এ দেশের চাকমা, সাঁওতাল, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মণিপুরি, খাসিয়া, গারো আদিবাসীদের বেশ সমৃদ্ধ ভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে এসব ভাষায় শিক্ষাদানের কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। তাই সরকারকে শিগগিরই তার প্রতিশ্রুতি পূরণে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করতে হবে
আমি আমার মায়ের ভাষায় কথা বলব। মায়ের ভাষায় পড়াশোনা করব। স্বাভাবিকভাবে এটাই তো হওয়া উচিত।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ দেশের ৪৫টিরও অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুরা আজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা গ্রহণ নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক. আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু না থাকা। দুই. বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী শিক্ষক না থাকা। তিন. আদিবাসী গ্রামগুলোতে বিদ্যালয় না থাকা।
চার. পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীবান্ধব পরিবার-পরিবেশের প্রতিফলন না থাকা এবং পাঁচ. আদিবাসী শিশুর জন্য বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশ অনুকূলে না থাকা। এসব কারণে আজকাল আদিবাসী শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে হচ্ছে। দেখা যায় জাতীয়ভাবে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার মাত্র ৩০ ভাগ। অথচ আদিবাসী শিশুদের বেলায় এটি দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু ভাষা সমস্যার কারণে প্রায় ৪০ ভাগ আদিবাসী শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্বের কথা ভেবে আজ অনেক সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। সমতলে সাঁওতাল শিশুদের জন্য রাজশাহীতে প্রথম জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ১৯৯৯ সালে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কাজ শুরু করে। এখন বর্তমানে সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহাড়ি শিশুদের নিয়ে সমতল অঞ্চলে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলেও অনেক বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা মন্দিরে আদিবাসী ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চালু আছে।
সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলেও বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে। এভাবে সারাদেশে প্রায় ৫০টির মতো সংস্থা আদিবাসী শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের যে কাজ সংস্থাগুলো করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ফলে প্রজেক্টনির্ভর এ কাজগুলো তার সঠিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে এবং বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পাঠ্যসূচি সার্বিক লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানকে কার্যকর করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন প্রত্যেকের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
তারপর সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। বেশিরভাগ আদিবাসীরই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। রোমান বা বাংলা হরফ ব্যবহার করে অনেকে শিক্ষাদানের কাজটি করছেন। এ নিয়ে আবার কিছু মতবিরোধও আছে। এখানেও বোঝাপড়াটা থাকা জরুরি যে কোনো হরফ তারা ব্যবহার করবে।
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ৮টিরই জন্য নিজস্ব বর্ণমালাও তৈরি করে ফেলেছেন তারা। বাকিগুলোর তৈরির কাজও প্রায় শেষের পথে।
আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রসঙ্গে এখন পর্যন্ত সরকারের সেই ধরনের কার্যকলাপ চোখে পড়ার মতো নয়। বর্তমান মহাজোট সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করেছে। এখানে আদিবাসীদের শিক্ষার উন্নয়নে এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রসঙ্গে বেশ ভালোভাবেই কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অধ্যায়-১ এ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (২৩), দেশের আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে। অধ্যায় ২ (খ)-তে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। আদিবাসী শিশু (১৮, ১৯, ২০) নং অনুচ্ছেদে আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, আদিবাসী অধ্যুষিত (পাহাড় কিংবা সমতল) যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি যেসব এলাকায় আদিবাসীদের বসতি হালকা সেসব জায়গায় বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করার প্রতি নজর দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত যেসব শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে তার একটিও আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে শিক্ষানীতি ২০১০ পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছি। সরকার মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের শর্তগুলো পূরণে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ১০০ ভাগ করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এখানে সরকারকে আদিবাসীদের শিক্ষার ব্যাপারেও নজর দিতে হবে। কেননা আদিবাসীদের শিক্ষার উন্নয়ন না ঘটিয়ে সরকারের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়িত হবে না।
আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে এ রকম অনেক প্রতিশ্রুতি সরকারের অনেক মন্ত্রী-সাংসদ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলেছেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে পাহাড়ি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারের কথা বলা হয়েছে (পার্বত্য চুক্তি, খণ্ড খ, ধারা ৩৩ খ ২)। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ৪০তম অধিবেশনের কনভেনশন ১০৭নং ধারায় আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এটি অনুস্বাক্ষরও করেছে। এছাড়া জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদেও ১৭(ঘ) ধারায় আদিবাসী শিশুদের ভাষাগত চাহিদার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে।
স্বাধীনতার বেশ কিছু বছর পরও সরকারের উদ্যোগে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের বেশ কিছু কার্যক্রম ছিল। কিন্তু কী কারণে এখন প্রায় সবই বন্ধ হয়ে আছে। সরকারের উদ্যোগে কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইন পল্লীতে আদিবাসী শিশুদের রাখাইন ভাষার ১৭টি স্কুল খোলা হয়েছিল। এখন এগুলোর মধ্যে ২-৩টি নামেমাত্র টিকে আছে।
মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
এদেশের চাকমা, সাঁওতাল, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মণিপুরি, খাসিয়া, গারো আদিবাসীদের বেশ সমৃদ্ধ ভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে এসব ভাষায় শিক্ষাদানের কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। তাই সরকারকে শিগগিরই তার প্রতিশ্রুতি পূরণে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করতে হবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির প্রথম বৈঠকে আদিবাসী শিক্ষার জন্য দুটি সাব-কমিটি গঠনের জন্য ওই কমিটিকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবে এসব কমিটিতে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং যেসব বেসরকারি সংস্থা আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করে যাচ্ছে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সর্বোপরি এই কাজে আদিবাসী জনগণ, বেসরকারি সংস্থাগুলো এবং সরকারের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে।
মানিক সরেন : আদিবাসী ছাত্র সংগঠক
(লেখাটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে সমকালে প্রকাশিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।