বাংলাদেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনে নরওয়ে-ভিত্তিক টেলিকমস কোম্পানি টেলিনরের ২৬০ কোটি ডলারের (বর্তমান বাজারমূল্য হিসাবে) বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। নিজেদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও গ্রামীণফোনে এ বিপুল অর্থের বিনিয়োগ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে টেলিনর। বাংলাদেশের শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ে টানাপড়েনের প্রেক্ষিতে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গ্রামীণফোন বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ মোবাইল ফোন অপারেটর, বাজারে যার ৪০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। টেলিনর ও গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেড যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সাল থেকে এর ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও ইউনূসের মধ্যে তিক্ত লড়াইয়ের মাঝে পড়েছে টেলিনর। ইউনূসের মাঝে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ লুকিয়ে আছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে সরকার। তিন দশক ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী ড. ইউনুসকে ২০১১ সালে ওই পদ থেকে অপসারণ করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো এবং গ্রামীণফোনের মতো এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা নিরূপণে গত বছর একটি কমিশন গঠন করে বাংলাদেশ সরকার।
কমিশনের পর্যালোচনায় বলা হয়, ১৯৯৬ সালে গ্রামীণফোনের যে অরিজিনাল বা মূল লাইসেন্স ইস্যু করা হয়, সেটি বেআইনিভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সম্প্রতি ওই কমিশনের এক অন্তর্বর্তী রিপোর্টে বলা হয়, অংশীদাররা আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কোম্পানি গঠনের আগেই সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে অসঙ্গতভাবে ওই লাইসেন্স ইস্যু করা হয় এবং পরে সেটি বেআইনিভাবে গ্রামীণফোনকে হস্তান্তর করা হয়। রিপোর্টে অবিলম্বে গ্রামীণফোনের লাইসেন্স বাতিল অথবা টেলিনরকে গ্রামীণফোনের ১৬ শতাংশ মালিকানা; যার অর্থমূল্য প্রায় ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার পরিত্যাগ করে গ্রামীণ ব্যাংককে প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। টেলিনর গ্রামীণফোনে ১৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনুচিত কিছু করার বিষয়টি অস্বীকার করে জানিয়েছে, গত বছর কোনো ধরনের অসুবিধা ছাড়াই এই লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টা নিয়ে কোম্পানি উদ্বিগ্ন এবং এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ রক্ষায় তারা সম্ভাব্য সব ধরনের আইনগত পদক্ষেপ নেবে।
কোম্পানিটি তার বিবৃতিতে আরো জানায়, বাংলাদেশ সরকার ও অধ্যাপক ইউনূসের মধ্যে চলমান বিতর্কে টেলিনর উদ্বিগ্ন, কারণ এর ফলে বাংলাদেশে তাদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়ছে। টেলিনর আশা করে, সরকার দেশের আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেনে চলবে যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ড. ইউনূসের কোনো মতামত পাওয়া সম্ভব হয়নি। গ্রামীণফোনের ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ মালিকানা টেলিনরের, ৩৪ শতাংশ মালিকানা গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের এবং বাকি ১০ শতাংশ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে গ্রামীণফোন টেলিনরের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা, গত বছর ট্যাক্স, অবচয় ও ঋণ পরিশোধের আগে যার লাভের পরিমাণ ছিল রেকর্ড ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের রিপোর্টে টেলিনরকে গ্রামীণফোনের ১৬ শতাংশ মালিকানা পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে, যা ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হবে। একই সঙ্গে ব্যবসার লভ্যাংশ পুনঃপরিশোধ করতে হবে এবং আনুমানিক ৭৬ কোটি ডলারের সম্পদ স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। এ পর্যন্ত সরকার এই কমিশনের রিপোর্ট বা গ্রামীণফোন সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান মামুন উর রশিদ বলেছেন, তিনি টেলিনরের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তাদের প্রস্তাবনা সঠিক। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে মূল সমঝোতা চুক্তি টেলিনর বলেছিল, তারা মোবাইলফোন ব্যবসায় ৫১ শতাংশ মালিকানা রাখবে, তবে ৬ বছর পর তা কমিয়ে ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, সেক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়ে আপত্তি তোলার প্রথম অধিকার গ্রামীণকে দেয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে লাভজনক এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ব্যাপারে টেলিনরের সিদ্ধান্ত ড. ইউনূসের সঙ্গে টেলিনরের সম্পর্কের অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ড. ইউনূস বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যেই টেলিনরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এমনকি ২০০৬ সালে নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণের ঐতিহাসিক সফরেও অভিযোগ করেন তিনি। কমিশনের চেয়ারম্যান রশিদ বলেন, সরকারের জন্য যতটা না তার চেয়ে বেশি ভূমিহীন নারীদের জন্য তারা ওই অর্থ ফেরত চান। টেলিনরের এই সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পশ্চিমা টেলিকম কোম্পানিগুলো যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তারই সর্ব সাম্প্রতিক উদাহরণ।
ভারতে ভোডাফোন ট্যাক্স নিয়ে এক তিক্ত বিতর্কের মুখে পড়েছে। আর ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট লাইসেন্স বাতিলের রায় দেয়ায় টেলিনরকে ব্যবসা করার পরিকল্পনা বাধ্য হয়েই পরিত্যাগ করতে হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক যায়যায়দিন, মার্চ ০৬, ২০১৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।