আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামীণ ব্যাংকে দুর্নীতি-শেষপ্রায় সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম!--- মজুমদার বাবু ( কালের কন্ঠ--০৭/০৩/২০১১ )



গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনোনীত স্বল্পশিক্ষিত পরিচালক ও এর আগের সরকারগুলোর মনোনীত পরিচালকদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালের পরিদর্শনে। গরিব মানুষের নামে আনা বিদেশি সংস্থার অনুদানের টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে ভিন্ন খাতে হস্তান্তরের প্রমাণও কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাতে পেয়েছিল এক যুগ আগেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ক্ষমতাসীন সরকারগুলো এসব বিষয়ে এত দিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত ডিসেম্বরে নরওয়ের টেলিভিশনের তথ্যচিত্র দেখানোর পর এ নিয়ে দেশের ভেতর ও বাইরে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়। এর পরই এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তৎপরতা দেখা যায়।

বছরের পর বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের উপর্যুপরি লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তহবিল পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটি গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে সরকার ও দাতাদের তহবিলের যথেচ্ছ ব্যবহার, সরকার ও সদস্যদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা, সরকারের অনুমোদন না নিয়েই সরকারের সম্পত্তি অন্য প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর ও অবৈধভাবে ভোগদখল, সদস্যদের গ্রুপ ফান্ডের অর্থ ফেরত না দিয়ে কেন্দ্রীয় তহবিলে স্থানান্তর, ব্যাংকে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীতিবহির্ভূতভাবে প্রেষণে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিযুক্তসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছে। গত বুধবার ইউনূসকে ব্যাংকের পদ থেকে অব্যাহতির আদেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইউনূস এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।

গ্রুপ ফান্ডের টাকা ও লভ্যাংশ পাননি সদস্যরা গ্রামীণ ব্যাংকের যেসব সদস্য ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন কিংবা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁদের কাউকেই গ্রুপ ফান্ডের টাকা ও লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালের পরিদর্শন প্রতিবেদনের গ্রুপ ফান্ডে অনিয়ম শিরোনামে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক এর বিধিমালা অনুসারে সদস্যদের ঋণ বাবদ দেওয়া টাকা থেকে ৫ শতাংশ ট্যাঙ্ হিসেবে কর্তন পূর্বক গ্রুপ ফান্ডে জমা রাখা হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালের ১০ অক্টোবরের আগে যেসব সদস্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন বা ব্যাংক থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁরা গ্রুপ ফান্ডের টাকা ফেরত পাননি। ফলে ব্যাংকের ভূমিহীন দরিদ্র সদস্যরা তাঁদের ঋণের টাকার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গ্রুপ ফান্ডে ট্যাঙ্ বাবদ জমাকৃত অবণ্টনকৃত টাকা কেন্দ্র কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং ১৯৯৯ সালে অবণ্টনযোগ্য পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ টাকা কেন্দ্র কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর করা হয়।

ব্যাংক কর্তৃক প্রচারিত ওই বিধিমালা গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুসারে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত না হওয়ায় এর আইনগত বৈধতা নেই। লভ্যাংশের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের মূলধনের সিংহভাগ এসেছে ভূমিহীনদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে। ব্যাংকের তহবিল সরবরাহকারীদের নির্ধারিত হারে সুদ বা সার্ভিস চার্জ প্রদান করা হলেও ব্যাংক এর কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বর্তমান পরিদর্শন তারিখ (৩১/১২/১৯৯৯) পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর মূলধন সরবরাহকারীদের কোনো লভ্যাংশ প্রদান করেনি। ফলে ইতিমধ্যে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছেন তাঁরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কালক্রমে ব্যাংক যত বিশাল সম্পদের অধিকারীই হোক না কেন, সাবেক সদস্যরা সে কারণে কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন না।

সুতরাং দরিদ্র জনসাধারণের পাওনা তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করে দিলে অথবা ব্যাংকের নিজস্ব সম্পদ এত দ্রুত বৃদ্ধির পরিবর্তে সদস্যদের কল্যাণে তা ব্যয় হলে সবাই সমানভাবে লাভবান হতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বৃহত্তর স্বার্থে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য অর্থ নিজ নিজ ব্যক্তিকে পরিশোধ করাটাই ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচিত। তা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতির পাশাপাশি নিট মুনাফাজনিত আর্থিক সুবিধা যাতে প্রত্যেক সদস্যই ভোগ করার সুযোগ পান, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখাই যুক্তিযুক্ত। তহবিল ব্যবস্থাপনায় পরিলক্ষিত অনিয়ম গ্রামীণ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালে ৩১ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটি বৈদেশিক দাতাসংস্থা সিডা (সুইডিশ), নোরাড, কেএফডাবি্লউ সিডা (কানাডিয়ান) থেকে রিভলভিং ফান্ড হিসেবে প্রাপ্ত অনুদান ছিল ৩৪৭ কোটি টাকা। ১৯৯৭ সালের ৭ মে গ্রামীণ ব্যাংক তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণের সঙ্গে তহবিল হস্তান্তরসংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

কিন্তু চুক্তির প্রায় পাঁচ মাস আগের তারিখে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৬ তারিখে গ্রামীণ ব্যাংক উভয় ফান্ডের ৩৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা হস্তান্তর করে। অলৌকিকভাবে একই তারিখে গ্রামীণ ব্যাংক তা আবার গ্রামীণ কল্যাণ থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। যা দাতাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন ও আইনবহির্ভূত। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সাধারণ ও যৌথ ঋণ এবং গৃহায়ণ ঋণ কার্যক্রমের জন্য অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে দাতা সংস্থা সিডার সম্পাদিত চুক্তির শর্তাবলি নোরাডের চুক্তির অনুরূপ বিধায় সিডার অনুদানের টাকা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রকৃতপক্ষে দাতা সংস্থা থেকে রিভলভিং ফান্ড হিসেবে নেওয়া অনুদান গ্রামীণ ব্যাংক এর সদস্য ও কর্মীদের ইতিমধ্যে ঋণ হিসেবে প্রদান করেছে বিধায় বাস্তবে তা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়।

এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক একটি পেপার ট্রাঞ্জেকশন প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর ওই অনুদানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ' ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ ব্যাংক তার ১৮টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ স্থানান্তর করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গ্রামীণ ব্যাংক তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে এবং হস্তান্তরের তারিখেই তা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের সম্পদ অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ' তহবিল হস্তান্তরের বিষয়ে সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এম শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তহবিল স্থানান্তর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে।

পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিলে সেটা তারা বাস্তবায়ন করে থাকেন। বিধিবহির্ভূতভাবে সরকারের সম্পত্তি অন্যত্র হস্তান্তর গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশনের মধ্যে ১৯৯৪ সালের ১৫ মে তারিখে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ১৪টি মৎস্য প্রকল্প গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসব মৎস্য প্রকল্প সরকারের মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই প্রকল্পগুলো গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশনে স্থানান্তর করার আগে ও পরে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় দেড় যুগ আগেই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের ইজারা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

অথচ এখন পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করেনি। তারা অবৈধভাবেই 'এ' ক্যাটাগরিভুক্ত প্রকল্পগুলো ভোগদখল করে আসছে। বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যাংকের কর্মচারীদের অন্যত্র নিয়োগ গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাংকটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করা অথচ ব্যাংকের সঙ্গে আইনগত সম্পর্ক নেই এমন প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে নিয়োজিত করা হয়, যা ব্যাংকটির অধ্যাদেশ পরিপন্থী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৭ সালেই পরিদর্শন শেষে আপত্তি তোলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করে।

অথচ ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের ১৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রেষণে নিয়োজিত থাকা সম্পর্কে ব্যাংক অঙ্গীকার করে, আগামী এক বছরের মধ্যে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু ব্যাংক তা সম্পূর্ণ পরিপালন করেনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.