রাহেলা বেগম (৩৫)। তিন সন্তানের জননী। অন্যের বাসায় বুয়ার কাজ করেন। বাড্ডার এক বস্তিতে রিক্সাচালক স্বামী নিয়ে থাকেন। ১ বছর ধরে মাঝে মাঝেই তার মাসিকে রাস্তা দিয়ে রক্ত পড়ছে।
মাসে এ রকম কয়েকবার করে রক্ত পড়ছে। স্বামীর সাথে সহবাসের সময়ও রক্ত পড়ে। রক্ত বেশ দুর্গন্ধযুক্ত। আপনা আপনি এ সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি কোন চিকিৎসা নেন নি। এ সমস্যা না কাটায় স্থানীয় এক কবিরাজের শরণাপন্ন হলে তাকে পানি পড়া খেতে দিলেন কিছু দিন।
তাতেও তার সমস্যা কমলো না, বরং বেড়েই চলল। এদিকে স্বামীর সাথে ঠিকমত সংসার করতে না পারায় স্বামী দ্বারা নির্যাতনও বেড়ে গেল। স্বামীর হাতে পায়ে ধরে একজন গাইনি চিকিৎসককে দেখালে তিনি জরায়ু মুখের ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করে মহাখালী ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে রেফার্ড করলেন। সেখানের চিকিৎসক তাকে দেখে জানালেন রাহেলাকে কোন চিকিৎসায় দেয়া সম্ভব নয়। ক্যান্সার তার দেহে ছড়িয়ে গেছে।
এদিকে রাহেলার অবস্থা আরোও খারাপ হতে থাকল। স্বামীও ঠিকমত দেখতে পারে না। সব নির্যাতন সহ্য করে অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে দুমুঠো ভাত জোড়ার করছে সে। আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে ধীরে ধীরে। এটা আমাদের দেশের একটি সাধারনত ঘটনা হয়ে দাড়ায়েছে।
প্রতিবছর আমাদের দেশে ১২হাজার ৫শ নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এর মধ্যে ৬৫০০ মারা যান। প্রতি ঘন্টায় ১ জন করে মারা যান। অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার বা সারভিক্যাল ক্যান্সার বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। প্রতিবছর ৪ রাখ ৭০ হাজার নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
যার মধ্যে মারা যায় ২ লাখ ৩৩ হাজার। আর মারা যাওয়া নারীদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের নারী। এ ক্যান্সার ভয়াবহ হলেও সঠিক সময়ে রোগটি ধরতে পারলে কিন্তু এ ক্যান্সার থেকে সহজেই মুক্তি মেলে। এটা একমাত্র ক্যান্সার যেটা প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করতে পারলে পুরোপুরি ভাল হয়ে যায়। এমনকি আক্রান্ত মহিলারা বাচ্চাও নিতে পারে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সারের কারণ ঃ
জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রামণ। এ ভাইরাসের অনেকগুলো প্রকরণ আছে। এগুলোর সবগুলোই কিন্তু জরায়ু মুখের ক্যান্সার করে না। কিছু কিছু প্রকরণ আছে যেগুলো ক্যান্সার করে। কিছু কিছু ভাইরাস যৌনাঙ্গে ওয়ার্ট বা ছোট ছোট আচিলের মত করে রোগ করে থাকে আর রেশিরভাগ কোন ইনফেকশনই করেনা।
এক গবেষনায় দেখা গেছে আমেরিকার ৫০ বছরের মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই কোন কোন সময় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সবার ক্যান্সার হয় নাই। খারাপ প্রকরণের ভাইরাসের সংক্রামনেই এ ক্যান্সার হয়েছে। শুধু মহিলারাই নয় পুরুষরাও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তবে তাদের যৌনাঙ্গে ওয়ার্ট হয় কিন্তু ক্যান্সার হয় না।
এ ভাইরাসে আক্রান্ত কারোও সাথে যৌন মিলনে অন্যজনে ছড়ায়।
এ বছর আপনি কি প্যাপ স্মেয়ার করেছেন?
ভাইরাসের আক্রান্ত জরায়ুর কোষগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়, একে বলে ডিসপ্লাশিয়া। এই পরিবর্তিত কোষগুলি পরে ক্যান্সার কোষে পরিনত হয়। সুখের কথা হল, পরিবর্তিত কোষগুলি ক্যান্সার কোষে পরিবর্তিত হতে অনেক সময় লাগে। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৮ বছর সময় লাগে।
কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে যদি ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে ক্যান্সার আক্রান্তরা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। কোষের এ পরিবর্তন নির্ণয় করা যায় খুবই একটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে যার নাম প্যাপ স্মেয়ার। এতে কাটা ছেড়া করার প্রয়োজন পড়ে না। জরায়ুর মুখ থেকে একটু খানি টিস্যু নিয়ে নির্ণয় করা যায় জরায়ুর কোষগুলো পরিবর্তন হচ্ছে কি না? যদি পরীক্ষায় ধরা পড়ে কোষগুলো কেবল ডিসপ্লাস্টিক বা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বা এমনকি ক্যান্সারেও পরিনত হয়েছে কিন্তু দেহে এখনও ছড়িয়ে পড়ে নাই তবে চিকিৎসকরা চিকিৎসার মাধ্যমে আক্রান্ত নারীকে সুস্থ করে তুলতে পারেন।
কিন্তু সারা দেহে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। ভয়াবহ হলেও জরায়ু ক্যান্সার আমাদের কিন্তু চিকিৎসা করার যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। অথচ আমাদের না জানার কারণে আজ অনেক উচ্ছল প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে হলে যৌনক্ষমতা বা যৌনমিলন শুরুর পর থেকে তিন বছরের মধ্যে প্রতিটি মহিলাকে একবার প্যাপ স্মেয়ার করে বাকী জীবনের প্রতিবছরে একবার করে এ পরীক্ষা করা দরকার। গবেষনায় দেখা গেছে, প্যাপ স্মেয়ার করার কারণে আমেরিকায় প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মহিলার জরায়ু কোষ পরিবতির্ত বা ডিসপ্লাস্টিক অবস্থায় ধরা পড়ে।
১২ হাজার নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর ৪ হাজার মারা যায়। গত ৫ বছরে যারা একবারও প্যাপ স্মেয়ার করেনি তাদের মারা যাওয়ার হার বেশি। গবেষনায় আরোও দেখা গেছে যেসব মহিলা প্রতিবছরে একবার প্যাপ স্মেয়ার করান তাদের এ ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ঝুকি ৪১ শতাংশ কমে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে গত ৪০ বছরে এ ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমে গেছে শুধু নিয়মিত স্ক্রিনিং বা প্যাপ স্মেয়ার পরীক্ষা করার কারনে। এ ছাড়াও ক্যান্সার নির্ণয় করতে আছে কলপোসকপি পরীক্ষা।
জেনে নিন ক্যান্সারের লক্ষণ ঃ
প্রাথমিক অবস্থায় জরায়ু মুখ ক্যান্সারে আক্রান্তদের লক্ষণ থাকে না বলেই চলে। ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি ও দেহে ছড়িয়ে পড়লে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এক্ষেত্রে মাসিক সময় ছাড়াও যোনিপথে সাদা বা ধুসর বর্ণের দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হতে পারে। মাঝে মাঝে রক্তও পড়তে পারে। মাসিকের সময় অনেকদিন ধরে রক্ত যাওয়া, কিছুদিন পর পরই রক্ত যাওয়া এ ক্যান্সারের প্রথম লক্ষন।
রক্ত পড়তে যৌন মিলনের সময়, শৌচকার্যের সময় বা সামান্য আঘাতেই রক্তপাত হতে পারে। এছাড়াও হতে পারে যৌন মিলনের সময় অস্বস্থি ও ব্যথা, তলপেটে ব্যথা। ক্যান্সার আরোও ছড়িয়ে পড়লে রক্তস্বল্পতা, তলপেটে সবসময় ব্যথা, ওজন কমে যাওয়াসহ প্রশাবে সমস্যা হতে পারে।
চিকিৎসা ঃ
আগেই বলা হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় এ ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই ভাল। রোগী পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে।
ক্যান্সার দেহে কি পরিমান ছড়িয়ে গেছে তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে। আর এটা নির্ধারণ করার জন্য আছে পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, সিটিস্ক্যান ও টিস্যু বায়োপসি। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আছে সার্জারী, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। রোগের অবস্থাভেদে এদের কোন একটি বা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সার্জারীর মাধ্যমে জরায়ুর কিছু অংশ বা পুরো অংশ ফেলে দেয়া হয়।
তবে চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিবেন। এছাড়াও দেয়া যেতে পারে ইন্টারফেরন। যদি উপসর্গ ধরা পড়ে তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক সময় চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। মৃত্যু জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া রোগীর কিছুই করার থাকে না।
প্রতিরোধ করুন জরায়ু মুখের ক্যান্সার ঃ
সচেতনতা গড়ে তুললে ও নারীরা স্বাস্থ্য সচেতন হলে জরায়ু মুখের ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব অনায়াশেই।
ক্স নিরাপদ যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলুন। স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্থ থাকুন। গবেষনায় দেখা গেছে, যারা নিজেরা ও স্বামী একাধিক যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে তাদের এ ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
ক্স সাধারনত ২৫-৪৫ বছরের নারীদের এ ক্যান্সার বেশি হয়। তাই এ সময় নিয়মিত প্যাপ স্মেয়ার করুন। ক্যান্সারের কোন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন একটা দিন অবহেলায় নষ্ট করার জন্য আপনি চিকিৎসায় থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
ক্স কম বয়সে বিয়ে, কম বয়সে যৌন মিলন, কম বয়সে সন্তান ধারণ ও বেশি সংখ্যক সন্তান নিলে ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ে।
এগুলো পরিহার করুন।
ক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষনায় দেখা গেছে যে, জন্ম নিয়ন্ত্রন পিল যত বেশি সময় ধরে খাওয়া হয় ও যত বেশি পরিমানে ইস্ট্রোজেন ব্যবহার করা হয় ক্যান্সারের ঝুকি তত বাড়ে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রন পিল পরিহার করুন।
ক্স পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন। যৌনাঙ্গ পরিচ্ছন্ন রাখুন।
ক্স ধুমপান করবেন না। ধুমপান করলে জরায়ু মুখের কোষগুলো দ্রুত ক্যান্সার কোষে পরিনত হয়।
ক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষনায় দেখা গেছে জরায়ু মুখ ক্যান্সারের টিকা গ্রহন করার ফলে বিশ্বব্যাপী এ ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে টিকা নিন। ৯-২৫ বয়সী নারীদের যে কেউ এ ভ্যাকসিন নিতে পারে।
তবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগেই এ ভ্যাকসিন নেয়া দরকার, এতে ভ্যাকসিন ভাল কাজ করে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন ২৬ বছর পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে। আমাদের দেশে ৪৫ বছর পর্যন্ত টিকা নেয়া ব্যাপারে চিকিৎসকরা সুপারিশ করেন। তিনটি টিকা দেয়া হয়। প্রথমটি যে কোন দিন দিতে হয়।
পরের টিকা ১ মাস পরে ও তৃতীয়টি দেয়া হয় ২য় টি দেয়ার ৬ মাস পর। টিকা মাংসপেশীতে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেয়া হয়। তবে গর্ভাবস্থায় এ ভ্যাকসিন নেয়া ঠিক নয়। সন্তান প্রসবের পর ভ্যাকসিন নেয়া যেতে পারে। দেরী না করে ভ্যাকসিন নেয়ার ব্যাপারে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
রাহেলা বেগম (৩৫)। তিন সন্তানের জননী। অন্যের বাসায় বুয়ার কাজ করেন। বাড্ডার এক বস্তিতে রিক্সাচালক স্বামী নিয়ে থাকেন। ১ বছর ধরে মাঝে মাঝেই তার মাসিকে রাস্তা দিয়ে রক্ত পড়ছে।
মাসে এ রকম কয়েকবার করে রক্ত পড়ছে। স্বামীর সাথে সহবাসের সময়ও রক্ত পড়ে। রক্ত বেশ দুর্গন্ধযুক্ত। আপনা আপনি এ সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি কোন চিকিৎসা নেন নি। এ সমস্যা না কাটায় স্থানীয় এক কবিরাজের শরণাপন্ন হলে তাকে পানি পড়া খেতে দিলেন কিছু দিন।
তাতেও তার সমস্যা কমলো না, বরং বেড়েই চলল। এদিকে স্বামীর সাথে ঠিকমত সংসার করতে না পারায় স্বামী দ্বারা নির্যাতনও বেড়ে গেল। স্বামীর হাতে পায়ে ধরে একজন গাইনি চিকিৎসককে দেখালে তিনি জরায়ু মুখের ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করে মহাখালী ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে রেফার্ড করলেন। সেখানের চিকিৎসক তাকে দেখে জানালেন রাহেলাকে কোন চিকিৎসায় দেয়া সম্ভব নয়। ক্যান্সার তার দেহে ছড়িয়ে গেছে।
এদিকে রাহেলার অবস্থা আরোও খারাপ হতে থাকল। স্বামীও ঠিকমত দেখতে পারে না। সব নির্যাতন সহ্য করে অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে দুমুঠো ভাত জোড়ার করছে সে। আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে ধীরে ধীরে। এটা আমাদের দেশের একটি সাধারনত ঘটনা হয়ে দাড়ায়েছে।
প্রতিবছর আমাদের দেশে ১২হাজার ৫শ নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এর মধ্যে ৬৫০০ মারা যান। প্রতি ঘন্টায় ১ জন করে মারা যান। অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার বা সারভিক্যাল ক্যান্সার বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। প্রতিবছর ৪ রাখ ৭০ হাজার নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
যার মধ্যে মারা যায় ২ লাখ ৩৩ হাজার। আর মারা যাওয়া নারীদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের নারী। এ ক্যান্সার ভয়াবহ হলেও সঠিক সময়ে রোগটি ধরতে পারলে কিন্তু এ ক্যান্সার থেকে সহজেই মুক্তি মেলে। এটা একমাত্র ক্যান্সার যেটা প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করতে পারলে পুরোপুরি ভাল হয়ে যায়। এমনকি আক্রান্ত মহিলারা বাচ্চাও নিতে পারে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সারের কারণ ঃ
জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রামণ। এ ভাইরাসের অনেকগুলো প্রকরণ আছে। এগুলোর সবগুলোই কিন্তু জরায়ু মুখের ক্যান্সার করে না। কিছু কিছু প্রকরণ আছে যেগুলো ক্যান্সার করে। কিছু কিছু ভাইরাস যৌনাঙ্গে ওয়ার্ট বা ছোট ছোট আচিলের মত করে রোগ করে থাকে আর রেশিরভাগ কোন ইনফেকশনই করেনা।
এক গবেষনায় দেখা গেছে আমেরিকার ৫০ বছরের মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই কোন কোন সময় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সবার ক্যান্সার হয় নাই। খারাপ প্রকরণের ভাইরাসের সংক্রামনেই এ ক্যান্সার হয়েছে। শুধু মহিলারাই নয় পুরুষরাও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তবে তাদের যৌনাঙ্গে ওয়ার্ট হয় কিন্তু ক্যান্সার হয় না।
এ ভাইরাসে আক্রান্ত কারোও সাথে যৌন মিলনে অন্যজনে ছড়ায়।
এ বছর আপনি কি প্যাপ স্মেয়ার করেছেন?
ভাইরাসের আক্রান্ত জরায়ুর কোষগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়, একে বলে ডিসপ্লাশিয়া। এই পরিবর্তিত কোষগুলি পরে ক্যান্সার কোষে পরিনত হয়। সুখের কথা হল, পরিবর্তিত কোষগুলি ক্যান্সার কোষে পরিবর্তিত হতে অনেক সময় লাগে। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৮ বছর সময় লাগে।
কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে যদি ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে ক্যান্সার আক্রান্তরা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। কোষের এ পরিবর্তন নির্ণয় করা যায় খুবই একটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে যার নাম প্যাপ স্মেয়ার। এতে কাটা ছেড়া করার প্রয়োজন পড়ে না। জরায়ুর মুখ থেকে একটু খানি টিস্যু নিয়ে নির্ণয় করা যায় জরায়ুর কোষগুলো পরিবর্তন হচ্ছে কি না? যদি পরীক্ষায় ধরা পড়ে কোষগুলো কেবল ডিসপ্লাস্টিক বা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বা এমনকি ক্যান্সারেও পরিনত হয়েছে কিন্তু দেহে এখনও ছড়িয়ে পড়ে নাই তবে চিকিৎসকরা চিকিৎসার মাধ্যমে আক্রান্ত নারীকে সুস্থ করে তুলতে পারেন।
কিন্তু সারা দেহে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। ভয়াবহ হলেও জরায়ু ক্যান্সার আমাদের কিন্তু চিকিৎসা করার যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। অথচ আমাদের না জানার কারণে আজ অনেক উচ্ছল প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে হলে যৌনক্ষমতা বা যৌনমিলন শুরুর পর থেকে তিন বছরের মধ্যে প্রতিটি মহিলাকে একবার প্যাপ স্মেয়ার করে বাকী জীবনের প্রতিবছরে একবার করে এ পরীক্ষা করা দরকার। গবেষনায় দেখা গেছে, প্যাপ স্মেয়ার করার কারণে আমেরিকায় প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মহিলার জরায়ু কোষ পরিবতির্ত বা ডিসপ্লাস্টিক অবস্থায় ধরা পড়ে।
১২ হাজার নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর ৪ হাজার মারা যায়। গত ৫ বছরে যারা একবারও প্যাপ স্মেয়ার করেনি তাদের মারা যাওয়ার হার বেশি। গবেষনায় আরোও দেখা গেছে যেসব মহিলা প্রতিবছরে একবার প্যাপ স্মেয়ার করান তাদের এ ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ঝুকি ৪১ শতাংশ কমে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে গত ৪০ বছরে এ ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমে গেছে শুধু নিয়মিত স্ক্রিনিং বা প্যাপ স্মেয়ার পরীক্ষা করার কারনে। এ ছাড়াও ক্যান্সার নির্ণয় করতে আছে কলপোসকপি পরীক্ষা।
জেনে নিন ক্যান্সারের লক্ষণ ঃ
প্রাথমিক অবস্থায় জরায়ু মুখ ক্যান্সারে আক্রান্তদের লক্ষণ থাকে না বলেই চলে। ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি ও দেহে ছড়িয়ে পড়লে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এক্ষেত্রে মাসিক সময় ছাড়াও যোনিপথে সাদা বা ধুসর বর্ণের দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হতে পারে। মাঝে মাঝে রক্তও পড়তে পারে। মাসিকের সময় অনেকদিন ধরে রক্ত যাওয়া, কিছুদিন পর পরই রক্ত যাওয়া এ ক্যান্সারের প্রথম লক্ষন।
রক্ত পড়তে যৌন মিলনের সময়, শৌচকার্যের সময় বা সামান্য আঘাতেই রক্তপাত হতে পারে। এছাড়াও হতে পারে যৌন মিলনের সময় অস্বস্থি ও ব্যথা, তলপেটে ব্যথা। ক্যান্সার আরোও ছড়িয়ে পড়লে রক্তস্বল্পতা, তলপেটে সবসময় ব্যথা, ওজন কমে যাওয়াসহ প্রশাবে সমস্যা হতে পারে।
চিকিৎসা ঃ
আগেই বলা হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় এ ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই ভাল। রোগী পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে।
ক্যান্সার দেহে কি পরিমান ছড়িয়ে গেছে তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে। আর এটা নির্ধারণ করার জন্য আছে পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, সিটিস্ক্যান ও টিস্যু বায়োপসি। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আছে সার্জারী, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। রোগের অবস্থাভেদে এদের কোন একটি বা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সার্জারীর মাধ্যমে জরায়ুর কিছু অংশ বা পুরো অংশ ফেলে দেয়া হয়।
তবে চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিবেন। এছাড়াও দেয়া যেতে পারে ইন্টারফেরন। যদি উপসর্গ ধরা পড়ে তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক সময় চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। মৃত্যু জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া রোগীর কিছুই করার থাকে না।
প্রতিরোধ করুন জরায়ু মুখের ক্যান্সার ঃ
সচেতনতা গড়ে তুললে ও নারীরা স্বাস্থ্য সচেতন হলে জরায়ু মুখের ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব অনায়াশেই।
ক্স নিরাপদ যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলুন। স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্থ থাকুন। গবেষনায় দেখা গেছে, যারা নিজেরা ও স্বামী একাধিক যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে তাদের এ ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
ক্স সাধারনত ২৫-৪৫ বছরের নারীদের এ ক্যান্সার বেশি হয়। তাই এ সময় নিয়মিত প্যাপ স্মেয়ার করুন। ক্যান্সারের কোন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন একটা দিন অবহেলায় নষ্ট করার জন্য আপনি চিকিৎসায় থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
ক্স কম বয়সে বিয়ে, কম বয়সে যৌন মিলন, কম বয়সে সন্তান ধারণ ও বেশি সংখ্যক সন্তান নিলে ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ে।
এগুলো পরিহার করুন।
ক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষনায় দেখা গেছে যে, জন্ম নিয়ন্ত্রন পিল যত বেশি সময় ধরে খাওয়া হয় ও যত বেশি পরিমানে ইস্ট্রোজেন ব্যবহার করা হয় ক্যান্সারের ঝুকি তত বাড়ে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রন পিল পরিহার করুন।
ক্স পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন। যৌনাঙ্গ পরিচ্ছন্ন রাখুন।
ক্স ধুমপান করবেন না। ধুমপান করলে জরায়ু মুখের কোষগুলো দ্রুত ক্যান্সার কোষে পরিনত হয়।
ক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষনায় দেখা গেছে জরায়ু মুখ ক্যান্সারের টিকা গ্রহন করার ফলে বিশ্বব্যাপী এ ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে টিকা নিন। ৯-২৫ বয়সী নারীদের যে কেউ এ ভ্যাকসিন নিতে পারে।
তবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগেই এ ভ্যাকসিন নেয়া দরকার, এতে ভ্যাকসিন ভাল কাজ করে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন ২৬ বছর পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে। আমাদের দেশে ৪৫ বছর পর্যন্ত টিকা নেয়া ব্যাপারে চিকিৎসকরা সুপারিশ করেন। তিনটি টিকা দেয়া হয়। প্রথমটি যে কোন দিন দিতে হয়।
পরের টিকা ১ মাস পরে ও তৃতীয়টি দেয়া হয় ২য় টি দেয়ার ৬ মাস পর। টিকা মাংসপেশীতে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেয়া হয়। তবে গর্ভাবস্থায় এ ভ্যাকসিন নেয়া ঠিক নয়। সন্তান প্রসবের পর ভ্যাকসিন নেয়া যেতে পারে। দেরী না করে ভ্যাকসিন নেয়ার ব্যাপারে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।