আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফরহাদ ভাই ও তার ক্রিকেটীয় জোস্!

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

আঠার তারিখে দুপুরে আমার রাশিয়া ফেরত এক বন্ধু ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল, -কিরে ব্যাস্ত নাকি? -এই তো ব্যাস্ততা আছে অল্প। তোর না ঢাকার বাইরে যাবার কথা? - নারে টিকেট পাই নাই। তুই যদি ফ্রি থাকিস আজকে তাহলে বিকেলের দিকে আসতে পারি? - এইটা আবার জিগাইতে হয় নাকি। আসবি আয় কোন সমস্যা নাই। -ঠিকাছে তাইলে শহিদ আর রমা’রে বলি।

শোন আমার সাথে একটা গেস্ট আছে-সারপ্রাইজ দিব। - কে আছে কাউসার? - নাহ্ ওতো সুইজারল্যান্ডে এখন। -তাইলে বিয়াই-লিটন? - ধ্যাৎ নাঃ-আসলে দেখিস। - ওকে ঠিকাছে আয়- রওনা দেবার ঘন্টাখানেক আগে ফোন দিস। ওরা আসতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল।

তার সেই সারপ্রাইজ আমাকে কিছুটা বিস্মিত অবশ্যই করেছিল। আমার বহু পুরনো এক বন্ধু বড়ভাই! নাম ফরহাদ। রাশিয়া ছাড়ার পরে গত সতের বছরে দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার। শেষবার তাও বছর দশেক আগে। প্রথমবার দেখা হয়েছিল এয়ারপোর্টে-আমার সঙ্গে ছিল আমার বান্ধবী আর ওর সাথে ভাইবোন আত্মীয় স্বজন সহ এক দঙ্গল মানুষ।

কথা বেশী হয়নি টুকটাক হাই-হ্যালো!দ্বীতিয়বার,এলীফ্যান্ট রোডের এক রেস্টুরেন্টে। সেবারও ওর সাথে ওর আত্মীয়স্বজন আর আমার সাথে কয়েকজন গেস্ট! ওকে রাশিয়াতে সবাই চিনত চুলা ফরহাদ,আর আমরা ঘনিষ্ঠরা ডাকতাম লাউ ফরহাদ বলে। চুলা ফরহাদ বলার কারন তার অতি দর্শনীয় লম্বা চুলের জন্য । দারুন সুদর্শন আর দশাশই ফিগারে ফেঞ্চকাট দাড়ি আর লম্বা চুল তাকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম করেছিল। প্রথম দর্শনে মনে হত না জানি কি ডাকাবুকো রাগী তেজী পুরুষ।

বন্ধুদের জন্য অবশ্য যেকোন বিপদে ঝাপিয়ে পড়লেও – মনটা ছিল ভীষন নরম! ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি গোঁপ ছেটেছিল সে খানিকটা বিপদেই পড়ে। তার এক বন্ধু একবার শ’তিনেক গ্রাম ভদকা খাইয়ে এক রুশ ছেলেকে পেটানোর জন্য প্ররোচিত করেছিল। সেও মওকামত ছেলেটাকে পেয়ে বেদম মার দিয়েছিল। কিন্তু পরে যখন খবর পেল যে, রুশ ছেলেটা মাফিয়া দলের সদস্য- আর সে এখন সারা মস্কোতে খুজে বেড়াচ্ছে তারই মত দাড়ি গোঁপের এক বাংলাদেশী বা ভারতীয়কে – মুহুর্তে সেগুলো উধাও। ক্লিন-সেভড্ ফরহাদকে চেনাটা তখন একটু মুশকিল-ই ছিল! চুরানব্বুইতে সে ইউ কে তে যায় ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে।

বিয়ে করেছিল তার বছর খানেক বাদেই। লন্ডন প্রবাসী এক সিলেটি মেয়েকে। সেই কন্যাকে ইমপ্রেস করার জন্যই সে তার বাহারি চুল ছেটে চেহারায় ইনোসেন্ট ভাব এনেছিল! রমা(মহিলা কিন্তু নয়- দারুন সু-পুরুষ সে)আসেনি। শহিদকে নিয়ে আমরা চারজন আড্ডা দিলাম অনেক রাত অব্দি। পুরনো দিনের কত হাসি মজা আর কষ্টের গল্পই না চলল অবিরাম।

কখনো হাসির দমকে পেট ধরে বসে পড়া কখনো চোখের কোলে জলের অস্পস্ট রেখা!মুহুর্তে ফিরে গেলাম আমরা সেই দিন গুলোতে। কত স্মৃতিই না ঝাপসা হয়ে গেছে। কত প্রিয় বন্ধুকে বেমালুম ভুলে গেছি! ফরহাদ ভাই এসেছে মাসখানেক হল – চলে যাবে সামনের সপ্তায়! বৌ ছাড়া কেন এসেছে জানতে চাইলে বলল, খেলা দেখতে আইছি রে! কি কন ইংল্যান্ড থেকে শুধূ খেলা দেখতে এসেছেন? -আরে ব্যাটা শোন – আমার মত এইরকম আরো কত পাগল আছে। খেলা অলরেডি চারখান দেখছি। চিটাগাং-এ গেছিলাম খেলা দেখতে।

- আমি কিছুটা বিস্মিত!একাই দেখছেন নাকি আরো কেউ আছে সাথে? - আবার জিগায়। দশ বার জনের পুরা টিম। কাইল ভোরেই আমি যাব চেয়ারম্যান বাড়ি। ওই জায়গা থেকে পুরা গ্রুপ নিয়া আসব খেলা দেখতে। -আপনি আছেন মিরপুরে- এই জায়গা থেকে মাঠে যাইতে দশ মিনিট লাগে।

আমি বুঝলাম না তাইলে আপনার চেয়ারম্যান বাড়ি যাওয়ার কি দরকার? -আরে ব্যাটা বুঝস না ‘জোস’- পুরা জোস লইয়া মাঠে আসতে হবে। - আপনার কি মনে হয় কালকে সা.আফ্রিকার সাথে বাংলাদেশ জিতবে? - অবশ্যই জিততেই হবে। জিতবেনা মানে জিতাবই। কি আবেগ কি উচ্ছাস ভালবাসা লোকটার – আমি বেশ অবাক হই! সকালে যথারীতি ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হল। তার আর চেয়ারম্যান বাড়ি যাওয়া হল না।

তার ব্যাগ থেকে ক্রিকেট দলের জার্সি ট্রাউজার বের করে- তাড়াহুড়ো করে ছুটল মাঠের দিকে। দারুন উত্তেজিত সে, যাবার মুখে ভীষন আবেগে বলল সে ,’শালার আজকে মনে হয় চিল্লাইতে চিল্লাই মইরা যাব’। আমি ফের অবাক হলাম। ক্রিক ইনফোতে স্কোর দেখছিলাম আর নিজের কাজে ব্যাস্ত আধবেলা। বিরতিতে তার ফোন; এই শোন- আমার পেটের অবস্থা এমনিতেই ভাল না- তারপরে এইখানের খাবার খাইলে-পুরা খবর হয়ে যাবে।

খেলা শেষ আসব আমি, বেমী কিছু না একটু ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়াইলেই হবে। -ঠিক আছে সমস্যা না আসার ঘন্টা খানেক আগে ফোন দিলেই হবে। তা খেলার ভাব কেমন বুঝছেন? - কেমন আবার – আমরা জিতব! বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখার জন্য তাড়াতাড়ি করে বাসায় গেলাম। রাস্তা দারুন উত্তেজিত ক্রিকেট শ্রোতা আর দর্শকেরা। সবার সেকি দারুন উন্মাদনা!আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ হারবে- তবুও মনে মনে ভীষনভাবে চাচ্ছিলাম, আরেকবার অন্তত আরেকটা অঘটন ঘটুক! বাসায় গিয়ে টিভির সামনে বসতেই একে একে চারটি তারা খসে পড়ল।

বুকের ভেতর চাপা কস্ট। তবুও নিজের থেকে বেশী খারাপ লাগছিল ফরহাদ ভাইয়ের জন্য। ইস্ বেচারা! সাড়ে চারটার দিকে ফিরে এল ফরহাদ ভাই। যেন ক্লান্ত বিদ্ধস্ত একজন মানুষ- তার সেই দারুন উন্মাদনা উত্তেজনা আবেগ আর ভালবাসা ব্লটিং পেপার দিয়ে কেউ যেন শুষে নিয়ে গেছে…

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।