্থা বহাল রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির বিরুদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।