আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে গড়া প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি বা এমপিওভুক্তি পাবে না, এটা কি হয়? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে জিয়াউর রহমান বা ওই দলের মন্ত্রী-সাংসদদের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া ঠেকাবে কে?
১৯৯০ সালের পর বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুবার করে ক্ষমতায় এলে ওই দুই দলের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতাদের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার হিড়িক পড়ে যায়। মন্ত্রী ও সাংসদদের অনেকে নিজের নাম তো বটেই, মা-বাবা এবং স্ত্রীর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে অমরত্ব লাভের ব্যবস্থা করেছেন। এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ তাঁর নিজের এবং স্বজনদের নামে সারা দেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এই ধারায় অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে হলে প্রভাবশালী বা স্থানীয় সাংসদদের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার উপায় থাকে না। সহযোগিতা ও সহানুভূতি পাওয়ার জন্য নামকরণের বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর নামে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি পর্যায়ের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে এই জাতীয় নেতার নামে। ডিগ্রি পর্যায়ের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মিরপুর বঙ্গবন্ধু কলেজ, চন্দ্রা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলেজ, টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতী শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ, গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, ফুলপুরে তারাকান্দা বঙ্গবন্ধু কলেজ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর বঙ্গবন্ধু কলেজ, রাজশাহীর বোয়ালিয়ায় বঙ্গবন্ধু কলেজ, মেহেরপুর মুজিবনগর কলেজ, রূপসা বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ, বসুরহাট সরকারি মুজিব কলেজ, কচুয়া বঙ্গবন্ধু কলেজ, বহিমানগর শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ, বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, জলঢাকায় শিমুলবাড়ী বঙ্গবন্ধু কলেজ, মতিঝিলে বঙ্গবন্ধু ল কলেজ, মাদারীপুর বঙ্গবন্ধু ল কলেজ এবং চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধু ল টেম্পল।
জিয়াউর রহমানের নামে ১৩টি কলেজ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জিয়াউর রহমানের নামে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে পল্লবী শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, পিরোজপুরের নাজিরপুর শহীদ জিয়া কলেজ, বরিশালের সাহেবের হাট শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ, রাজশাহী শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ, গাবতলী শহীদ জিয়া কলেজ, জয়পুরহাট শহীদ জিয়া কলেজ, ফতেপুর শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজ, ফেনী সরকারি জিয়া কলেজ, জিয়া সারকারখানা কলেজ, ঝিনাইদহ শহীদ জিয়াউর রহমান আইন কলেজ, নোয়াখালী জিয়া এডুকেশন অব ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ও রাজশাহীর শ্যামপুরে শহীদ জিয়াউর রহমান শারীরিক শিক্ষা কলেজ।
এ ছাড়া জিয়াউর রহমানের নামে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা পর্যায়ের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফজিলাতুন্নেসার নামে আটটি কলেজ: বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেসার নামেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আটটি কলেজ রয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য শেখ জামাল, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ কয়েকজনের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
নিজের ও বাবা-মায়ের নামে প্রতিষ্ঠানের নমুনা: ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সাংসদ বিএনপির নেতা মসিউর রহমান ও তাঁর বাবা-মায়ের নামে রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠান।
ঝিনাইদহ-৩ (কোটচাঁদপুর-মহেশপুর) আসনের সাবেক সাংসদ বিএনপির নেতা শহিদুল ইসলাম ও তাঁর বাবা-মায়ের নামে রয়েছে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের সাবেক সাংসদ এম এ ওহাব বাবার নামে কলেজ স্থাপন করেছেন। ঝিনাইদহ-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ শফিকুল আজম খাঁন চঞ্চল তাঁর বাবার নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।
নামকরণের নমুনা: চরফ্যাশন উপজেলার রসুলপুর এলাকায় ১৯৯৭ সালে রসুলপুর মহাবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এরপর বিএনপির সাংসদ নাজিমউদ্দিন আলম নিজের নামে একই এলাকায় দুই কিলোমিটার ব্যবধানে নাজিমউদ্দিন আলম কলেজ গড়ে তোলেন।
এরপর তিনি রসুলপুর কলেজকে নাজিমউদ্দিন আলম কলেজের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া সাবেক ওই সাংসদ এলাকাবাসীর গড়া কলেজের নাম বদলে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ নাম রেখেছেন। এ ছাড়া বাবা ও স্ত্রীর দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
সাবেক সাংসদ নাজিমউদ্দিন আলম বলেন, ‘এলাকার জনগণ আমাকে এবং শহীদ জিয়াউর রহমানকে ভালোবেসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণ করেছে। ’ এসব নামকরণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ভোলা-৪ আসনের বর্তমান সাংসদ আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি সরকারের আমলে জনতা বাজার কলেজ জবরদখল করে অবৈধভাবে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ নামকরণ করা হয় এবং রসুলপুর কলেজকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নাজিমউদ্দিন আলম কলেজ নামকরণ করা হয়।
ভিন্ন চিত্র: রাজধানী ঢাকা ও নরসিংদীর রায়পুরায় নিজের এলাকায় মোট ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন সমাজসেবক আর কে চৌধুরী। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো রকম সহযোগিতা বা পরামর্শ চাওয়া হলে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। আর কে চৌধুরী আরও বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে দেওয়ার পর তাঁর আর চাওয়া বা পাওয়ার কিছু নেই।
এগুলো ভালোভাবে চলুক—এটাই তাঁর প্রত্যাশা।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এম ওসমান ফারুক বলেন, কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়লে এটা তার হয়ে যায় না। যাঁরা নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চান তাঁরা ভুল করেন এবং ওই সব প্রতিষ্ঠান তখন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় না।
সরকারপ্রধানের অনুমতি লাগবে: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাবশালী ও সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি পরিপত্র জারি করে।
এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু্রশেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্য, চার জাতীয় নেতা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহীদসহ জাতীয় প্রয়াত ও জীবিত নেতাদের নামে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। আবেদন পরীক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারপ্রধানের কাছে তা অনুমোদনের জন্য পেশ করবে। শুধু সরকার প্রধান অনুমতি দিলে এ ধরনের নামকরণ করা যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।