আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদিবাসী শিশুর কি অধিকার নেই নিজ মাতৃভাষায় পড়ার?

প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি

বিজু পার্বত্য জনপদের প্রধান উৎসব। বিজু উৎসবেও শিশুদের স্কুলে যেতে হয়েছে, ওদের বাবা-মাকে অফিস করতে হয়েছে। পরীক্ষার মতো ভয়কাতুরে বিষয়েও ছাড় পায়নি অনেক পাহাড়ি শিশু। রাষ্ট্রের সব উৎসবে সবাই ছুটি পায়, তবে কেন নিজেদের প্রধান উৎসবে ছুটি পাবে না পাহাড়ি শিশুরা? ঈদ বা পূজার দিন কি কোনো বাঙালি শিশু স্কুলে যায়? শুধু প্রধান উৎসবের ছুটিই নয়, পাহাড়ি শিশুরা আরও একটি ব্যাপারে চরম বৈষম্যের শিকার; তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাহাড়ি আদিবাসী শিশুরা ঘরে যে ভাষায় কথা বলে স্কুলে গিয়ে সে ভাষার দেখা পায় না।

স্কুলকে ভিনদেশি ভুবন মনে হয়। পাঠ্যসুচিকে মনে হয় ‘দুরের শোনা গল্প’। তাদের হাতে তুলে দেওয়া বইতে নিজের চারপাশের পরিচিত কোনো কিছুর দেখা তারা পায় না। বইগুলো তাদের কাছে হয়ে ওঠে অচেনা সংস্কৃতির আধার; নিজের ভাষার কথাবার্তা নেই সেখানে, নেই সহপাঠী বন্ধুদের চেহারা। বাংলাদেশে কমবেশি ৪৫টি আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বাস।

এর মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে চাকমা, মারমা ত্রিপুরাসহ ১১টি আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয়ভাবে পার্বত্য অঞ্চলটি (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) ‘উপজাতি’ বা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তিতেও (খন্ড ক, ধারা-১) এর উল্লেখ রয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে (পার্বত্য চুক্তি, খন্ড: খ, ধারা: ৩৩-খ-২)। পার্বত্য শান্তিচুক্তির এক যুগ পূর্তি হতে যাচ্ছে।

১৯৯৭ সালে যে শিশুর জন্ন হয়েছে, এখন তার বয়স ১২ বছর। নীতিনির্ধারকদের অবহেলায় ১২ বছরেও কেন পার্বত্য অঞ্চলের শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করা গেল না, এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকা বাঙালি শাসক দল? নিজের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য যে বাঙালি লড়াই করেছে, তারাই কেন আবার নিজের দেশের অন্য ভাষাভাষীর মর্যাদা দিতে অনাগ্রহী? অনাদর আর অবহেলায় বাংলাদেশে অনেক ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের মাতৃভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষার যাত্রাপথকে মসৃণ করতে হবে। শিশুশিক্ষার প্রধান বাহন হচ্ছে মাতৃভাষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুতেই মাতৃভাষা ব্যবহারের অন্যতম লক্ষ্য, শিশুকে নিজের ভাষায় বলতে ও বুঝতে সক্ষম করে তোলা।

মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেলে একজন শিশুকে নতুন ভাষা শেখার চাপ সইতে হয় না। সে সহজেই সবকিছু রপ্ত করতে পারে। মাতৃভাষায় যেটা সম্ভব, নতুন কোনো ভাষায় তা সম্ভব নয়। ‘নানান দেশের নানান ভাষা/বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা’? মধ্যযুগের কবি রামনিধি গুপ্তের এই কথার আবেদন ও উপযোগিতা এখনো কি প্রাসঙ্গিক নয়? একবারও কি আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা ভাবতে পারি, আমার শিশুটিকে ভিনদেশি অচেনা কোনো ভাষায় (ধরা যাক জাপানি, চীনা, জার্মান বা রুশ ভাষায়) ফুল পাখির নাম কিংবা ছড়া পড়তে হচ্ছে? নিশ্চয় নয়। নিজের সন্তানের জন্য যা সত্য, অন্যের জন্য তা কেন আমরা মানতে চাইব না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথা তো বহুল উচ্চারিত ‘আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর...’। বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু উপলক্ষে স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানে ত্রিপুরা ও বাংলায় চমৎকার সব গান পরিবেশন করলেন মৌসুমী ত্রিপুরা। তিনি কমলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় যোগাযোগ যে একজন শিশুর জন্য কতটা পীড়াদায়ক হতে পারে, তা তা জানা গেল মৌসুমী ত্রিপুরার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি গল্প থেকে। “ক্লাসে আমি একটা ছড়া পড়াচ্ছিলাম।

এক পাহাড়ি শিশু কাছে এসে বলল, ‘আমি প্রচেষ্টা করিবো’। চেষ্টা করবে তো ভালো কথা, করো। ছেলেটি আবার বলল, ‘প্রচেষ্টা করিবো’। বুঝলাম কোথাও সমস্যা হচ্ছে। বললাম, তোমার নিজের ভাষায় বলো।

ছেলেটি ত্রিপুরা। ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ ককবরক ভাষায় বলার পরে বুঝলাম ‘প্রচেষ্টা’ নয়, ছেলেটি আসলে ‘প্রস্রাব’ করতে চায়। ” স্কুলে এসব ছোটখাটো সমস্যার কথাও একজন পাহাড়ি শিশু ঠিকভাবে বলতে পারে না, কারণ সে তো বাড়িতে বাংলায় কথা বলে না, ফলে সে তখন স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিছুদিন পরে সে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভাষাগত সমস্যার কারণে আদিবাসী শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ, যেখানে জাতীয়ভাবে ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ।

শিক্ষার প্রধানতম মাধ্যম ভাষা। শিক্ষাজীবনের শুরুতে কোমলমতি শিশুদের দুর্বোধ্য ও অচেনা ভাষায় পড়াশোনা করতে হলে তা সহজে তাদের বোধগম্য হয় না। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তার মধ্যে স্কুলের প্রতি এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়। পার্বত্য জনপদের মানুষ নানাভাবে বৈষ্যমের শিকার।

বৈষম্য আর পশ্চাৎপদতার দেয়াল ভাঙতে পারে কেবল শিক্ষা। কিন্তু সেই শিক্ষার শুরুটা যদি হয় অন্য ভাষায়, তাহলে তাতে আনন্দ থাকে না, থাকে না সঠিক মনোযোগ। একই বিষয়ে আরেকটি পোস্টঃ আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারসহ সকলের আন্তরিকতা প্রয়োজন _____________________________________________ ফিরোজ জামান চৌধুরীর পাহাড়ে শিশুশিক্ষা: আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি লেখা থেকে সংক্ষেপিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.