বাংলা আমার দেশ
আলোচনা-সেমিনার, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ-প্রবন্ধ, এমনকি কতক লোকের ক্রিয়াকাণ্ড দেখে ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক যে, ইসলাম মানেই আরবীয় বেশভূষা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং মুসলমান হলো আরবী ভাষার আবরণে কোনো জীব যাদের কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি শুধু নয়, মুখ নিঃসৃত শব্দও আরবিয় ঢংয়ে উচ্চারিত হবে। কেননা, আরবি ভাষার মাহাত্ম্য এমন যে পড়লে নেকী, শুনলে নেকী, প্রতি হরফে দশ নেকী।
এ কারণেই হয়তো বা আরবি উচ্চারণ ও আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের কসরৎ কম হয়নি। উর্দু ভাষী পাকিস্তানীদের খুশি করতে ওদের নজরানা খেয়ে এ ধরনের উদ্ভট চেষ্টা-তদবির চলেছে অনেকদিন ধরে। কারণ, এ সমস্ত শিক্ষিতপাপী পরগাছাগোষ্ঠীর প্রভুদের দৃষ্টিতে বাংলা ম্লেচ্ছদের অচ্ছুৎ ভাষা।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করে বাংলার নাম-নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রও তাই অভিন্ন উৎস থেকেই। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, গান-বাজনা হারাম ঘোষিত হওয়া ভিন্ন চিন্তাধারা প্রসূত নয় আদৌ। ভাষা আন্দোলনের দাঁতভাঙ্গা জবাব এদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের থাবা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে, যার সফল পরিণতিই ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের বিস্ময়কর অভ্যুদয়। সারা পৃথিবীময় এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
উপমহাদেশের মধ্যে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, প্রতিবেশি বৃহৎ দেশগুলোর শাসকবর্গের কাছে হুমকিস্বরূপ নিশ্চয়ই। তা না হলে এখানে অশান্তির বীজ বপন করার স্বার্থকতা কোথায়! সর্বত্রই চক্রান্ত ও কূটচালের মরণ ফাঁদ বিছানো। আমাদের জাতির বিবেক, গর্ব এবং জাতীয় অহংকারের প্রতীক - লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ মনীষীদের নিয়ে তেলেসমাতির অন্ত নেই এখনও। মঙ্গল প্রদীপ, তিলক, ফুলচন্দন, প্রভাতফেরী, শহীদ মিনার, পুষ্পার্ঘ নিবেদন প্রভৃতি দেশজ কৃষ্টিগুলোকে বিতর্কিত, কটাক্ষ এবং পরিশেষে হেয় প্রতিপন্ন করার লোকের অভাব নেই। স্বীয় রক্ত-মাংস-অস্থিমজ্জার সঙ্গে লেপ্টালেপ্টিভাবে একাকার হয়ে যাওয়া জাতীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতীক কৃষ্টি-সভ্যতা-সংস্কৃতিকে বেদাত অথবা অনৈসলামিক বা হারাম বলে
ফতোয়া দেওয়া সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকপ্রসূত ভাবধারা নয় কোনক্রমেই।
কাবা ঘরকে বুকে ধারণকারী সৌদি আরবের বিবাহ, আকিকা, জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে প্রচলিত উলুধ্বনি প্রদান, বাড়িতে বাড়িতে তুলসী গাছ লাগিয়ে আদর-যত্ন করার দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলে জ্ঞান-বুদ্ধিতে আড়ষ্ট তথাকথিত মোল্লা-মৌলভীদের বন্দি জীবনের করুণ আর্তনাদ এরূপ নগ্নতায় পর্যবসিত হতে পারতো না নিশ্চিত করে বলা যায়।
নিজের ভাষা এবং নিজের দেশের আবহাওয়া-জলবায়ু উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করে, বরং গ্রহণ করতে উৎসাহী হতো এবং এখনকার মতো এমন পরগাছা-পরজীবী চরিত্র দৃষ্টির সীমানায় ধরা পড়ে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হতো না আমাদেরকেও। প্রগতিশীল দাবি-দাওয়াও কম কিসে! মন-মানসিকতায় বাঙালি হলে সর্বত্র বাংলা প্রচলনে বাধা কিসে; অন্তরায় কি? কাউকে হেয় না করে অথবা অন্য ভাষার প্রতি সামান্যতম বিদ্বেষ পোষণ না করেই জানতে ইচ্ছে হয়, নিজস্ব ভাষা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যোগ্যতা, শক্তি কি নেই আমাদের? স্বকীয় ঋতু বৈশিষ্ট্যের সমাহারে সমৃদ্ধ নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি দিবসটিও ইংরেজী ২১ ফেব্রুয়ারিতে উদযাপিত হয়, ৮ ফাল্গুন থাকে উপেক্ষিত।
মহামতি সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত বাংলা সন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ ব্যবহার না করার ফলে। শুধুমাত্র বৈশাখের মিছিল, মেলা আর লোক দেখানো ইলিশ ভাজা ভোজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া মোনাফেকী চরিত্রের প্রকৃত রূপই বটে!
পবিত্র আল কুরআনে বর্ণিত প্রকৃত এবং সত্যিকার ইসলাম কিন্তু কোনো ধরনের গোঁড়ামী ও ধর্মান্ধতা সমর্থন করে না।
যুগে যুগে নবী রসুলদের আবির্ভাব হয়েছে মানুষকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্র অনুগত শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে, ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য নয়। চৌদ্দ'শ বছর পূর্বে আরবের মরুভূমিতে মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর আগমন ঘটে এ একই উদ্দেশ্য। তিনি (সা অন্ধকারাচ্ছন্ন, পথহারা মানব জাতির সামনে আলোকজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে দেখা দিলেন - পথপ্রদর্শক রূপে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা জীবনের সমগ্র দিকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপত্র দিলেন। তিনি (সা যেহেতু আরবিভাষী তাই তাঁর দেয়া ব্যবস্থাপত্র আরবিতে সংরক্ষণ এবং সংকলন হয়েছে। ভাষা যেহেতু ভাব প্রকাশের বাহক তাই আরবি ভাষায় লিখিত কুরআন প্রত্যেক মুসলিম তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় বুঝে, ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে কর্মে লালন করবে - এটাই স্বাভাবিক; না বুঝে তোতা পাখির মতো আরবি মুখস্ত করা বা আরবিয় পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করার মধ্যে আল্লাহ্র আনুগত্য প্রকাশ পায় না।
তাছাড়া সব ভাষাই আল্লাহ্র - বিধর্মীদের ভাষা বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই। হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, বাংলা, পালি সব ভাষাই আল্লাহ্ বুঝেন। তবে বিভিন্ন ভাষার শব্দ প্রয়োগে যথার্থতা নিরূপিত হওয়া উচিৎ। আরবি ভাষায় নাম রাখলে মুসলমান হবে এ কথা অযৌক্তিক - কুরআনও সমর্থন করে না। যেমন বলা হয়েছে - 'আমি প্রত্যেক পয়গম্বরকেই তাঁর জাতীয় ভাষায় প্রেরণা দিয়েছি, যাতে তিনি তাদের বুঝিয়েছেন; অতঃপর যার ইচ্ছা আল্লাহ্র পথে চলে এবং যার ইচ্ছা পথভ্রষ্ট হয়।
কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং সুবিবেচক' (সূরা ইব্রাহীমঃ ৪)।
'আসমান-জমিনের সৃষ্টি, নানাবিধ ভাষা, বর্ণও তাহার অন্যতম নিদর্শন। সমঝদারদের জন্য এতে প্রভূত নিদর্শন রয়েছে' (সূরা রমঃ ২২)।
'আমি তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে' (সূরা দুখানঃ ৫৮)।
'আমি ইহা অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কুরআন রূপে যাতে তোমরা বুঝতে পারো' (সূরা যুখরুফঃ ৩)।
'আমি যদি আজমি ভাষায় (আরবি ব্যতীত অন্য ভাষা) কুরআন অবতীর্ণ করতাম তারা অবশ্যই বলতো - এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে এর ভাষা আজমি অথচ রাসুল আরবিয়। বলো ঃ মুমিনদের জন্য ইহা পথনির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে এদের জন্য অন্ধত্ব। এরা এমন যে, যেন এদেরকে আহ্বান করা হয় বহুদূর হতে' (সুরা হামিম সিজদাঃ ৪৪)।
'আমি যদি ইহা কোনো আজমির কাছে অবতীর্ণ করতাম এবং সে উহা পাঠ করে তাদেরকে শুনাতো তবে তারা উহাতে ঈমান আনতো না' (সূরা শুয়ারাঃ ১৮৯,১৯৯)।
'আমি এই কুরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে' (সূরা জুমারঃ ২৭)।
'আরবি ভাষায় এই কুরআন বক্রতামুক্ত যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে' (সূরা জুমারঃ ২৮)।
অতএব, বাংলা ভাষা-ভাষী কোনো মুসলমান তার নাম খিজির আলী (শুকর আলী) না রেখে যদি সুশান্ত রাখে তবে অবশ্যই সে কাফের হয়ে যাবে না বা ইসলাম থেকেও খারিজ হবে না। মনে রাখতে হবে ঐশীগ্রন্থ কুরআনের সংস্কৃতি সামপ্রদায়িকতার উর্দ্ধে - ভাষা, বর্ণ, জনপদের ব্যবধান দিয়ে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা, দলাদলীর জন্মদান রীতিমতো আহাম্মকী ও গোঁড়ামী। বিভিন্ন জনপদের অধিবাসীর হরেক রকম ভাষায় কথা বলায় ও অভিন্ন বিধান ইসলামের অনুসারী হতে কোনোই বাধা নেই।
কেননা, ইসলাম কিছু আচরণ-অনুষ্ঠান বা পর্ব পালন নয় অথবা দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, সুরমা, আতর, পায়জামা-পাঞ্জাবী জাতীয় কিছু পোশাক পরিচ্ছদের নামও নয়। মানব কল্যাণ তথা জীব ও জগতের কল্যাণে নিয়োজিত সব ধরনের মহৎ কর্মই ইসলাম। সৃষ্টির আদি অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) হতেই এই ইসলাম বিভিন্ন নবী-রসুলদের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়। সুতরাং ইসলামকে গন্ডিবদ্ধ করা ঠিক নয়। আরবি নাম ধারণ করে নির্দিষ্ট কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান পালন করলেই কুরআনে বর্ণিত মুসলিম (অনুগত) হওয়া সম্ভব নয়।
প্রবৃত্তিমুক্ত বিবেকের অনুসারী বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই মুসলিম পরিচয় দিতে পারে। বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, সব মানুষের জন্ম ও মৃত্যু প্রক্রিয়া একই অর্থাৎ মানুষের উৎস ও পরিণতি অভিন্ন। সুতরাং জন্ম-মৃত্যুর মধ্যকার সময়টুকুর বিশ্লেষণ, স্বীকৃতি এবং পরিচয় তাদের স্ব-স্ব কর্মানুযায়ী নির্ণীত হয়। তাই আল্লাহ্র দরবারে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী, জৈন ইত্যাদির কোনোই স্থান নেই। যারা অনুগত ও ভদ্র এবং ন্যায় পবিত্রভাবে ঐশিগ্রন্থের আলোকে ব্যক্তিজীবন ধারণ করে সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত থাকে তারাই আল্লাহ্র পছন্দনীয় - তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।
যেমন বলা হয়েছে - 'নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তারাই উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি' (সূরা বায়্যিনাহঃ ৭)। মনের ভাব আদান-প্রদান করার জন্যই ভাষা। শ্রুতিমধুর, সহজ-সরল, অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগে যদি ভাব ও বক্তব্য সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায় তবে তা গ্রহণ করায় আপত্তি থাকা উচিৎ নয়। হোক না তা সংস্কৃত, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু তথা যে কোনো ভাষার শব্দ। তবে আল্লাহ্কে খোদা, সালাতকে নামাজ (যার অর্থ চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়, পর্বত ইত্যাদিকে পূজা করা) বললে যাদের ধর্ম নষ্ট হয় না বরং ধর্ম নষ্ট হয় অর্থবোধক বিশুদ্ধ বাংলা শব্দ প্রয়োগ করলে, তাদের ব্যাপারে বলার কি বা থাকতে পারে! এক্ষেত্রে কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে - 'আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক একজন রসুল রয়েছেন, সুতরাং তাদের সেই রসুল যখন এসে পড়েন (তখন) তাদের মীমাংসা করা হয় ন্যায়ভাবে আর তাদের প্রতি অবিচার করা হয় না' (ইউনুসঃ৪৭)।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আল্লাহ্র বাণীই প্রচারিত হয় রসুলদের মাধ্যমে যা সর্বজনীন, যে ভাষাতেই বর্ণিত হোক না কেন।
'সুনিশ্চিত যে মুসলমান, ইহুদী, নাছারা এবং সাবেঈন সমপ্রদায় যারা বিশ্বাস রাখে আল্লাহ্ এবং কেয়ামতের প্রতি আর নেক কাজ করে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। তাদের প্রভুর কাছে তাদের কোনো ভয়ও নাই, তারা শোকান্বিতও হবে না' (সূরা বাকারাঃ৬২)।
অতএব নির্দ্বিধায় এবং দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলা যায় যে, ঐশীগ্রন্থ বা কুরআনের পরিপূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত অনুগত, ভদ্র বা মুসলিম হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কুরআন অনুসরণ করতে হলে প্রথমেই মাতৃভাষা বুঝতে হবে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে কুরআনকে আঁকড়ে ধরা এবং জীবনদর্শন হিসেবে ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠিত করাই নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর উম্মত দাবিদারদের জন্য বেশি প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।