হামিদ মির। পাকিস্তানি সাংবাদিক। বাংলাদেশের বন্ধু। বছর দুই আগে এই কালের পুরাণ কলামে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলাম, বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য। তিনি একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছেন।
ইসলামাবাদে প্রেসক্লাবের সামনে তাঁর সেই বিখ্যাত ছবির কথাও আমরা ভুলে যাইনি; যেখানে কয়েকজন সতীর্থসহ হামিদ মির পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবিসংবলিত ব্যানার নিয়ে মিছিল করেছিলেন।
২০১১ সালে প্রথম আলো কার্যালয়ে আলাপকালে হামিদ মির আমাদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব তিনি পাকিস্তানি পার্লামেন্টে উত্থাপন করাবেনই। ইতিমধ্যে তাঁর এ উদ্যোগের প্রতি একাধিক সাংসদ সমর্থন দিয়েছেন বলেও আমাদের জানিয়েছিলেন।
এরপর এই প্রথম আলোতেই হামিদ মির কয়েকটি লেখায় তাঁর প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মন জয় করেছিলেন। তাঁর এই লড়াকু মনোভাবের পরিচয় আমরা পেয়েছি পাকিস্তানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রশ্নেও।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সমালোচনা করে তিনি আক্রান্ত হন। আমেরিকা যখন পাকিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়ে নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, তখনো তাঁকে সোচ্চার হতে দেখি।
কিন্তু সম্প্রতি উর্দু দৈনিক জং-এ প্রকাশিত ‘৯০ বছরের এক বুজুর্গের যন্ত্রণাদায়ক কারাদণ্ড’ শিরোনামের লেখাটির ভাষান্তর পড়ে কিছুটা দুঃখিত হলাম। কেননা তিনিই তো একাত্তরের গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানি সমরনায়কদের বিচারের মুখোমুখি করতে দীর্ঘদিন ধরে জনমত তৈরি করে আসছেন। তিনিই তো বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন।
তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের প্রতি সমবেদনা জানাতে পারেন না। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে হামিদ মির বলেন, অনেক পত্রিকা তাঁর লেখা বিকৃত করেছে। তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেননি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। জং এ হামিদ মিরের লেখাটি সেই রায় উপলক্ষ করেই।
একাত্তরে গোলাম আযম ছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ জামায়াতে ইসলামীর আমির। দলের সব অপকর্মের মাস্টারমাইন্ড বা মূল হোতা। স্বভাবতই বাংলাদেশের ন্যায়বিচারপ্রার্থী মানুষ আশা করেছিল, বিচারে তাঁর সর্বোচ্চ দণ্ড হবে। কিন্তু আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের জেল দিয়েছেন।
কিন্তু হামিদ মির এই বিচারের ‘ন্যায্যতা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
সে প্রশ্ন তিনি করতেই পারেন। এমনকি তিনি যে ৯০ বছর বয়সী ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত মত হিসেবেই ধরে নিই। তাঁর ভাষায়, ‘৯০ বছরের বুজুর্গ ব্যক্তির জন্য এটি যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা। ’ তবে এই যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা ব্যক্তির জন্য যতটা, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের স্বজনদের জন্য।
তাদের যন্ত্রণা কখনোই শেষ হওয়ার নয়। হামিদ মির লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের আর্মি অপারেশনে ঢাকার রাজপথে যে রক্তগঙ্গা বয়েছিল, এর দাগ কয়েক যুগ অতিক্রম করার পরও এখনো মুছে যায়নি। ...ওই আর্মি অপারেশনের কারণে সৃষ্ট ঘৃণাবোধ থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম। ’
এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু তিনি যখন গোলাম আযমকে না ভুলে যাওয়ার জন্য তাঁর দেশের সরকারকে পরামর্শ দেন, তখন মনে হয় অতীত থেকে তিনিও বেরিয়ে আসতে পারেননি।
হামিদ মির লিখেছেন, ‘আমাদের কেবল একজন গোলাম আযমকে নয়, ওই লাখো বিহারিকেও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। ’ তিনি গোলাম আযম ও বিহারিদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বলে উল্লেখ করেছেন। আবার গোলাম আযমের বিচারের ‘ন্যায্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গোলাম আযম কিংবা তাঁর দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন পাকিস্তান রক্ষার জন্য নয়, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কাজে। সে জন্য পাকিস্তানি সমরনায়কদের পাশাপাশি তাদের সহযোগীদেরও বিচার হতে হবে।
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের আমরা বিচার করতে পারিনি, সেটি অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু তাই বলে তাদের এদেশীয় দোসরদের কেন বিচার করা যাবে না? এক সাক্ষাৎকারে হামিদ মির বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উচিত এই অপরাধীদের বিচার করার জন্য একযোগে কাজ করা। আশা করব, হামিদ মির আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে সেই দাবিটি পাকিস্তানে তুলবেন।
গত মার্চে হামিদ মির ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর বাবা প্রয়াত ওয়ারিশ মিরকে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা নিতে। উল্লেখ্য, হামিদ মিরের মতো তাঁর বাবাও বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন।
একাত্তরে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি।
মার্চে দৈনিক ইত্তেফাক-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হামিদ মির বলেছিলেন, ‘৪২ বছর পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে। আমরা এই বিচার সমর্থন করি। কিন্তু বিচারটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হওয়া দরকার। পশ্চিমা গণমাধ্যম ও এনজিও এ বিচার নিয়ে যাতে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতে না পারে, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
’ (ইত্তেফাক, ২৫ মার্চ ২০১৩)। সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তরে গণহত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারকে আমি পুরো সমর্থন করি। ’ ২৭ এপ্রিল ডেইলি মোশন-এ আরেক সাক্ষাৎকারে হামিদ মির যুদ্ধাপরাধের বিচার সঠিক বলে মত দেন।
জং-এর লেখায় হামিদ মির গোলাম আযমকে ‘বুজুর্গ’ বা ধর্মীয় নেতা বলে উল্লেখ করেছেন। যদি তিনি বুজুর্গ ব্যক্তি হয়েও থাকেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তো সে কারণে কিন্তু তাঁর বিচার করেননি।
তাঁরা বিচার করেছেন একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর প্রধানের; যিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাসহ সব অপরাধমূলক কাজে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন।
হামিদ মির নিজেই জানিয়েছেন, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশিত গোলাম আযমের বাংলাদেশে জুলুমের রাজত্ব বই থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তাঁর এ নিবন্ধ লেখা। আর সে কারণেই দলটির সবকিছু তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের তত্ত্বাবধানেই ঘাতক আলবদর আলশামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল। হামিদ মির ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের ভূমিকার কথা লিখেছেন।
কিন্তু পরবর্তীকালে এই ভূমিকার জন্য জামায়াত নেতা অনুশোচনা করেছিলেন, তা কিন্তু বইয়ে উল্লেখ করেননি। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১৯৭১ সালের মার্চের আগের কোনো ঘটনার জন্য তাঁর বা জামায়াতের অন্য নেতাদের বিচার করছেন না। বিচার করছেন একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য।
একদিকে হামিদ মির পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সহযোগীদের বিচার চাইছেন, অন্যদিকে সেই বাহিনীর এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত জামায়াতের নেতাদের বিচারকে ‘অন্যায়’ বলছেন! এটিকে আমরা স্ববিরোধী বলেই মনে করি। আমার বিশ্বাস, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা এখানে যেসব জঘন্য অপরাধ করেছেন, তা জানতে পারলে হামিদ মির এই লেখা লিখতেন না।
এক দেশ সম্পর্কে অন্য দেশে বসে সবকিছু জানাও সম্ভব নয়।
হামিদ মির যেভাবে গোলাম আযমের বই থেকে তথ্যগুলো তুলে ধরেছেন, তাতে মনে হতে পারে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা সবাই একাত্তরে ঘরে চুপচাপ বসে ছিলেন। পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেওয়া ছাড়া কিছু করেননি তাঁরা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেন বিচার হচ্ছে? বিচার হচ্ছে এ কারণে যে তাঁরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্মান্তরকরণের মতো ঘৃণ্য কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কেউবা ছিলেন হুকুমদাতা।
হামিদ মির নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযানের সমালোচনা করেছিলেন। ’ তথ্যগতভাবে সেটি হয়তো অসত্য নয়। কিন্তু এরপর জামায়াত কী করেছে। তাদের নেতৃত্বেই তো আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান সামরিক ফরমানবলে আওয়ামী লীগের ৮৮ জন সাংসদের পদ শূন্য ঘোষণা করলে জামায়াতে ইসলামী সেই শূন্য পদগুলো তাদের প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করার দাবি জানিয়েছিল।
বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের হত্যা, তাদের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছেন। এসব অপরাধ ও অন্যায়ের দায় দলপ্রধান হিসেবে গোলাম আযম কীভাবে এড়াবেন?
হামিদ মির সত্যসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে যে সত্যটি বুঝতে পারেননি, তা কিন্তু নওয়াজ শরিফের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য বুঝেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, একাত্তরে গোলাম আযম সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় অস্বীকার করে পাকিস্তানকেই অস্বীকার করেছেন।
হামিদ মির যেমনটি বলেছেন, পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরপরই গোলাম আযম লন্ডনে চলে গেছেন। প্রকৃত ঘটনা তা নয়।
এখানে জামায়াতে ইসলামী তাঁকে সত্য জানতে দেয়নি বা বিভ্রান্ত করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে দেশটির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেন। তিনি সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কথা বলেছেন। লন্ডনে গিয়ে কথিত ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেছেন। এর পরও কি বলা যায়, তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিছু করেননি?
দুঃখিত, হামিদ মির।
আপনার এই লেখার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।