আধুনিক ইরানের শেষ শাহ অর্থাৎ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। পাঠকদের জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো :
আমার কৈশোরবেলার স্বপ্নপুরুষ তিনি। এক অদ্ভুত মায়া লাগে আজো তার জন্য। তার তিন-তিনজন অসাধারণ সুন্দরী, অভিজাত, আর শিক্ষিতা সম্রাজ্ঞীর মায়াবী বদন এবং একমাত্র রাজকন্যা প্রিন্সেস ফারাহনাজ ও দুই রাজপুত্র রেজা এবং আলী রেজার সঙ্গে স্বপ্ন জগতে ঢুকে মাঝে-মধ্যে কথাবার্তা বলা ছাড়া হতদরিদ্র বাংলাদেশের এক উৎসুক তরুণের আর কি-ই বা করার ছিল। আমি যার কথা বলছি- তিনি হলেন আধুনিক ইরানের শেষ শাহ অর্থাৎ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী।
তাবৎ দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী আর প্রভাবশালী শাহী রক্তের ধারক ছিলেন তিনি। তার বংশ গত আড়াই হাজার বছর ধরে কালকে এবং কখনো-সকনো মহাকালকে অবাক করে দিয়ে জমিনের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিল। শুরুটা করেছিলেন তারই পূর্বপুরুষ মহামতি সাইরাস আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে। সেই বংশের শেষ সম্রাট ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশবাসীর কাছে কীভাবে পরাজিত হয়ে ইরান ত্যাগ করেছিলেন তার নেপথ্য কাহিনী শুনলে বাংলাদেশের পাঠকরা হয়তো অনেক কিছুর আভাস পেয়েও যেতে পারেন।
তখনো রেজা শাহ পাহলভী ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান।
সর্বময় ক্ষমতা ছিল পার্লামেন্টের হাতে এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সেই ক্ষমতা ভোগ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইরানে ব্যাপক আকারে তেল ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, যার মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। ঠিক এই সময়টিতে মোসাদ্দেক নামক জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা দেশের সব তেল সম্পদ জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্রিটেনে তখন উইনস্টন চার্চিল ক্ষমতায় আর যুক্তরাষ্ট্রে ট্রম্যান। মোসাদ্দেকের জয়লাভের ফলে দুই ক্ষমতাশালীর মাথায় বাজ পড়ল।
শুরু হলো মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার নীল নকশা।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা 'সিআইএ' এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা 'এসআইএস' লন্ডনে বসে যৌথ পরিকল্পনা করল। প্রেসিডেন্ট থিউডর রুজভেল্টের নাতি কার্মিট রুজভেল্ট তখন সিআইএ প্রধান। তিনি উড়ে এলেন লন্ডনে। প্রণীত হলো অপারেশন 'অ্যাজাঙ্'-এর নীল নকশা।
পরিকল্পনা মতে ইরানি সেনাবাহিনীতে ঘটানো হলো অভ্যুত্থান। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক পদচ্যুত হলেন। তার স্থানে আজ্ঞাবহ জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে নিয়োগ দেওয়া হলো। কিন্তু মূল ক্ষমতা রাখা হলো ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যের দোসর শাহেন শাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর কাছে।
এ ঘটনার এক দিনের মাথায় সেনাবাহিনীতে একটি কাউন্টার অভ্যুত্থান হলো।
অভ্যুত্থানকারীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে উদ্ধার করলেন। অন্যদিকে শাহ পালিয়ে গেলেন বাগদাদে এবং তারপর ইতালিতে। কিন্তু এর দুই দিন পর আরও একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটানো হয় সেনাবাহিনীতে। ফলে মার্কিন ব্রিটিশের নীল নকশা অপারেশন অ্যাজাঙ্ এবার সফল হয় শতভাগ। শাহ ইরানে ফিরে আসেন চটজলদি।
এসব ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৩ সালে।
পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের নিরঙ্কুশ সর্বময় ক্ষমতা ছিল শাহের হাতে। তার ইঙ্গ-মার্কিন মদদদাতারা অনবরত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন তাকে। ফলে তার পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রতিদিন রাজপথে শত শত মানুষকে গুলি করে মারছিল। অথচ ১৯৫৩ সালের পর থেকে ইরানে যে অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছিল তাতে জনগণের খুশি বা সন্তুষ্ট থাকার কথা ছিল এবং তারা তা ছিলও।
কিন্তু শাহের কতিপয় ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রচলন দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই বিক্ষোভই অগি্নগর্ভে রূপ নেয় ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে।
এবার আমি বলছি কেন ইরানের লোকজন শত সহস্র উন্নয়নের পরও এত রাগ করল। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তেহরান শহরে কোনো পাবলিক বাসে দাড়ি-টুপিধারী মুসলি্ল উঠলেই কন্ডাক্টর টিটকারী করে বলত- আমরা আলেম আর বেশ্যাদের বাসে চড়াই না।
রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠেছিল মদের দোকান। শহর ও শহরতলিতে শত শত নাইটক্লাবে চলত রাতব্যাপী ডিস্কো পার্টির নামে মদ্যপান, জুয়া আর অবাধ যৌনাচার।
শাহ নিজেও ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার স্ত্রী, সন্তানরাও পশ্চিমা ধাঁচে চলতেন। শাহ এবং তার স্ত্রী সব রাজকীয় অনুষ্ঠান এবং দেশি-বিদেশি সরকারি অনুষ্ঠানসমূহে পশ্চিমাদের পোশাক পরতেন।
এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দিনকে দিন ফুঁসে উঠতে থাকেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ছিলেন একজন অপরিচিত ধর্মীয় ইমাম। মুসলমানদের এই মনের কষ্ট তিনি বুঝতে পেরে শিয়াদের ধর্মীয় শহর নাজাফে একটি জনসভা আহ্বান করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ হয় সেখানে। শাহের সরকার প্রথমে এই বিশাল সমাবেশকে মোটেই গুরুত্ব দিল না।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকল দ্রুত। তেহরানের রাস্তায় বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা নেমে এলো। সংখ্যায় ছিল তারা অগণিত। সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোক তেহরানে জমায়েত হয়।
তারিখটি ছিল ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। শাহের বাহিনী বিশাল জনসমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। আপাতত লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিন্তু দিবসটিকে ইরানের ইতিহাসে কুখ্যাত ব্লাক ফ্রাইডে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্লাক ফ্রাইডের পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত সিআইএ এজেন্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে সিআইএ হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করেন যে, ৮ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর শাহের শাসনক্ষমতা এতটাই সুদৃঢ় হয়েছে যে, আগামী ১০ বছরে বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অথচ এর মাত্র ৩ মাসের মাথায় অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে মাত্র এক দিনের গণ-অভ্যুত্থানে শাহের পতন হয়।
পরিবার-পরিজন নিয়ে শাহ দেশ থেকে পালিয়ে যান। তার দীর্ঘদিনের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। তিনি প্রথমে ইতালি যান। কিন্তু ইতালি তাকে অসম্মানজনকভাবে বিদেয় করে দেয়। এর পর তার বিমান উড়াল দিল পানামায়।
সেখানকার সরকারও গ্রহণ করল না। অনেক দেন-দরবার এবং অনুনয়-বিনয় করার পর মিসর তাকে সাময়িকভাবে সেই দেশে ঢোকার অনুমতি দিয়েছিল একটি কারণে। প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে বোঝানো হলো যে- শাহের প্রথম স্ত্রী ফৌজিয়া ছিলেন মিসরের প্রয়াত এবং ক্ষমতাচ্যুত বাদশাহ ফারুকের বোন। এই রাজপরিবারের প্রতি তখনো মিসরের জনগণের বেশ সহানুভূতি অবশিষ্ট ছিল। কাজেই মিসরের রাজকন্যার স্বামী ভিক্ষুকের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে সেটা মিসরবাসীর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
শাহ ফিরে এলেন কায়রোতে। তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল। নানা রকম হতাশা আর ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে তিনি বেশিদিন জীবনটাকে টেনে নিতে পারলেন না। ফলে কায়রোর একটি হোটেলে তিনি মারা যান ১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই, যখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৬০ বছর।
ক্ষমতার শেষ দিকে সম্রাট অতিমাত্রায় অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিলেন।
নিজের বংশ আর রাজ রক্তের অহমিকায় তিনি লোকজনকে মানুষ বলেই মনে করতেন না। কথায় কথায় লোকজনকে অসম্মান করতেন। খোটা দিয়ে কথা বলতেন। দেশের সেনাবাহিনী বা বেসামরিক প্রশাসনের বড় কর্মকর্তাদের পরিবর্তে তিনি মার্কিন এবং ব্রিটিশ দূতাবাসের কুকুরকে বেশি মর্যাদা দিতেন। মার্কিন ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে তিনি দ্বিতীয় খোদা ভাবতেন।
তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ইরানের জনগণ তাকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসে। কিন্তু জনগণ যে তাকে এবং তার পরিবারকে কি পরিমাণ ঘৃণা করত তা বোঝার বোধশক্তি তিনি হয়তো খোদায়ী গজবের কারণে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার মৃত্যুর ৩৫ বছর পরও ইরানবাসী শাহের নাম উচ্চারিত হলে ঘৃণাভরে থু থু ছিটায়। আজো তার পরিবারের লোকজন জনগণের ক্ষোভের কারণে ইরানে যায় না। অথচ ইরান সরকারের এ বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ পর্যন্ত নেই।
ইরানের সেই দিনের প্রেক্ষাপট আর আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনার যে ইচ্ছা লেখার শুরুতে মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল তা আর কেন জানি মাথা থেকে বের হচ্ছে না। আমার নির্বোধ কলম কিছুতেই পাঠকদের নতুন সমীকরণের যোগফল মিলিয়ে দিতে পারল না। আমি দুঃখিত এবং খুবই দুঃখিত একটি অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক ইতিহাসের উপাখ্যান পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।