আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মদিনার সনদ : মহানবী (সাঃ)এর হাতে তৈরি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান

ইসলামের মহানবী (সা.) যখন মদিনায় অবস্থান করছিলেন তখন সেখানকার জনসাধারণ তাঁকে অনুরোধ করল একটি সংবিধান রচনার জন্য যা কিনা হবে মদিনার শাসনতন্ত্র, তখনই রচিত হল মদিনা সনদ, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। মহানবী (সা.) দেখলেন মদিনাবাসীদের মধ্যে সবাই মুসলমান নন। সেখানে অন্য ধর্মেরও লোক আছে। মহানবী (সা.) সব নাগরিকের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিলেন। এই হল মহানবীর (সা.) মদিনা সনদের চেতনা।

মদিনা সনদ বিসমিলস্নাহ দিয়ে শুরু হয়নি। মদিনা সনদের মাধ্যমে মদিনার রাষ্ট্রধর্মও ইসলাম করা হয়নি। আমাদের দেশে সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করেছে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি কি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এটা করেছিলেন ? না, বরং ভোটের রাজনীতিতে ধর্মপ্রাণ লোকদের বোকা বানানোর জন্য এটা করেছিলেন। অনুরূপভাবে কুখ্যাত লম্পদ সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন।

এটাও ভোটের রাজনীতিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বোকা বানানোর জন্য। নাইলে এই দুই সামরিক শাসক এত ক্ষমতাধর হওয়া সত্ত্বেও তারা দেশটাকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা দেননি কেন ? কারণ, তাদের দরকার জনগণকে বোকা বানানো, ইসলাম না। সামরিক শাসকরা ধর্মীয় উপাদান সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন তারা নিশ্চয় মহানবীর (সা.) চেয়ে বড় ইসলামপ্রেমী নন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই '৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এই সংবিধানে বিসমিলস্নাহ থাকা চলবে না।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া চলবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাতিল হতে হবে। মদীনা সনদে মদীনা রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করা হয় নাই। অথচ সেটা ছিল একটা ন্যায় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সকল সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র। আসেন, এবার দেখা যাক মদিনা সনদে কী ছিল ।

নিচে পুরো মদিনা সনদ। মদিনার সনদ ৬২২ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনা নগরীতে হিজরতের করেন এবং মদীনা/মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। এসময় সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে ছিল গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ। তাই কলহে লিপ্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাতৃত্ব্য ও সম্প্রীতি স্থাপন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৪৭ ধারার একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনার সনদ নামে পরিচিত। এর প্রথম ১০ ধারায় বলা হয় যে, মুহাজির (দেশত্যাগী বা যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিল), বনু আউফ, বনু সাইদা, বনু হারিস, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর, বনু নবীত ও বনু আউস পূর্বহারে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মনীতি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পণের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।

১১ থেকে ২০ ধারায় মুসলমানদের পারষ্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কিত আইন বিধৃত হয়। ২১ থেকে ২৬ ধারায় হত্যাকারীর শাস্তি, কোনো মুসলমান কোনো অন্যায়কারীকে আশ্রয় দিলে তার শাস্তি, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসা পদ্ধতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদী বিষয়ক আইন সন্নিবেশিত হয়। ২৭ থেকে ৩৬ ধারায় সন্নিবেশিত হয় বিভিন্ন গোত্রের স্বরুপ সম্পর্কিত বিধান। পরবর্তী ধারাসমূহে যুদ্ধনীতি, নাগরিকদের ক্ষতির ক্ষতিপূরণ, নিজ নিজ ব্যয় নির্বাহ, এ সনদে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা, বন্ধুর দুষ্কর্ম, যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ, নাগরিকের অধিকার, আশ্রয়দানকারী ও আশ্রিতের সম্পর্ক, নারীর আশ্রয়, সনদের স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে শান্তি ভঙ্গের আশন্কা দেখা দিলে করণীয়, কুরাইশদের ব্যাপারে ব্যবস্থা, মদীনার উপর অতর্কিত আক্রমণ হলে করণীয় ইত্যাদী সন্নিবেশিত হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই প্রথম লিখিত চুক্তি ও সংবিধান।

ঐতিহাসিক পি.কে. হিট্টির মতে-" Out of the religious community of all Madinah the later and largest state of Islam arose" অর্থ্যাৎ মদীনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীকালে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল স্হাপন করে। উক্ত সংবিধানে সকল পক্ষ মেনে নিয়ে স্বাক্ষর দান করেছিল। মদীনা সনদের মূল বিষয়বস্তু ছিল: ১) সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে। ২.হযরত মুহাম্মদ (স) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। ৩) কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না।

৪) মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ৫) মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণ কে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে। ৬) রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।

৭) অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে। ৮) সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে। ৯) কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না। ১০) মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।

১১) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক। ১২) মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না। ১৩) মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না। ইউকি লিংক : Click This Link ৪নং, ৯নং এবং ১০নং ধারা কি ধর্মনিরপেক্ষ ধারা নয় ? ইসলাম ধর্ম নিজেই ধর্ম নিরপেক্ষ ।

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যক্তি পর্যায়ে মানার দরকার নাই। এটা রাষ্ট্রের মূলনীতি । ব্যক্তি ধার্মিক হবে, রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তার মানে হল রাষ্ট্র সকল ধর্ম এবং সম্প্রদায়কে সহাবস্থান করার নিশ্চয়তা দেবে।

এটাই তো মদীনা সনদের মূল কথা। সে হিসেবে মদীনা রাষ্ট্রটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আজকে ধর্মের নাম দিয়ে জামাত-শিবির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালাচ্ছে। এটা সরাসরি মদিনা সনদের বিরোধী। তাহলে তারা কিভাবে ইসলামী দল হয় ? তারা ইসলামী দল নয়।

তারা মূলত ধর্ম ব্যবসায়ী। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের ফায়েদা লুটছে। আলেমদের হত্যা করার পরিকল্পনা কোন ইসলামী দল করতে পারে না। একমাত্র মুনাফেক ছাড়া কেউ এই কাজ করবে না। তাদের দর্শন হল মওদুদীবাদ।

মওদুদীবাদের সঙ্গে ইসলামের রয়েছে বিস্তর ফারাক। ইসলামের সেবক বলে দাবীদার জামায়াত শিবিরের নেতা মওদুদীর ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বলেছেন বিভিন্ন আলেম উলামাগণ। সরাসরি নিচের লিংকে চলে যান : Click This Link জামাতে ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয়। বিস্তারিত পাবেন এখানে : Click This Link কাজেই আজকে যারা মহানবী (সাঃ) রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চেতনা থেকে সরে গিয়ে সংবিধানে বিসমিলস্নাহ অথবা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন তারা ধর্মীয় চেতনা থেকে তা করছেন না। যেসব সামরিক শাসকরা ধর্মীয় উপাদান সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন তারা নিশ্চয় মহানবী (সাঃ) এর চেয়ে বড় ইসলামপ্রেমী নন।

কাজেই কেন এই মানুষগুলো ধর্মীয় উপাদান আমাদের সংবিধানে থাকা বা না থাকার বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন বা অতীতে করেছিলেন? একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় এই ভণ্ড রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় চেতনা থেকে সরে গিয়ে ধর্মকে শুধু ব্যবহার করতে চায়। কারণ সাধারণ মানুষকে ধর্ম দিয়ে সহজেই বিভ্রান্ত করা যায়। কাজেই এই উদ্দেশ্যে সংবিধানে বিসমিলস্নাহির রাহমানির রাহিম রাখার রাজনীতি ধর্মকে তথা বিসমিল্লাহকে আরো ছোট করছে। ধর্মের বেসাতি পরা এই ভণ্ড রাজনীতিবিদদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আর ন্যায্যতার স্বার্থে উচ্চকণ্ঠে সত্য উচ্চারণ করতে হবে।

আমি মনে করি বাংলাদেশের সংখ্যাধিক্য মানুষ ন্যায্যতার পক্ষেই দাঁড়িয়ে এবং দাঁড়াবে। আমাদের শুধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সাহসের সঙ্গে উচ্চস্বরে ন্যায্য কথা বলতে হবে। অর্থাৎ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এটাই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মূল কথা। এটা মদিনা সনদেরও কথা।

মদীনা সনদ একটি ধর্মনিরপেক্ষ সনদ। ইসলাম নিজেই একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। কেউ যদি ইসলামকে সাম্প্রদায়িক ধর্ম বানায়, সেটা তার ব্যক্তিগত মতামত। আরেকটা কথা, মহানবী (সাঃ) এর চেয়ে কেউ যদি ইসলামকে বেশি ভালোবাসার ভান করে, সে একটা ভণ্ড। এই সব ভণ্ডদের কাছ থেকে দূরে থাকুন।

চিলে কান নিয়েছে শুনলে আগে কানে হাত দিন, চিলের পিছনে দৌড়াবেন না। মদিনা সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে দেখতে পারেন : Click This Link Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।