রতনে বিলীন হাওর। বিল, জলাশয় আর নদী। কোথাও জাল ফেলার অধিকার কারও নেই। জলের মাছ ডাঙায় উঠলে যাবে একজনের পেটে। কিন্তু কখনও এর ব্যত্যয় হলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বেসামাল।
মামলা আর প্রাণনাশের হুমকিতে হতে হয় তটস্থ। প্রাণও দিতে হয় এজন্য। বিস্তীর্ণ হাওর জুড়ে আছে বাংলাদেশের বৃহত্তর বালুমহাল। তাতেও খবরদারি ওই একজনের। তার নামে সেলামি না দিলে বালুমহাল আর কয়লাঘাট থেকে এক ফুট কয়লা কিংবা বালু নেয়া যায় না।
তিনিই সেখানে মা-বাপ, হর্তা-কর্তা, সব কিছু। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী হলেও তিনি নিজের পরিচয়ের সময় বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার বলতে পছন্দ করেন। তার নাম ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তিনি হাওরের দেশ সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা) আসনের সরকারদলীয় এমপি। এলাকাবাসীর কাছে ‘ডিও লেটার এমপি’ নামে এখন বেশ পরিচিত।
চাকরির আবেদনে তার সুপারিশ নিতে গুনতে হয় লাখ টাকা। স্থানীয় নিয়োগে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা নেয়া হয়। তবে এমপি রতন নিজে প্রকাশ্যে কখনওই এসবে যান না। চাকরির তদবির সংক্রান্ত লেনদেন করেন তার পিএস ও দলীয় কিছু লোক। আর পুরো সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে আছে একটি সিন্ডিকেট।
এখানে আছেন সরকারদলীয় নেতাকর্মী এবং ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন চেয়ারম্যান। গড়ে উঠেছে পৃথক বাহিনীও। তারা বালুমহাল আর নদীপথ থেকে চাঁদা তোলার কাজ করে। তার হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা নিয়ে এলাকায় যেমন কৌতূহলের শেষ নেই তেমনি হাওরের ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা শঙ্কিত। তবে কেউই ভয়ে মুখ না খুলে সব কিছু নীরবে সয়ে যাচ্ছেন।
এসব নানা কারণে তাকে স্থানীয়দের অনেকেই হাওরের ‘ভবিষ্যৎ ওয়াটার লর্ড’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। সমপ্রতি সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে গেলে স্থানীয়দের কাছ থেকে এসব নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। হাওয়ায় ভর করে বেড়ায় তারা নানা কীর্তি। সাধারণ মানুষ ছাড়া অনেক জনপ্রতিনিধি রতনের দুর্নীতির কথা বলেছেন। তারা দুদককে তদন্ত করারও আহ্বান জানান।
তাদের অনেকে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তবে জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার (এমপি) দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আমিও শুনেছি। কবরস্থান দখল, মসজিদের টাকা লুটের অভিযোগ আমার কানেও এসেছে। তিনি এর সত্যতার ব্যাপারে কিছু বলতে না চাইলেও মন্তব্য করেন, যা রটে তা কিছুটা তো বটে। তার দাবি, জামালগঞ্জে উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ এলেও তার ৮০ ভাগও হয়নি।
সিংহভাগ লুটপাট হয়েছে। হাওরের নাম করে অনুদান এনে রাঘব বোয়ালরা পেট ভারি করেছে। তাই এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। জোট সরকারের সময়ে বিএনপি’র স্থানীয় এমপি নজির হোসেনও জলমহাল নিয়ে এমপি রতনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে শুনেছেন বলে জানান। তার দাবি, এমপির লোকজন দ্বারা জলমহাল-বালুমহাল দখলের অভিযোগ এলেও আগে এরকম ছিল না।
তিনি বলেন, এখন হাওরবাসী জলমহালের অধিকারটুকুও হারিয়েছে। গরিব মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া হয়েছে। জেলেরা পানিতে নামতে পারছে না। এটি তাদের জীবন-জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আমার সময় জলমহালগুলোতে স্থানীয় ও গরিব মানুষের অধিকার ছিল।
বিনা খাজনায় দেয়া ছাড়াও সীমানা নির্ধারণ করে দেই স্থানীয়দের- যাতে সবাই জলমহাল ভোগ করতে পারেন। সাবেক এই এমপি বলেন, আমার সময়ে অবৈধ ভোগের সুযোগ ছিল না। লিজেও কোন রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা হতো না। এমপি রতন অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা বলে দাবি করেন। বলেন, আমি অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই।
আমার জানা মতে, সুনামগঞ্জ ১-এ কোন চাঁদাবাজি নাই। জলমহালগুলো ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতিতেই ব্যবহার হচ্ছে। নীতিমালা অনুসরণ হচ্ছে কঠোরভাবে। তিনি দাবি করেন, বিএনপি আমলে চাঁদাবাজি হতো। আমি নির্বাচিত হয়ে তা বন্ধ করি।
সব উন্নয়ন কাজে এখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত রাখার চেষ্টা করছি। তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এমপি রতন তার নির্বাচনী এলাকার উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন কাজসহ বিভিন্ন কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। তিনটি উপজেলায় কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে সব দরপত্র প্রক্রিয়ার তদারক নিজেই করেন। তার পছন্দের ঠিকাদার আর দলীয় কর্মীরাই এলজিইডির সব কাজ পান।
সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশায় জলমহাল ৩২৭টি।
জামালগঞ্জ উপজেলায় সরকারি খাতার হিসাবে জলমহাল ৯৪টি। এর মধ্যে ২০ একরের বেশি জায়গা নিয়ে ৫২টি এবং এর কম জায়গায় আছে ৪২টি। তাহিরপুরে ৮১টি জলমহাল। এর মধ্যে ২০ একরের বেশি ৪৫টি, কম ৩৬টি। ধর্মপাশায় ১৫২টি জলমহালের মধ্যে ২০ একরের কম ৬৭টি আর বেশি ৮৫টি জলমহাল।
এর মধ্যে বেশির ভাগের লিজ নিয়েছেন এমপির পছন্দের লোকরা। যে কয়েকটির লিজ হয়নি এর সবগুলোই তার ঘনিষ্ঠজনের দখলে। সাধারণ মানুষ দূরে থাক, তার অনুগত ছাড়া আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মীও এসব ভোগ করতে পারছেন না। আবার বিল লিজ পাওয়ার পরও এমপির নির্দেশে তা বাতিলও করা হয়। জামালগঞ্জের হালির হাওরের ছাতিধরা বিল পেয়েছিল ইনসানপুর মৎস্যজীবী সমিতি।
কিন্তু অতি সমপ্রতি তার ঘনিষ্ঠজন শামসুল আলম ঝুনু সেটি দখল করেছে। তাহিরপুরে কানামুইয়া বিল পুরোটাই এমপির স্থানীয় ঘনিষ্ঠজনেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখানে ১৬-১৭টি মৎস্যজীবী সমিতির নাম ভাঙিয়ে হাওর ভোগ করা হচ্ছে। মাটিয়ান হাওরে লিজের চেয়ে ভোগের জলমহালই বেশি। বাটের টান শানদীঘি বিলের ২২ একরের একটি জলমহাল সমিতির নামে লিজ এনেছেন তার আস্থাভাজন আওয়ামী লীগ নেতা প্রভাত রায়।
তবে লিজ না এনেও তিনি পাশের ২৫০ একর জলমহাল ভোগ দখল করছেন। উপজেলা প্রশাসন ২২টি জলমহালের লিজের তথ্য দিতে পারলেও বাকিগুলো কে কিভাবে ভোগ করছে তা জানাতে পারেনি। ধর্মপাশার ধানকন্যা হাওরের কালাপানি বিল লিজ ছিল মোতালেব খানের নামে। কিন্তু বর্তমান এমপি নির্বাচিত হয়ে সেটির দখল নেন। নাইন্দা বান্দা বিল এমপির স্নেহধন্য নাদেল গত বছরই দখলে নেয়।
সমপ্রতি এটি স্থানীয়রা পেলেও তারা জলাশয়ে নামতে পারেনি। এর দখল নিয়ে গত ১৫ই অক্টোবর উভয়পক্ষের সংঘর্ষে ১ জেলে নিহত হয়। নাদেল শুধু এই বিল না, পাশের বিলও দখলে রেখেছে। জলমহাল নিয়ে অনেক দিন থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- যিনি এমপি তিনিই মালিক। সমিতি, স্থানিক কোন শর্তই কাজে আসবে না।
এর মালিকানা নিয়ে কোন আইনও চলে না। এমপি রতন ক্ষমতায় এসে অতীতের এমপি আর সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের মতো দখলে নেন সব। কোন কোনটির লিজ দেখানো হলেও অনেকগুলোই লিজ ছাড়া দখল করে ভোগ করছে তার অনুগতরা। এসব নিয়ন্ত্রণে নিজের নেতৃত্বে তিন উপজেলায় কয়েক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও অনুগত নেতাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। এদের সংখ্যা ৮ থেকে ১০।
স্থানীয় সূত্র জানায়, তাহিরপুরে এমপির সব কাজ দেখাশোনা করেন বাদাঘাট ইউপির চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন, আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন, ছাত্রলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম এবং যুবলীগের হাফিজ উদ্দিন। ধর্মপাশায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমাস আলমগীর এবং প্রচার সম্পাদক শামীম আহমদ বিলকিস। জামালগঞ্জে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেসবাহ উদ্দিন, সাচনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শামীম এবং আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ। তাদের মাধ্যমেই এমপি তার নির্বাচনী এলাকার জলমহাল, বালুমহাল, নদীপথ এবং কয়লাঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব এলাকা থেকে ওঠা চাঁদা ভাগবাটোয়ারা করেন তিনিই।
বালু মহালের ব্যবসা অন্যরা করলেও সেখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলে এমপির লোকেরা। প্রত্যেক উপজেলায় বিভিন্ন নদী পয়েন্টে চাঁদা তোলে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি টিম। জামালগঞ্জের বালু মহাল এবং রক্তিনদী রুটের মাসোহারা তোলে ১৫ সদস্যের দলটি। তিনটি উপজেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। বালুভর্তি নৌকা ও কার্গো থেকে চাঁদা তোলা হয় তিনটি জায়গায়।
এগুলো হচ্ছে তাহিরপুর বালুঘাটে, ধর্মপাশায় নদীপথে আসতে এবং জামালগঞ্জ বালু মহালে। চাঁদার নির্দিষ্ট পরিমাণ হচ্ছে সাধারণ নৌকা ১০০, ইঞ্জিনচালিত বড় ট্রলার ২০০ এবং কার্গো ৫০০ টাকা। চাঁদা তোলা শুরু হয় মূল বালুঘাট তাহিরপুরের বাংলাদেশ সীমান্তের লাউড়ের গড় এলাকা থেকে। আসামের মগদাকান্দির ১১টি খাল থেকে সৃষ্ট যাদুকাটা নদীতে বালু উত্তোলন হয়। সেখানে সরকারি রয়্যালিটি নৌকাপ্রতি ৫ টাকা।
কিন্তু ৫০ টাকার যে চাঁদা দিয়ে কোন নৌকাই বোঝাই করে ঘাট ছাড়তে পারে না। বালু উত্তোলনের পর সেখানে প্রথম দফায় চাঁদা দিয়ে আসার পর ধর্মপাশার আসামপুর ও মাজনাকান্দির মাঝামাঝি জায়গায় আবার চাঁদা দিতে হয়। অবশ্য এখানে চাঁদা তোলার ধরনটা ভিন্ন। নৌকাগুলো তীরে ভিড়তে হয় না। ৫০ টাকা পাথরে পেঁচিয়ে নদীর পারে ছুড়ে দেয়া হয়।
সেখানে অস্থায়ী চাঁদার টোল বসিয়ে তা সংগ্রহ করেন প্রতিনিধিরা। সব শেষে বালুমহালে কার্গো থেকে চাঁদা তোলা হয়। ব্যবসায়ীরাই কার্গোর কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেন। সন্ধ্যার পর সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি নৌকাযোগে তা নিয়ে আসেন। স্থানীয়দের দাবি, চাঁদার পরিমাণ বাড়ায় রীতিমতো বেকায়দায় ফাজিলপুর বালুমহালের ১৫ থেকে ২০,০০০ শ্রমিক।
তবে একটি সূত্র দাবি করে, রয়্যালিটির টাকা সরকারি কোষাগারে যায় না। ফলে অতীতে এখান থেকে মাসে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা রাজস্ব এলেও এখন তা আসছে না। সূত্র জানায়, বালুমহাল ও কয়লাঘাটের টাকা ভোগ হচ্ছে কৌশলে। ওয়াকফ এস্টেট ও দেবোত্তর সম্পত্তির কথা বলে তা কোষাগারে জমা না দিয়ে রেখে দেয়া হচ্ছে। এজন্য আদালতে একাধিক মামলায় হেরে পরে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে ওই খাতের নামে টাকা নিজেরা ভোগ করছে মহল বিশেষ।
চলতি নদী উন্মুক্ত করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করা হয়েছে মাছের অভয়াশ্রমের।
এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, এলাকায় আমার নাম ব্যবহার হতেই পারে। স্থানীয় এমপি হিসেবে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে যদি কেউ চাঁদাবাজি করে তবে এজন্য আমি দায়ী নই। আমার নাম ব্যবহার করলে এটা ষড়যন্ত্রমূলক হতে পারে।
আর জানিও না কেউ তা করছে কিনা। এসব ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। কোথাও কোন অনিয়ম হলে তারাই দেখবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।