ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন যুবলীগ নেতা রিয়াজ উদ্দীন খান মিল্কি হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন মূল কিলার আরেক যুবলীগ নেতা এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। র্যাবের হেফাজতে রাজধানীর উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। উত্তরা থেকে গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে গুলশান থানায় নেওয়ার পথে খিলক্ষেত বিমানবন্দর সড়কে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধের বলি হন কিলার তারেক ও শাহ আলম নামের আরেক যুবক।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, উত্তরার একটি হাসপাতাল থেকে গুলশান থানায় নেওয়ার পথে দুটি মোটরসাইকেলে করে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা র্যাবের টিমকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাব সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়লে শাহ আলম নামের এক দুর্বৃত্তের মৃত্যু হয়।
তবে বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বন্দুকযুদ্ধের সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে আসামি তারেকের মৃত্যু হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন র্যাবের ডিএডি আবুল কালাম আজাদ ও নায়েক আসাদ। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট থাকায় র্যাবের ওই দুই সদস্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। নিহতদের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাঘব-বোয়ালদের বাঁচাতেই তারেককে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হয়েছে। মিল্কিকে খুন করার সময় যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলাই হয়তো কাল হয়েছে তারেকের। আর এ জন্য দুর্বৃত্তরা তারেককে গুলশান থানায় নেওয়ার সময়টিকেই নিরাপদ বলে বেছে নিয়েছিল। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ছায়াসঙ্গী হিসেবে পরিচিত সাগরের বিশ্বাসঘাতকতায় খুন হয়েছেন যুবলীগ নেতা রিয়াজ উদ্দীন খান মিল্কি। সাগরকে 'ম্যানেজ' করেই তাকে গুলশান নিয়ে আসে খুনিরা।
শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনের আসার আগে গুলশানের ভাসাবী শো-রুমে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন তারা। ওই সময় গুলশানেরই আরেকটি পানশালায় আড্ডা দিচ্ছিল খুনিরা। মিল্কিকে কয়েক দফা হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার পর সর্বশেষ সাগরকে ম্যানেজ করেই তারেক তার কিলিং মিশন সফল করেন বলে জানা যায়।
মিল্কি হত্যা ঘটনায় গ্রেফতার ছয়জনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ। একই সঙ্গে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় গতকাল যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক চঞ্চল ও দক্ষিণের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেককে দল থেকে বহিষ্কার করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।
তবে মৃত্যুর আগে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই খুনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন র্যাবের হেফাজতে থাকা তারেক।
সূত্রে জানা গেছে, একটি কালো প্রাইভেটকার থেকে মিল্কির নেমে আসা, সাগরের গাড়ি পার্ক করা এবং মিল্কির শপার্স ওয়ার্ল্ডের দিকে হেঁটে আসা_প্রতিটি দৃশ্যেরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে যুবলীগের এক 'বড়ভাই'-এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন তারেক। এমনকি ট্রিগারে টান দিয়ে একের পর এক গুলি করা এবং কিলিং মিশন শেষ করে মোটরসাইকেলে নির্বিঘ্নে চলে যাওয়ার প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। গুলি করার ঠিক আগে মিল্কির মুঠোফোনে তারেক কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আরেকজনকে দিয়ে ফোন করিয়ে তাকে (মিল্কি) ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, কিলিং মিশন নির্বিঘ্ন করতে ঘটনার আধঘণ্টা আগে থেকে শপার্স ওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন মোড়ে অন্তত সাতজনকে নিয়োগ করেছিলেন কিলার তারেক।
এ কাজের তদারক করেছেন সোহেল। তারেক নিশ্চিত করেছেন, সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত তার পেছনে থাকা পিস্তল হাতে অন্য যে ব্যক্তিকে দেখা গেছে, তিনিই সোহেল। একটি পাজেরো ও দুটি মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন তারা।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, মিল্কিকে হত্যার আগের দিন মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে তাকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করেন তারেক ও চঞ্চল। তবে সেদিন তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক।
সেদিন মিল্কির সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছিলেন তারেক। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে টেন্ডার ও ডিশ ব্যবসা নিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মৃত্যুর আগে তারেক মিল্কিকে খুন করার কথা স্বীকার করেছিলেন। হত্যার নেপথ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকেই কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে তারেকের দেওয়া সব তথ্যই যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
সন্দেহভাজন সবার গতিবিধির প্রতি রাখা হচ্ছে গভীর দৃষ্টি।
কে এই তারেক : পুরো নাম এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। বাবা আবদুল হাই সিদ্দিকী ওরফে শামসু মিয়া। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ১৩ নম্বর পানিউমদা ইউনিয়নের বড়গাঁওয়ে। ছোটবেলা থেকেই রাজধানীর মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন ৪১ নম্বর নিউ ইস্কাটনের নাভানা ভারডেন্সিতে। সর্বশেষ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ লাভ করেছিলেন। এর আগে যুবলীগের একই কমিটিতে সদস্য ছিলেন তারেক। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে খুন করতেন ঠান্ডা মাথার পেশাদার কিলার তারেক। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ, কারাবন্দী সুইডেন আসলাম, পলাতক কালা খোকন ও শাহাদতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার।
পুরান ঢাকার শাহাদত কমিশনার, মতিঝিলের দর্পণ, শাহজাহানপুরের রাজীব, এসআই হুমায়ুন কবীর, ছাত্রলীগ নেতা তপন, মডেল অাঁখি, কমিশনার খালেদ ইমামসহ অন্তত ৩০টি খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তারেক ওরফে টিঅ্যান্ডটি তারেক।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, তারেক সম্পর্কে আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তবে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এটা নিশ্চিত যে তারেক ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। আর মিল্কির কিলিং মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী একজনের গুলিতেই আহত হয়েছিলেন তিনি।
মিল্কি হত্যার নেপথ্যে : সাম্প্রতিক সময়ে যুবলীগের বেপোরোয়া চাঁদাবাজি এবং এর ভাগবাটোয়ারা নিয়েই কোন্দলের সূত্রপাত।
বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি), ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টের টেন্ডার কোন্দল আরও ঘনীভূত হওয়ায় খুন হন মিল্কি। ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাঁদাবাজির ওই টাকার একটি বড় অংশ যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছে থাকে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। একসময় মতিঝিল এলাকার যাবতীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মিল্কি-তারেক গংদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই চক্রে ছিলেন বর্তমান সরকারের একজন তরুণ সংসদ। কিছুদিন আগে মিল্কি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন।
একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতাও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে আরও। ওই আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থনপুষ্ট ছিলেন তারেক। ফলে একসময় মিল্কি-তারেক একই সঙ্গে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করলেও ওই দ্বন্দ্বের কারণে তারা একে অপরের শত্রু বনে যান। মিল্কির বেড়ে ওঠায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তারেকের সঙ্গে হাত মেলান যুবলীগের অনেক নেতা। পুলিশ ও মিল্কির ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করেছে, মতিঝিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি এবং ঢাকা মহানগর যুবলীগের কমিটি গঠন-সংক্রান্ত বিরোধসহ একাধিক কারণে মিল্কিকে হত্যা করা হতে পারে।
যুবলীগের মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে কে কত টাকা দিয়ে বিভিন্ন পদ বাগিয়েছেন তাও খোঁজ নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়েছেন টাকার অঙ্ক শুনে। এসব দ্বন্দ্ব যখন চরম আকার লাভ করে, তখনই পরিকল্পনা হয় মিল্কিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার। আর যারা মিল্কিকে হত্যায় তারেককে ব্যবহার করেছেন, নিজেদের বাঁচাতেই শেষতক তারা নেন এক কঠিন সিদ্ধান্ত_যে করেই হোক, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে তারেককে। আর গতকাল এরই বলি হলেন কিলার তারেক।
স্থল ও বিমানবন্দরে সতর্কতা : গুলশান থানায় করা মামলার পলাতক চার আসামি যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। গোয়েন্দা জানিয়েছেন, ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের বেশ কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে মিল্কির হত্যাকারীদের যোগাযোগ রয়েছে। সে জন্য আসামিদের পালানোর সম্ভাব্য সব জায়গায় সতর্ক নজর রাখা হয়েছে। র্যাব ও পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে তাদের গ্রেফতারে। মামলা সূত্রে জানা যায়, মিল্কি হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে তার ছোট ভাই মেজর রাশেদুল হক খান বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন।
জাহিদ সিদ্দিক ওরফে তারেক, তুহিনুর রহমান ফাহিম, সৈয়দ মোস্তফা আলী ওরফে রুমি, শাখাওয়াত হোসেন ওরফে চঞ্চলসহ ১১ জনকে আসামি করা হয় মামলায়। এ ছাড়া মিল্কি হত্যায় অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচজন জড়িত রয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। তবে তারেক নিহত হওয়ায় মিল্কি হত্যার নেপথ্যের নায়কদের এখন বের করা কঠিন হয়ে পড়ল।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, মিল্কি হত্যার পলাতক আসামিদের ব্যাপারে তাদের সব ব্যাটালিয়নে তথ্য দেওয়া হয়েছে। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে আসামিদের গ্রেফতারে।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশান-১ এ ১২৩ নম্বর রোডের শপার্স ওয়ার্ল্ড শপিং মলের সামনে মিল্কিকে প্রকাশ্যে গুলি করে পালিয়ে গিয়ে তারেক উত্তরার ফরচুন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ সময় ওই হাসপাতালে চঞ্চলসহ কয়েকজন পাহারা দিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে ওই হাসপাতাল থেকে তারেককে গ্রেফতার করে র্যাব। তবে অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরে র্যাব অভিযান চালিয়ে আরও ছয়জনকে গ্রেফতার করে।
এর প্রায় ৪৫ ঘণ্টার মাথায় হত্যার শিকার হলেন তারই খুনি বন্ধু তারেক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।