পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানুষ হয়তো খুব বেশি নেই যার নাম অভিধান বা ডিকশনারিতে স্থান পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিশব্দ হিসেবে। তেমনি একজন মানুষ নরওয়ের ভিদকুন কুইজলিং। আর ইংরেজি ছঁবংষরহম শব্দের অর্থ দালাল, দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় মীরজাফর নাম বা শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, ইংরেজি ও নরওয়ের ভাষায়ও কুইজলিং নাম বা শব্দটি সেভাবে ব্যবহৃত হয়। যাকে নিয়ে এই বিতর্কিত শব্দ, তার পুরো নাম ভিদকুন আব্রাহাম লাউরিটজ জনসন কুইজলিং।
তবে কুইজলিং নামেই তার ব্যাপক পরিচিতি। ১৮৮৭ সালের ১৮ জুলাই তার জন্ম। লেখাপড়া শেষে যোগ দেন নরওয়ের সেনাবাহিনীতে। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ছিলেন রাশিয়া এবং আশপাশের বেশ কটি দেশে। দীর্ঘ নয় বছরের প্রবাস জীবন শেষে কুইজলিং নিজ দেশে ফেরেন ১৯২৯ সালে।
এরপর সোভেয়েট কমিউনিস্ট পার্টির আদলে নরওয়েতে নতুনভাবে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি নরওয়ের প্রতিরক্ষমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন এবং একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদে পরিণত হন। কালের বিবর্তনে তার নিজ দলের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকলে কুইজলিং গোপনে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলান। জার্মানির কুখ্যাত শাসক এডলফ হিটলারের ৫০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার দৃষ্টি কাড়েন কুইজলিং। পরবর্তীতে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে মিত্রবাহিনী তথা ব্রিটিশদের দ্বারা নরওয়ে আক্রমণের শিকার হলে হিটলারের সাহায্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
১৯৪০ সালের ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশরূপে ব্রিটিশ অপারেশন উইলফ্রেড শুরু হলে নরওয়েও তার নিরপেক্ষ ভূমিকা পরিত্যগ করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকালেই জার্মান বাহিনী আকাশ ও সমুদ্রপথে নরওয়ে দখলের জন্য আক্রমণ চালায়। জার্মানির পরাক্রমশালী যুদ্ধ জাহাজ 'ক্রইজার ব্লুচার' নরওয়ের দিকে দ্রুতই এগুতে থাকে। এই যুদ্ধ জাহাজে সমরাস্ত্র ও দুর্ধর্ষ জার্মান সেনাদের সঙ্গে হিটলার একদল আমলাও পাঠিয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নরওয়ে দখলের পর পরই নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু নরওয়ের গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলা আর টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়, গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে এই আগুন ছড়িয়ে পড়লে জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ক্রমেই ডুবতে থাকে হিটলারের শক্তির প্রতীক ও জার্মানের অংহকার 'ক্রইজার ব্লুচার'। এতে জার্মানিদের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও নরওয়ে দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এদিকে কুইজলিং সমমনা কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে নরওয়ের ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণের পরিকল্পনা করেন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর হিটলার কুইজলিং সমর্থন দেন। হিটলারের সমর্থন পেয়ে কুইজলিং রাজধানী ওসলোর ৫০ কিলোমিটার দূরে নিজের ঘাঁটি গড়েন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, নরওয়ের ক্ষমতাসীনরা পালিয়েছে।
পরবর্তীতে জার্মানিরা নরওয়ে দখল করে নিলে কুইজলিং তার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং নরওয়ের সেনাবাহিনীকে জার্মানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা প্রতিরোধ বন্ধের নির্দেশ দেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হিটলার কুইজলিং এর নতুন সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এদিকে নরওয়ের দৃঢ়চেতা রাজা হ্যাবন সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবন থাকতে কুইজলিংয়ের সরকারকে বৈধতা বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। চতুর হিটলার এবার নতুন কৌশলের আশ্রয় নেন। এই কৌশলের অংশ হিসেবে জার্মানির জোশেফ টারভোবেনকে নরওয়ের 'কমিশনার' নিযুক্ত করেন আর কুইজলিংকে বানানো হয় পুতুল সরকারের প্রধান।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতায় দ্রুতই বদলাতে থাকে নরওয়ের প্রেক্ষাপট। বিশ্বব্যাপী জার্মানিদের করুণ পরাজয় এবং ১৯৪৫ সালে ৩০ এপ্রিল হিটলারের আত্দহত্যার পর কুইজলিং বুঝতে পারেন দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে তার দিন। যুদ্ধ শেষে নতুন সরকার কুইজলিং এবং তার মন্ত্রীদের বন্দী করে। বন্দী অবস্থায় কয়েকবার আত্দহত্যার চেষ্টা করেন কুইজলিং। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
বিচার চলাকালে দ্রুতই ওজন কমতে থাকে কুইজলিংয়ের। সেই সঙ্গে যোগ হয় আরও অনেক রোগ। তবুও বিচার এগিয়ে চলে। অভিযোগ আর অপরাধের পাহাড় জমে তার বিরুদ্ধে। ফলে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর বিচারের রায় অনুসারে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে।
এখানেই শেষ নয়। তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে চিরবিদায় জানানো হয় নরওয়ের কুলাঙ্গার ভিদকুন কুইজলিংকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।