শেষ বারের মতো সতর্ক করছি...
হাকালুকি হাওর দেখার খুব শখ ছিল। যাই যাচ্ছি করে হয়ে উঠে না। আমি রেডি তো অন্য বন্ধুরা রাজি না। তাদের চাকরি ব্যাবসা নানান সমস্যার শেষ হয় না। এই ফাঁকে শীত পালাল।
অতিথী পাখি দেখা হলনা। নানান জনের কাছ থেকে গল্প শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। বর্ষা তে একপার তার পাশ ঘেষে সিলেট গিয়েছি। একপলকে গাড়ি থেকে যে টুকু দেখাগেছে। কিছুই বুঝতে পারিনি।
নেটে সার্চ করেও তার সম্পর্কে খুব তথ্য কালেক্ট করা গেলনা। নানা ধরনের ব্লগ আছে তাতে ভ্রমন কাহিনিই প্রাধান্য পায়। হাকালুকি সম্পর্কে আর জানা হয়ে উঠেনা।
কুলাউড়া রেল স্টেশনে একবার দেখলাম কয়েকটা লেমেনেটিং বোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে, তাতে হাতকালুকি হাওরের নানা মাছ, পাখি, গাছ ইত্যাদি বৈচিত্রময় ছবি দেয়া। আগ্রহ আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলাম।
যেই করেই হোক একবার অন্তত হাকালুকি ঘুরে যেতেই হবে। দিন ঠিক করা হল। ০৮/০৩/১১ মঙ্গল বার তিনজন মিলে একটা এস এল আর ক্যামেরা নিয়ে রওনা দিলাম।
হাওরের কাছে গিয়ে লোক জনকে জিজ্ঞেস করি , হাওরটা কোনজায়গা থেকে দেখলে ভাল হবে? তারা আমাদের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন অন্যায় একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি। হাওর দেখার পর তাদের তাকানোটা যে যথার্থ ছিল তা বুঝতে পারি।
রাস্তা থেকে নেমেই হাটতে থাকি । সামনে যতই চোখ যায় সবুজ ধান ক্ষেত। হাটতে থাকি ধানক্ষেতের আল ধরে। চিকন আল, মোটা আল নানান ধরেনর আল ধরে হেলেদুলে হাটছি। হেলে দুলে বল্লাম কারনটা নিশ্চয় ধরতে পারছেন।
চিকন আল ধরে হাটা আর রেল লাইনের পাতের উপর দিয়ে হাটা একই কথা। তবে চাইলে বড় আল ধরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও হাটা সম্ভব। ধানক্ষেতে দেখতে দেখতে আমাদের পায়ের গতি বড়াতে থাকি। কারন আমাদের ধানা ছিল আল্প কিছু দুর গেলেই ঐপাড়ের গ্রাম চোখে পড়বে। কিন্তু হায়..।
বিশালতার পরিমাপটা এইবার বুঝতে আরাম্ভ করছি। এবার তো পথ হারাবার পালা। দাড়িয়ে কয়েকটা মোবাইল ফোনের টাওয়ার কে স্বাক্ষী রাখলাম। আমরা যে দিক দিয়ে এসেছি তার আশে পাশে। আমাদের একই জায়গায় আবার এসে সি এন জি ধরতে হবে।
এক জনের হাত থেকে ক্যামেরা হাত বদল হতে থাকে । সবুজ যেন আমাদের পাগল করে দিয়েছে। আমার মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকি। মনেমনে ভাবি এত বিশাল এলাকায় ধান চাষ হলে কি করে আমাদের দেশে ভাতের অভাব হয়??
এবার বড় রকমের একটা রাস্তা পেয়ে গেলাম। দেখে বুঝতে আসুবিধা হয় না যে রাস্তাটা নরম কাদামিটি দিয়েই তৈরি করা হয়েছিল এখন টনটনে শুকনো।
মাটিন উপর কোন চাকার ছাপ নাই । এই রাস্তা দিয়ে কখনো চাকা গাড়ায়নি। ইন্জিনের গাড়িতো দুরের কথা। আমরা কিছুদুর হাটি এই পথ ধরে। বার রাস্তার পাশেই একটা একটা ডোবা মাছ ধরা হচ্চে।
ডোবার পানি নাই যা আছে কেবল কাদা( নোয়াখালী শব্দে হবে " হ্যাঁক")। কাদার মধ্যে কম বয়সি ছেলের সংখ্যাই বেশি। ক্যামেরাটা তাদের দিকে ফেরাতেই সবাই দাড়িয়ে পরল। কয়েক জন বলতেই থাকল আমার ছবি উঠান। আমিও তাদের কথা মতো ছবি তুলতে থাকি।
ছবি উঠানেরা চেয়ে যে ব্যাপারটা ভাল লাগল তাদের আনন্দ। আমরা বাঙ্গালীরাই সম্ভবত সবচেয়ে কম পেয়েও খুশি হতে পারি। একটা ছবি উঠালাম তা হয়তো কোনদিন সে দেখতেও পাবে না। আমরাও তা যতন করে ধরে রাখবো না। তাতে কি? আনন্দ তো এত হিসাব নিকাষ করে হয় না।
কাদা মাখা মানুষের ছবি তুলে এবার সামনে যাবার পালা।
এবার আর রাস্তা ধরে নয় বড়া একটা আইল ধরেই হাটবো। অল্প দুরে যেতে না যেতেই মনে হলো পানি। আশ্চার্য পানিইতো এই জায়গাটায় এখনো অনেক পানি রয়েছে। বিলের মধ্যে পানি থাকবে এটা আবার আশ্চার্যের কি হল।
আমারও মনে হয় আশ্চার্যের কিছু নাই। কিন্তু হলাম।
ধানক্ষতের সবুজ ছিন্ন করে কখনো কখনো দেখা যেত পতিত জমি যেখানে চাষবাস নাই। মাটি ফেটে চৌচির। বিলের মাটি মনে হয় আল্প শুষ্কতায় ফেটে যায়।
এই ফাটা ফাটি মাটি দেখে তার পর পানির দেখা এই হল বিশ্বয়ের কারন।
যাই হোক পানি দেখে কাছে যাবার লোভ হল। একটু হাতটা আন্তত বিজিয়ে নেই। দুজন মুখ ধুয়ে নিলেন। হাকালুকি হাওরের পানিতে মুখ ধোয়া চারটি খানি কথা না।
আমরা কাছে যাওয়া সাদা বকেরা খুব খুশি হলনা। তারা আল্প দুরে গিয়ে বসে। আমি ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকি।
বেরসিক বকদের কোন ভাবেই বোঝাতে পারি না যে খুব কাছ থেকে একটি ছবিই কেবল তুলতে চাই ধরতে নয়। কিন্ত অল্পক্ষন পরেই বুঝতে পারি মানুষের উপর তাদের মোটেও আস্থা নেই।
মনেমনে বলি এই আস্থাহীনতার কাজটা তো আমরাই করেছি। তাদের অনেক প্রজাতী আমাদের বিশ্বাস করেই বিলীন হয়ে গেছে।
তবু কয়েক ঝাক বকের দুর থেকে ছবি তুলি। ফুলের ছবি । ধানের চারার ছবি।
আগাছার ছবি। কৃষকের ছবি। খালের ছবি । নৌকার ছবি। গরুর ছবি।
ছাগলের ছবি। খোরা মাঠের ছবি। ছবির রাজ্যে কেবল ছবি তুলে যাই। শুধুযে ক্যামেরায় তা না। দুচোখ ভরে দেখে নেই আমার সবুজ শ্যামল দেশের রুপ।
মনে পরে যায় জীবনানন্দ দাশ, মনে পড়ে জিসমউদ্দিনের কথা, কন্ঠে তাই চলে আসে আব্দুল করিমের গান। মোবাইলে রেকর্ড করা ছিল একতারার সুর। গাছের নিচে বসে একতার সুরে বাউলের কন্ঠে লাল শুনতে শুনতে জিরিয়ে নেই।
আল্প দুরেই আবার পেয়ে যাই খাল। খালের কোথাও পানি কোথাও শুকনো।
মেশিন দিয়ে খাল থেকে ধানক্ষতে পানি দেয়া হচ্ছে। পানি দেয়া লোকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি সবাই তারা তারি করে তাদের জমীটা আগে ভেজাতে চাচ্ছে কারন খালে যে পরিমান পানি আবশিষ্ট আছে তা নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। পানির যুদ্ধ তাহলে শহর থেকে গ্রামেও শুরু হল।
কাঠফাটা রুদে ধুলার জঙ্গল উড়িয়ে ফিরে আসি। আসতে আসতে মনেমনে যে প্রতিজ্ঞাই করি আবার আসতে হবে বর্ষা এলেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।