আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্ট্রাল জেল - সেল নম্বর একশ আটাশ

বন্ধ চোখে মুহূর্তটা ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, স্বপ্নগুলো নির্মম বাস্তবতা ছাড়া কিছু নয়। চূর্ণ ধুলিকণা, সবই যেন চূর্ণ ধুলিকণা।

মাঝরাতে আবারো হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আধঘণ্টা পরপর ঘুম ভাঙ্গাটা আজকাল এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। আগে যেকোন যায়গায় যেকোন ভাবে ঘুমিয়ে যেতে পারতাম, আবার টানা একসপ্তাহ না ঘুমিয়েও কাটাতে পারতাম।

কিন্তু ইদানিং এই ঘুম নিয়ে এক বিশেষ যন্ত্রণার মধ্যে আছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে করারও কিছু নেই। প্রথম দিকে ঘুম ভাঙ্গলে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে উইপোকায় কাটা বইগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতাম। ইদানিং তাও ভালো লাগেনা। তবে বইগুলো দেখে তাদের সত্যিকার বয়স অনুমান করা কঠিন।

যে কেউ বইগুলো এক পলক দেখেই বলে দেবে কমপক্ষে দশ বছর পুরোনো। কিন্তু গত মাসের শুরুর দিকে বইগুলো কিনেছিলাম। উইপোকাদের আসলে কোন বাছবিচার নেই, নতুন-পুরোনো সব বইয়ের মূল্যই তাদের কাছে সমান। ঘুম নিয়ে এই সমস্যাটা আসলে খুব বেশি পুরানো না। বছর দুয়েক ধরে এই ঝামেলায় ভুগছি ।

সমস্যার উৎপত্তি সেন্ট্রাল জেলের একশ আটাশ নম্বর সেলে। জেলে থাকার সময় প্রতি বিশ-পঁচিশ মিনিট পরপর হয় মশার কামড়ে নয়ত ছাড়পোকার কামড়ে ঘুম ভেঙ্গে যেত। সেই ঘুম ভাঙ্গা এখন রীতিমত একটা অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। মানুষ আসলেই বড় বিচিত্র, যার উত্তম দৃষ্টান্ত আমি। কত অল্প সময়ে এই নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছি।

এই সেদিনও তো আমি বইপত্র নিয়ে নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে যেতাম, নিয়মিত ক্লাস করতাম, স্যারদের লেকচার নিয়মিত নোট করতাম খাতায়। খুব ভালো স্টুডেন্ট হয়ত আমি কখনোই ছিলাম না, তবে ক্লাসে নিয়মিত, ভদ্র ও শান্ত ছেলে হিসেবে আমার পরিচিতি ছিল। একটা ব্যাপার নিয়ে আমি গর্ব করতেই পারি - আমি নিজে কোনদিন ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট না হলেও লোপা প্রতিবার আমার করা নোট মুখস্ত করেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। আর্থিকভাবে আমি কোনদিনই সচ্ছল ছিলাম না। আর তাই সুমন, রাহাতদের মত দামী বাইকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুড়ে বেড়াতেও পারি নি।

তবে আমার ওদের দেখে খুব হিংসা হত। যদি আমার হাতে টাকা থাকত, তবে হয়ত আমিও কোনদিন লোপাকে বলে ফেলতে পারতাম যে আমি ওকে কত ভালবাসি, ও হয়ত বা আমার বুকে মাথা রেখে শুনতে পেত আমার হৃদকম্পন। আমি জানি ও আমাকে কত ভালবাসে, কিন্তু আমার আর ওর সামাজিক আর অর্থনৈতিক ব্যবধানের সামনে এই ভালবাসা খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। ব্যাপারটা আসলে খুব অবাককর - আমরা বুঝি আমাদের দুজনের মধ্যে কত পার্থক্য, কিন্তু মন বোঝে না। মাঝেমাঝে সত্যিই হাসি পায় এসব চিন্তা করলে।

বাড়ি থেকে মাসে হাজার দেড়েক টাকা পাঠাত মা। আর কোনমতে একটা টিউশনি ম্যানেজ করতে পেরেছিলাম বলে মোটামুটিভাবে মাস চলে যেত। তবে ইউনিভার্সিটির হল যেন ছিল ঠিক একটা ছোটখাট জাহান্নাম। শীতের রাতে হলের পলিটিশিয়ান বড় ভাইদের জন্য সাইন্স ল্যাব মোড়ের গ্যালাক্সি থেকে বিদেশি মদ কিনে আনতে আমার মোটেও ভালো লাগত না, কড়া রোদের মধ্যে দূর্নীতিবাজ লুটেরা সব পলিটিশিয়ানদের পক্ষে চিৎকার করার সময় তৃষ্ণায় গলা ফেটে যেত। তবে এসব নিয়ে কোনদিনই কোন প্রতিবাদ করার সাহস পাই নি।

কারণ এই বড় ভাইদের বিরোধিতা মানেই পরদিন ভোরে হল ছেড়ে চলে যাবার আগাম টিকেট কাটা। আর হল ছেড়ে চলে যাওয়া মানে আমার সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া, মায়ের সারাজীবনের সকল কষ্ট বৃথা হয়ে যাওয়া। এই কটা টাকা দিয়ে হলে থাকা ছাড়া ঢাকার মাঝে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই মন থেকে কোনদিন মেনে নিতে না পারলেও দূর্নীতিবাজদের পক্ষে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়েছি, প্রতি রাতে দেশী বিদেশি বোতল বোতল মদ কালো ব্যাগে করে বয়ে নিয়ে এসেছি। এসবের মধ্যেও মোটামুটি সুন্দরভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন।

একটু অবসর পেলেই বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে যেতাম, আর বিকেলে চলে যেতাম ক্লাস থ্রির বাচ্চা মেয়েটাকে পড়াতে। ফাইনাল পরীক্ষার দুইমাস আগে শুরু হল ইলেকশন। ইলেকশনের দুইদিন পর হঠাৎ করেই বাইক আর হকস্টিক নিয়ে শ'কয়েক লোক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে এল হলের সামনে। তারপর হলের মধ্যে যাকে যেখানে পেল মেরে বের করে দিতে থাকল। পাশের রুমের সোহান ভাইকে দুই তলা থেকে কজন মিলে ছুঁড়ে ফেলে দিল ওরা।

জানিনা সোহান ভাই কোথায় কেমন আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে। তবে সোহান ভাইকে আমার খুব মনে পড়ে। যখন অনেক পড়েও কোন কিছু বুঝতে পারতাম না, তখন সোহান ভাইই ছিল আমার একমাত্র ভরসা। ওরা আমার রুমে ঢুকে আমাকেও কলার ধরে কয়েকটা থাপ্পর মারল, বের করে দিল হল থেকে। হলের কিছু দূরে শিরিশ গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মাথা জুড়ে ঘুরপাক হাজার রাজ্যের চিন্তা - বাকী মাস কিভাবে কাটাবো, কোথায় থাকব। টিউসনির টাকাটাও রূমে। হঠাৎ মায়ের কোমল অসুস্থ মুখটার কথা মনে পড়তেই চোখ দুটো পানিতে ভিজে গেল। একদল পুলিশ এলো হলের সামনে। কেন যেন মনের ভেতর একটু হলেও আশার আলো জেগেছিল।

আর তাইপুলিশের পেছন পেছন হলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হলের সেই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীগুলি পুলিশের সাথে এমনভাবে হেসে হেসে কথা বলছিল যেন তারা বহুদিনের চেনা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদ্ঘুটে সন্ত্রাসীদের কয়েকজন আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো এবং একটু পরই পুলিশ অ্যারেস্ট করল আমাকে। সেই থেকে আমার বাড়িঘর সেন্ট্রাল জেল - একশ আটাশ নম্বর সেল। আমি আজও জানি না কি আমার দোষ, কি কারণে আমি টানা দেড় বছর জেলে মশা আর ছাড়পোকার কামড় খেয়েছি, বাস করেছি ইঁদুর আর বেজীগুলোর সাথে।

জেলে ভালোই সময় কাটত হাজতীদের সাথে কথা বলে আর তাদের জীবনের আনন্দের আর দুঃখের ভাগীদার হতে পেরে। কিন্তু রাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে যেত, তখন মনে পড়ত মার অসুস্থ মুখটার কথা, মনে পড়ত আমাকে নিয়ে মার সেই হাজারো স্বপ্নের কথা,মনে পড়ত লোপার সেই পরীর মতন নিষ্পাপ চেহারার কথা। আমি ধরে নিয়েছিলাম আমার জেলে থাকার খবর হয়ত কেউ কোনদিন জানবে না, কেউ কোনদিন আমাকে নিয়ে যেতে আসবে না। যতদিনে জেল থেকে বের হব, ততদিনে হয়ত লোপার বিয়ে হয়ে যাবে, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করবে। হয়ত অসুস্থ মা আর বেঁচে থাকবে না - কোনদিন সত্য হবে না আমাকে নিয়ে মায়ের দেখা স্বপ্নগুলো।

দেড় বছর পর হঠাৎ একদিন লোপা জেলে আমাকে দেখতে আসল। আমি লোপাকে দেখে যতটুকে অবাক হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি লজ্জিত হয়েছিলাম । লোপা বলেছে দাড়ি-গোঁফের জংগলের মাঝে আমার ছোট্ট সেই মুখটাকে নাকি ও কখনো ভুলবে না। জানিনা লোপা কিভাবে খবর পেয়েছিল, জানিনা কেনই বা আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিল। ছাড়িয়ে না আনলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি মার মৃত্যুর খবরটা পেতাম না, হয়ত আধঘণ্টা পরপর ঘুম ভেঙ্গে যেত না, মার স্মৃতি মনে পড়ে কান্না পেত না।

আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার রূপালী আলো আসছে। জ্যোৎস্নার রুপালী আলো লোপার মুখে পড়ে ঝলমল করছে। দেড় বছর ধরে প্রতি রাতে লোপার পাশে শুয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি লোপার মুখে জ্যোৎস্নার এই অবিরাম রূপালী খেলা, তবুও কেন যেন প্রতি রাতেই দেখতে ইচ্ছে করে, কখনো পুরোনো হয় না। আবীর হাসানোভিক (১৪/০২/২০১১)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.