মেঘের দেশের মেঘবালিকা, মেঘের ছোঁয়ায় সূর্য ঢাকা
ঘটনা প্রবাহ ১:
নাজমুন আক্তার। একজন আদর্শ গৃহিণী, একই সাথে একজন সফল মা। তাদের একমাত্র মেয়ে মুন এর বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় চার মাস হল। এমন কিছু বেশীদিন হয়নি। কিন্তু মেয়েকে ছাড়া মায়ের দিন গুলো আর কাটতেই চাইছে না।
পুরোনো দিনের কথা গুলো আজ খুব মনে পরছে নাজমুন আক্তারের। একমাত্র মেয়ে মুন। মুনের জন্মের পর চাকরি আর চালিয়ে যেতে পারেন নি নাজমুন আক্তার। মুনের বাবা বড় চাকরি করেন। তার একার রোজগারে ভাল ভাবেই চলে যায় তিন জনের ছোট্ট সংসারটা।
মুনের বয়স দেড় বছর হওয়ার পর নাজমুন আক্তার চেয়েছিলেন নতুন করে চাকরি শুরু করতে। কিন্তু এত বড় একটা বিরতির পর চাকরি পাওয়া টা তার জন্য সহজ হয়নি। তাছাড়া মুনের বাবার ও আর ইচ্ছে নেই নাজমুন আক্তার চাকরি টা করুক, যখন বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চার বাবা মা ছাড়া দিনের অনেক টা সময় থাকার প্রশ্ন টা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মায়ের ও মন খুব একটা সাহস পাচ্ছে না মেয়েকে একা রেখে চাকরি তে যেতে। মুনের বাবাই তখন সহজ সমাধান করে দিলেন।
মেয়েটা কে মানুষের মত মানুষ করাটা বেশী জরুরী। তাই মেনে নিলেন নাজমুন আক্তার। যথাসময়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করালেন। মায়ের মনতো মানতে চায় না, তাই নিজেই প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতেন, আবার নিয়ে আসতেন। আস্তে আস্তে মুনের ক্লাস বাড়তে থাকল, পড়াশুনা বাড়তে থাকল, সেই সাথে বাড়তে থাকল নাজমুন আক্তারের ব্যস্ততাও।
পুরোটা সময়ই বলতে গেলে মেয়ের পিছনে ব্যয় করেন তিনি। মেয়েটাই তার জগত। তার অস্তিত্ব। আস্তে আস্তে মেয়ে বড় হল। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল।
ডাক্তারী পাস করে বের হল। ভাল দেখে বিয়েও দেয়া হল। মুনের বাবার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই মেয়েকে মানুষ করার পিছনে তার থেকে তার স্ত্রীর ভূমিকা ই মুখ্য। কিন্তু আজ নাজমুন আক্তার বড় একা। মেয়ে তার সংসার আর হসপিটাল নিয়ে ব্যস্ত।
স্বামী চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এখন তার আর কোন ব্যস্ততা নেই। সব ব্যস্ততা মেয়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল! আজ একটা প্রশ্ন খুব মনে আসছে…মেয়েকে একা রাখতে পারবেন না বলে চাকরি ছেড়েছিলেন। আজ মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার একাকিত্ব কে ঘুচাবে এখন? সংসার সন্তানের জন্য নিজের সব বিসর্জন দিয়েছিলেন।
বিনিময়ে তিনি কি পেলেন? শেষ বয়সের এই নিষ্ঠুর একাকিত্ব?
ঘটনা প্রবাহ ২:
ডাক্তার মুন। তার স্বামীও একজন ডাক্তার। একমাত্র মেয়ে চন্দ্রা। মেয়ের জন্মের আট মাসের মাথায় বুয়ার কাছে মেয়ের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজ পেশায় ফিরে যান ডাক্তার মুন। সারাদিনের ব্যাস্ততার পর অনেক রাতে মেয়েকে কাছে পান তিনি।
মেয়ে অবশ্য তখন ঘুমিয়ে পরে। খারাপ লাগে তার। কিন্তু উপায় কি? এত পড়াশুনা করেও যদি নিজের ক্যারিয়ার টা উজ্জ্বল করতে না পারেন তো খামাখা এত পরিশ্রমের কি দরকার ছিল? আর মা কাছে না থাকলেও মেয়েকে দেখাশুনা করার মত লোক তো আছে! মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়। এক সময় ভাল স্কুলেও ভর্তি হয়। পড়াশুনা বাড়তে থাকে।
ভালো পড়াশুনার জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়। কিন্তু তারপর ও চন্দ্রা অনেক একা। সে কারো সাথেই মিশতে পারে না। মনের কথা গুলো শুনার মত কেউ নেই তার আশেপাশে। এমন কি ছুটির দিনটাতেও সে বাবা মা কে কাছে পায় না।
অসহ্য লাগে চন্দ্রার। মা কিন্তু প্রতিদিন ই রাতে বাড়ি ফিরে আগে তার রুমে আসে। তারপর ও…একদিন বিদ্রোহী হয়ে উঠে চন্দ্রার মন। মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসে। সারাদিনের ক্লান্তির পর মায়ের ও মেজাজ ঠিক থাকে না।
ঠাস করে চড় লাগিয়ে দেন মেয়ের গালে। এরপর দুই দিন মা-মেয়ের কথা বন্ধ। এই শুরু। তারপর এরকম ঘটনা প্রায় ই ঘটতে থাকে। এখন বলতে গেলে মাসের বেশির ভাগ সময় ই মা-মেয়ের কথা বন্ধ থাকে।
বিরূপ প্রভাব পরে চন্দ্রার রেজাল্টের উপর। আস্তে আস্তে রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। মুন সব ই জানতে পারেন, কিন্তু কিছুই বলেন না মেয়েকে। কারন তিনি এটাও জানেন, এর পিছনে মেয়েকে তার সময় না দেয়াটাই মুখ্য। আজ তার মনে হয়, কি হল এত ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে? একমাত্র মেয়েই যদি মানুষ না হল? নিজের ক্যারিয়ারের উন্নতির চরম শিখরে বসে আজ তার সব ই অর্থহীন লাগে।
_____________________________________________
উপরের দুটি ঘটনাই সামান্য পরিবর্তিত রূপে কম বেশী অনেক পরিবারে দেখা যায়। আমার মাকেই আমি দেখেছি আমাদের দুই ভাইবোন কে মানুষ করার জন্য সব বিসর্জন দিতে। এখন আমরা দুই ভাইবোন ই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। হলে থাকি। বন্ধের সময় বাড়ি যাই।
জানি না একা একা মা কি করে সময় কাটায়। মায়ের খুব ইচ্ছে, আমি যেন অবশ্যই চাকরি করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।