........
লায়েকুজ্জামান/মামুনুর রশিদ: রিয়াজুল হক খান মিল্কি ছিল গুরু। তার হাত ধরেই শিষ্য তারেক রাজনীতিতে পথচলা শুরু করে। অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা অর্জনে ছিল দু’জনের মধ্যে তীব্র লড়াই। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বেরই বলি মিল্কি। এ মিল্কিও ছিল এক সময়ের ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার।
তার হাত ধরেই অপরাধ জগতে পা বাড়ায় তারেক। তাদের দীর্ঘ কুড়ি বছরের সখ্যের কথা জানে মতিঝিল এলাকার মানুষ। কেউ কেউ তাদেরকে গুরু-শিষ্য বলেও আখ্যা দেন। একই সঙ্গে যুবলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দু’জনই। শিক্ষা বা আদর্শ নয় অস্ত্র এবং পেশিশক্তিই ছিল তাদের পদ-পদবি পাওয়ার বড় মাধ্যম।
রিয়াজুল হক খান মিল্কির গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, তারেকদের আদি বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুরে। মিল্কির পিতা পেশায় ছিলেন আয়কর আইনজীবী। তারেকের পিতা রাজস্ব ভবনের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তাদের সখ্য ছিল মতিঝিল কেন্দ্রিক। এজিবি কলোনির বাসিন্দা হিসেবে।
সেখান থেকেই তাদের রাজনীতি এবং অপরাধ জগতের হাতেখড়ি। এইচএম জাহিদ সিদ্দিকী তারেকের পড়াশোনার দৌড় অষ্টম শ্রেণী। পড়াশোনা করতো মতিঝিল এলাকার আইডিয়াল ইনস্টিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। স্কুলের গণ্ডির না পেরিয়েই নাম লেখায় ছাত্র সংগঠনে। নিয়মিত অংশ নিতে থাকে বাকশালের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের মিছিলে।
সেই থেকে রাজনীতির সড়কে পথচলা শুরু। মিল্কির রাজনীতির শুরু ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার হিসেবে। সূত্রমতে, এরশাদ জমানায় মিল্কি ছিল কর্নেল ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পাটির মতিঝিল কমিটির সভাপতি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর যোগ দেয় বিএনপিতে। কিন্তু কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ না পেয়ে বিএনপি ছেড়ে দেয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যোগ দেয় যুবলীগের রাজনীতিতে। দীর্ঘদিন দলের কোন পদ না পেলেও বর্তমান সরকারের সময়ে গঠিত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয় তাকে। যুবলীগের ওই পদের গরমে বর্তমান সরকারের আমলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে মিল্কি। রাজনীতিতে তার পদ নতুন হলেও মানুষ খুনে তার হাতেখড়ি আরও অনেক আগে। ১৯৯০ সালের ঘটনা।
মতিঝিল এজিবি কলোনিতে খুন হয় পনির নামের এক যুবক। তাকে নিজ হাতে খুন করে মিল্কি। এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিল মিল্কি। আসামি ছিল তার ভাই রিপনও। মামলার আসামি হওয়ার পরই আমেরিকায় পাড়ি জমায় রিপন।
পনির খুনের বছর কয়েক পরেই মতিঝিল এজিবি কলোনী এলাকায় খুন হয় পলাশ নামের আরেক যুবক। এ খুনেরও প্রধান আসামি মিল্কি। মতিঝিল এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পনির ও পলাশ খুনে কোন আসামির সাজা হয়নি। আসামিদের ভয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যায়নি কেউ। রাজধানীর মতিঝিল সবুজবাগ ও খিলগাঁও থানার একাধিক মামলার আসামি হলেও রিয়াজুল হক খান মিল্কির টিকিও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিশ।
অপরাধ জগৎ মাড়িয়েই রাজনীতিতে নাম লেখায় মিল্কি। রাজনীতিতে এলেও আড়ালে তার আসল টার্গেট ছিল অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলা। সেভাবেই মতিঝিল এলাকায় এক অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে মিল্কি। কেবল মতিঝিল এলাকায়ই নয় মিল্কি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে রাজধানীর আন্ডার ওয়ার্ল্ডে। তার ওই অপরাধ জগতের অন্যতম সিপাহসালার তারেক।
পরিচিতি ছিল কিলার হিসেবে। অব্যর্থ নিশানায় গুলি করে মানুষ হত্যায় পারদর্শী হিসেবে পরিচিত তারেক। সূত্রমতে, মিল্কির নির্দেশে তারেক হত্যা করেছে অনেককে। একটি সূত্র জানিয়েছে, মিল্কির নির্দেশেই পলাশকে হত্যা করে তারেক। এ হত্যা মামলার আসামিও ছিল সে।
মতিঝিল এলাকার ত্রাস বলে পরিচিত মিল্কি-তারেক টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে ছিনতাইকারীদের গ্রুপ পরিচালনা, চাঁদাবাজি সব কিছুই করতো এক সঙ্গে। তারেকের নামে একাধিক মামলা থাকার পরও বর্তমান সরকারের আমলে দাপটে মতিঝিল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বেড়াচ্ছে সে।
বিগত বিএনপি সরকার আমলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দেশের বাইরে পলাতক ছিল মিল্কি তারেক দু’জনই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফেরে তারা। দেশে ফিরে মিল্কি প্রকাশ্যে ঘুরতে পারলেও ক্রসফায়ারের ভয়ে আত্মগোপনে ছিল তারেক।
এ সময় তার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করতো মিল্কি। আদালতে আত্মসমর্থন করে ও প্রভাব খাটিয়ে তারেক প্রকাশ্যে আসার পর তার ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাবে বেশ কিছু গরমিল ধরা পড়ে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে। সেই থেকে তারেক-মিল্কির বিরোধ শুরু। ধীরে ধীরে তাদের দূরত্ব আরও বাড়ে।
বিরোধ জমে ওঠে মতিঝিল কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি ও টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে। বিরোধ এসে ঠেকে যুবলীগেও। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটিতে নাম লেখানোর জন্য তারেক চলে যায় সভাপতি আরিফের গ্রুপে। মিল্কি থাকে সম্রাটের দিকে। বয়সে মিল্কি সিনিয়র হলেও তারেক হয়ে যায় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মিল্কি হয় সাংগঠনিক সম্পাদক।
ওই বিরোধের মধ্যেই আবার তারা নতুন বিরোধে জড়িয়ে পড়ে মতিঝিল এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া নিয়ে। তারেকও কমিশনার প্রার্থী, মিল্কিও চায় প্রার্থী হতে। একটি সূত্র জানিয়েছে, মিল্কির লোকজনের হাতে খুন হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেও তারেক খুন করতে পারে। ওই সূত্রমতে, সেভাবেই রাজধানীর আন্ডার ওয়ার্ন্ডে যোগাযোগ করছিল মিল্কি। একটি সূত্র জানিয়েছে, সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে মতিঝিল এলাকার ঘাতক বলে পরিচিত এক ছাত্রলীগ নেতাকে দেখা গেলেও তাকে আসামি করা হয়নি।
এমনকি তার নামও কেউ বলছে না। ঘাতক বলে পরিচিত ওই ছাত্রনেতা কি কারণে ওই সময় শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ছিল? মিল্কির ঘাতক তারেকের হাতে কিভাবে কোন কারণে কত মানুষ খুন হয়েছে- জিজ্ঞাসাবাদে তা বের হয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।
আসামিরা ৭ দিনের রিমান্ডে: মহানগর যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃত ৬ আসামির ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বুধবার আসামিদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠিয়ে গুলশান থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক সাব্বির রহমান ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আসামি পক্ষে রিমান্ড বাতিলপূর্বক জামিনের আবেদন করেন এডভোকেট সালাহউদ্দিন আহমেদ ও এনামুল হক।
শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মো. রেজাউল করিম জামিনের আবেদন নাকচ করে সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়ে আসামিদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলো- তুহিনূর রহমান ওরফে ফাহিম, সৈয়দ মোস্তফা ওরফে মুজতবা আলী রুমি, রাশেদ মাহমুদ, সাইদুল ইসলাম ওরফে নুরুজ্জামান, সুজন হাওলাদার ও জাহাঙ্গীর মণ্ডল। মামলার প্রধান আসামি জাহিদ সিদ্দিকী তারেক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উত্তরার ফরচুন হাসপাতালে র্যাব প্রহরায় চিকিৎসাধীন রয়েছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। আদালতের সংশ্লিষ্ট থানার জিআরও ফরিদ মিয়া সাংবাদিকদের জানান, তারেককে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গত ২৯শে জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় মিল্কি।
এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই মেজর রাশিদুল হক খান বাদী হয়ে জাহিদ সিদ্দিকী তারেক (৩৫)-কে প্রধান আসামি করে ১১ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত পরিচয় আরও কয়েক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, রিয়াজুল হক খান মিল্কি বাজার করার জন্য মোহাম্মদপুর থেকে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডে গেলে আগে থেকেই ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৯/১০ রাউন্ড গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় মিল্কি।
বিচার নিয়ে মিল্কি পরিবারের শঙ্কা: থানায় মামলা হলেও মিল্কি পরিবারের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। নিহতের পরিবারের সদস্যদের মতে মিল্কি সরকার দলের একজন কর্মী।
খুন হয়েছে দলের অপর এক কর্মীর হাতে। কিন্তু এ পর্যন্ত খুনের ঘটনায় মিল্কি পরিবারে দলের কোন নেতা-কর্মী সহমর্মিতা প্রকাশ করতে যাননি।
এদিকে গতকাল ভোর ছয়টায় আমেরিকা থেকে নিহত যুবলীগ নেতার ছোট ভাই রিপন আহমেদ মিল্কি ঢাকায় পৌঁছান। ছোট ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিহতের ভাই মেজর রাশেদ ও স্বজনরা। ভাই নৃশংসভাবে খুন হওয়াতে লাশের গাড়ির কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।
এদিকে বাদ জোহর নামাজ শেষে নিহত মিল্কির প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মোহাম্মদপুর তার বাসার কাছে স্থানীয় মসজিদে। সেখান থেকে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মতিঝিল এজিবি কলোনিতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।