‘বিশ টিন কেরোসিন’ সংক্রান্ত একটি ভুলের কারনে নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন হয়ে ময়মনসিংহ হয়। মোগল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তাঁর নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন। সেই রাজ্যের নাম রাখা হয় নাসিরাবাদ। বৃটিশ আমলে বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল বর্জনলাল এন্ড কোম্পানীর পক্ষ থেকে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে।
এই মাল বঙ্গের নাসিরাবাদে না পৌছে চলে যায় রাজপুতনার নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ আর লাঞ্চনা পোহাতে হয় রেল কর্তাদের। বিভ্রান্তি এড়াতে রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখা হয়। সেই থেকে নাসিরাবাদের পরিবর্তে ময়মনসিংহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রাজস্ব আদায় এবং স্থানীয় বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে ১৭৮৭ সালের ১ মে ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহ জেলা গঠন করা হয়।
বর্জনলাল এন্ড কোম্পানীর ২০ টিন কেরোসিনের মতো আমরা ভুল জায়গায় যাইনি। বাংলাদেশ রেলওয়ে আমাদের যথাস্থানেই প্রসব করে তার গন্তব্যে চলে যায়। ঢাকা থেকে আমরা যখন ময়মনসিংহ পৌছি তখন বিকাল প্রায় ৪টা। দুপুরের খাওয়ার খেয়েই আমরা রওনা দেই রাতের থাকার জন্য হোটেল বুক দিতে। হেরা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি হোটেলে রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়।
চমৎকার ও ছিমছাম হোটেল। আমরা সঙ্গী সাথীরা প্রস্তুত নিচ্ছে। যাত্রা শুরু করবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পৌছি তখন প্রায় সন্ধ্যা। সাধারনতঃ বোটানিক্যাল গার্ডেন বা পার্কে গেলে দেখা যায় জোড়ায় জোড়ায় সখা-সখি বসে থাকে।
তাদের আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি একা হাটছি তোরা কেন জোড়ায় জোড়ায় হাটবি? তাদের একে অপরের গায়ে গড়াগড়িকে বেহায়া বেহেল্লাপনা মনে হয়। মন চায় ছেলেগুলোকে কষে দুটো চড় দেই। থাপ্পড় দিয়ে বলি, যা ব্যাটা মসজিদে যা। নামাজ কলেমা পড়।
এখানে সখাসখীর চখাচখি কম। একাকী তরুনীর সংখ্যা বেশী। আমার হৃদয়ে আনন্দ নেচে উঠল। আমার এতটুকু আশা হলেও এখানে আছে। কিন্তু আমার সঙ্গী সাথীদের মন খারাপ।
ক্যামেরায় আলো পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ছবি উঠছে কালো-কালো। আমি ছাড়া সবারই ফটোজেনিক চেহারা, ফটোজেনিক রঙ। গায়ের রং কালো হওয়ায় আমাকে ছবিতে খুজেই পাওয়া যাচ্ছে না। তবু আমি খুব খুশি।
ছবিতে অন্ধকারে আমার আর তাদের গায়ের রং প্রায় সমান হয়ে গেছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকে হাসছি।
সিদ্ধান্ত হলো কাল আবার আসব। আলোতে ছবি তুলব। এখন ব্রক্ষ্মপুত্রে চলো।
ওখানে চমৎকার বাতাস। নৌকায় উঠে সবার মাথার তার সবগুলো ছিঁড়ে গেছে। নদীতে কোমর সমান পানি। মাঝে মাঝে হাটু পানি। ঝিনুক, শ্যাওলা, বালি দেখা যাচ্ছে।
খুব ভালো লাগছে। এত ভালো লাগা রাখি কোথায়। আমাদের মাঝে একজন কিছুক্ষন পর পর চিৎকার করছে, আল্লারে এত বালা লাগের কিল্লাই ? মরি যামু। আঁই বাইচতান ন। (এত ভালো লাগছে কেন।
আমি মারা যাব। আমি বাঁচব না)। নদী পার হয়ে জেগে উঠা চরে শুরু হল চিৎকার, নাচ, গান আর আনন্দ পাগলামী। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যথেষ্ট মজা পাচ্ছে।
কয়েকজন এসে আমাদের সাথে শরীক হলো। তারা চিৎকার করে গাইছে, মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে ......।
হোটেলে ফিরে পরদিনের পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য আলোচনা শুরু হলো। আমি দ্রুত আলোচনা শেষ করার চেষ্টায় আছি। রাত গভীর হলে আলোচনা ভেস্তে যাবে।
শুরু হবে নিশি আলাপ। তার আগেই সিদ্ধান্ত পৌছতে হবে। ইতি মধ্যে লাইভ ফোনো আপডেট শুরু হয়ে গেছে। “জানু, আমরা এখন হোটেলে আছি.... কাল সকালে কোথায় যাব তা নিয়ে আলোচনা করছি.... .. ...হ্যা খেয়েছি..... মাথা খারাপ.... এই ফাজিল... বোকা, এখানে সবাই আছে না ..... হুঁ ..... ”। একে সবাই সটকে পড়ছে।
আমি হতাশ হয়ে হোটেলের ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। এখানে নেট ব্রাউজিং ফ্রি। কাল কোথায় যাওয়া যায় তার একটা লিস্ট তৈরী করলাম।
মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ী, মহারাজা সূর্যকান্তের বাড়ী, শশী লজ, জয়নুল আবেদীন সংগ্রহ শালা, ব্রক্ষপুত্র পার্ক আনন্দ মোহন কলেজ। গৌরীপুর যেতে পারলে ভাল হতো।
ওখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে; গৌরীপুর লজ, গৌরীপুর রাজ বাড়ী, বীরঙ্গনা সখিনার মাজার, রাজা রামগোপাল জমিদার বাড়ী, চীনা মাটির ঢিলা ইত্যাদি।
২৬.০৩.২০১১। স্বাধীনতা দিবস। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল বাস স্ট্যান্ড হতে সিএনজি নিয়ে মুক্তাগাছা যাওয়ার পথে স্কুল মাঠে স্বাধীনতা উৎসব চোখে পড়ছে। কোন কোন মাঠে লোকজ খেলাধূলা হচ্ছে।
এগুলো দেখতে দেখতেই পৌছে গেলাম মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ী। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সকালের নাস্তা করা হয়নি। একটা হোটেলে ঢুকলাম নাস্তা সারতে। নাস্তা নাস্তা সারতে সারতে আসুন মুক্তাগাছার মহারাজ সূর্যকান্তের বাড়ী সম্পর্কে কিছুজ্ঞান নেওয়া যাক।
মহারাজা সূর্যকান্তের বাড়িটি এখন পরিত্যাক্ত। অপরিচর্যা আর অযতেœ শ্রীহীন। জীর্নশীর্ন বাড়িটি আগে থেকেই জানতো তার উত্তরাধিকার সংকটের কথা। কোন এক অপছায়া ভর করেছিল মুক্তাগাছার জমিদার রঘুনন্দন আচার্য এর পরিবারের উপর। সন্তানহীনতার অপছায়া।
জমিদার রঘুনন্দন এর কোন সন্তান না থাকায় তিনি দত্তক নেন গৌরীকান্তকে। গৌরীকান্তও নিঃসন্তান ছিলেন। ব্যাপক প্রার্থনা ও মানত করে স্রষ্টার কৃপায় একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। নাম রাখেন কাশীকান্ত। একমাত্র সন্তান কাশীকান্তও ছিলেন নিঃসন্তান।
তিনি ফরিদপুরের বাজিতপুর হতে দত্তক আনেন সূর্যকান্ত নামে এক শিশুকে। এই দত্তক শিশু সুর্যকান্ত মহারাজা সূর্যকান্ত নামে পরিচিতি পায়। আমরা এসেছি মহারাজ সূর্যকান্তর বাড়ীতে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মহারাজা সূর্যকান্তকেও নিঃসন্তান হওয়ার অপছায়া পিছু ছাড়েনি। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্রের নাম শশীকান্ত।
শশীকান্ত বাংলা ১১২০ সালে লর্ড রোনাল্ড কর্তৃক মহারাজা উপাধি পান। বর্তমানে মহারাজা সূর্যকান্তের বাড়ীর ভিতরের অংশ সরকারী শহীদ স্মৃতি কলেজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি অবস্থানেই রয়েছে জমিদার বাড়ী তথা আটানীবাড়ী। রাজা জগৎকিশোর এর দু ছেলে ভূপেন্দ্র ও জিতেন্দ্র ছিলেন সংস্কৃতি অনুরাগী মানুষ। তারা বাড়ীতে স্থাপন করেছিলেন উপমহাদেশের প্রথম ঘূর্নয়মান রঙ্গমঞ্চ।
যেখানে দেশী বিদেশী বাইঝিরা নৃত্য পরিবেশন করত। আমাদের সাথে গাইড তোতা পাখির মতো মুখস্ত বুলি আওড়াচ্ছে। ভগ্ন ও পরিত্যক্ত এ বাড়ীর ভিতরের কারুকার্য তার অভিজাত্য এখনো জানান দিচ্ছে নিজ গুনে। জমিদার বাড়ীতে বেশ কিছু ছবি তুলেই আমরা রওনা দিলাম মুক্তাগাছা বাজারে। মুক্তাগাছা থেকে চলে যাওয়ার আগে অবশ্যই মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়ে যেতে হবে।
গোপালের মন্ডা বিখ্যাত মন্ডা। ১৮২৪ সালে গোপাল পাল ছানা সদৃশ মন্ডা আবিষ্কার করেন। গোপালের মন্ডার দেশে বিদেশে ব্যাপক স্তুতি। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র রাধানাথ পাল বাবার ব্যবসা ধরেন। এরপর যথাক্রমে কেদারনাথ পাল, দ্বারিকানাথ পাল এবং বর্তমানে তাঁর পঞ্চম পুরুষ রমেন্দ্রনাথ পাল এই ব্যবসা দেখাশোনা করছেন।
তৈরী করে চলেছেন মুক্তাগাছার মুক্তা “মন্ডা’।
দুপুরে ময়মনসিংহ শহরে ফিরেই ছুটলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহ শালায়। বক্ষ্মপুত্র নদীর পাড়ে এটি অবস্থিত। সংগ্রহশালা থেকে বেরিয়ে পা দিলেই আপনার পা পড়বে ব্রক্ষ্মপুত্রে। এখানেই গড়ে উঠেছে পার্ক।
আনন্দমোহন ঘুরে দ্রুত ভ্যানে চড়ে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যেতে হবে। আমার মন আনচান করছে। সেখানে কিছু সুন্দরী একাকী ঘুরছে। এদিকে খিদেয় মাথা ঘুরছে।
সুন্দরী দর্শন এর পূর্বে অন্ন ভোজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহ শহরের খাবরের মান অন্য যে কোন শহরের খাওয়ারের তুলনায় বিস্বাদ ও মানহীন। তারপরও খেতে হল। কারন, জান বাঁচানো নাকি ফরজ।
ফরজ কাজ সেরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়।
নোয়াখাইল্যা মোতালেব ভাই আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে প্রীত। তিনি এখানে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেন। পাশাপাশি ছোট ভাইয়ের ব্যবসায়ে বসেন। একসময় এখানে নোয়াখালীর ও কুমিল্লার শিক্ষকের সংখ্যাই ছিল বেশী।
এখন অনেক কম। এ নিয়ে তার বুক ফাটা আফসোস। আমরা একজন দেশী ভাইকে হাতের কাছে পেয়ে খুশি হলাম। তিনি আমাদের আরো বেশী খুশি করার জন্য, আরো কয়েক জন দেশী ভাইকে ফোন করে নিয়ে আসলেন। আমরা আরো খুশি হলাম।
তিনি আমাদের আরো বেশী খুশি রাখতে চান। তিনি আবার ফোন হাতে নিলেন। মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ভাই বেরাদর আছে সবাইকে ফোন করা শুরু করেছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে নোয়াখালীর মিছিল শুরু হবে। আমাদের জন্য চা নাস্তা কলা নিয়ে আসা হলো।
সবাই আমাদের ঘিরে দাড়িয়েছে। কলা কেন খাচ্ছি না। বিস্কিট খাচ্ছি না। নানা প্রশ্নবানে আমরা জর্জরিত। সবাই বড়বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমরা আন্তরিকতার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে বোটানিক্যালে গার্ডেনে দিকে হাটা শুরু করলাম। আজ ছবি তোলার পর্যাপ্ত আলো পেলাম ঠিকই কিন্তু এখানে একাকী ললনার সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে কম। শুধু লাল টি-শার্ট পরা আমরা কয়েকজন যুবক একাকী হাটছি।
সন্ধ্যার কিছু আগে হৈ হৈ করে নেমে পড়লাম ব্রক্ষ্মপুত্রে। হাটুপানিতে লাফালাফি করছি, ঝিনুক খুঁজছি।
। ছোট মাছগুলোকে পুরো নদী দৌড়ে বেড়ালাম। বালির ঢিবি তৈরী করছি। আমাদের কেউ কেউ চিৎকার করে গান গাইছে। কয়েকজন উৎফুল্ল যুবক যুবতী নেমে পড়ল নদীতে।
শিপন আমাদের ছবি তুলছে। আমাদের আনন্দ দৃশ্যগুলো তার ক্যামেরায় চিরদিনের জন্য স্থায়ী করে রাখছে। শুধু সে-ই নয়। আমাদের আনন্দের রেশ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য ক্যামেরাগুলো ক্লিক ক্লিক শব্দে আমাদের আনন্দ নিজেদের ভেতর ধরে নিচ্ছে....।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।