আমাদের উদ্ভাবনক্ষমতা, সৃজনশীলতার কোনো সীমারেখা নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কোনো জনপদ নেই যেখানে একসময় ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেওয়া হতো এক মণ চালে কত সের কাঁকর মেশালে ৫০ টাকা লাভ হবে? কিংবা যে গোয়ালা দুধে পানি মেশানোতে সিদ্ধহস্ত, সে আসলে কোন অনুপাতে দুধে পানি মেশায়! সম্ভবত আমরাই আবিষ্কার করেছি মাছে ফরমালিন মেশানো যায়, কলাতে দেওয়া যায় কার্বাইড!
অথচ আমাদের ঐতিহ্য কি এমন? খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখলাম আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে এই বদ্বীপে প্রথম বদনা আবিষ্কৃত হয়। বদনা আবিষ্কারের পৌনে ১২০০ বছর পর পশ্চিমা বিশ্ব পুশ শাওয়ারের কথা ভেবেছে! জন্ম থেকে মানুষ উদ্ভিদ দেখছে কিন্তু তারও যে প্রাণ আছে, এটা জানার জন্য মানুষকে একজন জগদীশচন্দ্র বসুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। মহাবিশ্বের তাবৎ বস্তুকণা মাত্র দুটি দলে বিভক্ত। তাদের এক দলকে বলা হয় বসুকণা বা বোসন।
এই বসু হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এখনকার জাতীয় প্রেসক্লাবের জায়গায় একটা লাল ইটের দোতলা বাড়িতে বসে তিনি এই বস্তুকণার খবর পেয়েছিলেন।
এই গৌরবের উত্তরাধিকারীদের সারাক্ষণই নানান উদ্ভাবনী চিন্তা উঁকি দেয়। এই আবিষ্কারকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন আমাদের শিক্ষা-কর্তারা। তাঁদের মাথা থেকে এমন সব বিষয় বের হয়, যা কিনা পৃথিবী কেন, এই মহাবিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না।
১২ বছরের শিক্ষাজীবনে চার-চারখান পাবলিক পরীক্ষা কেবল বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদেরই দিতে হয়। সবচেয়ে উদ্ভাবনী হলো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, পিএসসি। এটি দিতে হয় ক্লাস ফাইভের কোমলমতি শিশুদের। আমাদের শিক্ষা-কর্তারা মনে করেন, শিক্ষা-মূল্যায়নের একমাত্র হাতিয়ার হলো একটা লিখিত পরীক্ষা নেওয়া!
পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী কিছু মৌলিক বিষয় জানবে—কেমন করে শিখতে হয়, বলতে হয়; প্রকৃতি থেকে শেখার কাজটা শুরু করবে, প্রশ্ন করতে শিখবে, উত্তর খোঁজার জন্য নিজেকে তৈরি করবে। এসব কিছু কেবল একটি তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না।
যায় না বলেই মন্টেসরি বা শিক্ষা-উদ্ভাবকেরা পিএসসি পরীক্ষার কথা বলেননি। বলেছেন আনন্দের সঙ্গে যেন শিশুকে শিক্ষার ব্যাপারটা ধরিয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর সপ্তম শ্রেণীপড়ুয়া ছেলের কথা আমাকে বলেছেন, ‘আমার ছেলেকে নৌপথে বেড়াতে নিয়ে সকালে গেলাম জাহাজের ছাদে। চোখ বরাবর সূর্য। দুই পাশে গাছ-গাছালি।
বললাম, বাবা, বল তো দেখি, আমাদের জাহাজ কোনদিকে চলছে। আমার ছেলে বলতে পারল না!’
অথচ ওই ছেলেটি কিন্তু ঠিকই মুখস্থ করে বসে আছে যে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। কিন্তু এই তথ্য কেমনে জ্ঞান হয়ে দিক চেনার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে, সেটি সে জানে না!
এই মুখস্থ বিদ্যার সঙ্গে এখন এক নতুন ব্যাপার যোগ করা হচ্ছে। প্রথম আলোর ১৭ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদন (পঞ্চম শ্রেণীতে নতুন পদ্ধতির পরীক্ষা: প্রশ্ন কঠিন, সময় কম বিপাকে শিশুরা, প্রথম আলো, পৃষ্ঠা-১, ১৭ জুলাই, ২০১৩) থেকে জানা গেছে, এখন থেকে প্রাইমারি পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ২৫ নম্বর রাখা হয়েছে বই-বহির্ভূত। মানে সিলেবাসের বাইরে।
একই প্রতিবেদনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেছেন, নতুন চালু করা প্রশ্নকাঠামো কঠিন হয়েছে এবং এর উত্তর করার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। প্রতিবেদনটি পড়লে আপনার মনে হতে পারে, এই নতুন পদ্ধতিটি সম্ভবত কোনো চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাস্তবিক পক্ষে এটির ভুক্তভোগী হবে প্রতিবছর প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষার্থী, যাদের বয়স কমবেশি মাত্র ১০ বছর!
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কয়েক বছর ধরে আমাদের শিক্ষা-কর্তারা যা করছেন, তাতে আমার মনে হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে তারা পিএইচডির ইকুইভেলেন্ট হিসেবে ঘোষণা করার চিন্তাভাবনা করছেন!
খাতায় গড়গড় করে লিখতে পারাটাই একমাত্র সৃজনশীলতা নয়, সর্বজনীন তো নয়-ই। এমনকি সেটা কাম্যও নয়। প্রকৃতি সবাইকে একই গুণ দেয় না।
নানান জনের সৃজনশীলতা নানানভাবে প্রকাশিত হবে। একই ছকে তাদের বেঁধে রাখার কোনো দরকার নেই। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য, কারণ সেই সময়ে একজন শিক্ষার্থীর মনোজগৎ গড়ে ওঠে।
একটি আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, কৌতূহল এবং জ্ঞানান্বেষণ কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তার একটা নমুনা সম্প্রতি আমরা দেখেছি প্রথম জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান ক্যাম্পে। সারা দেশের ৫১ জন শিক্ষার্থী তাদের অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল লজ্জাবতীর পাতা লজ্জা পাওয়ার কত সময় পরে আবার স্বরূপে ফেরত আসে, গাছের ডালের কাঁঠাল কেন গোড়ার কাঁঠালের চেয়ে বেশি মিষ্টি, কেনইবা কোন এলাকায় নিমগাছের সংখ্যা কম ইত্যাদি।
কাজেই এমন স্কুলও হতে পারে, ছোটদের জন্য, যেখানে সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতা অনেক বেশি প্রাধান্য পায়। সেখানে কোনো কিছু শেখানো হয় না। শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা শেখে। শিক্ষকেরা সেখানে ঠিক শিক্ষক নন, বরং ফ্যাসিলিটেটর। তাঁরা কেবল পথ বাতলে দেন, দেখিয়ে দেন।
শেখান না। মারিয়া মন্টেসরি প্রথম এমন স্কুলের কথা বলেছিলেন। এখন আমরা আরও পথ পাড়ি দিয়েছি। এমন স্কুল কোনো কষ্ট কল্পনা নয়। সে রকম একটা স্কুলের ক্লাস টুর এক শিক্ষার্থী তার ক্লাসের মাস্কটটিকে সপ্তাহান্তে নিয়ে আসে বাসায়।
বাবার প্রশ্নের উত্তরে জানায় তার নাম শুভ্র। কারণ, তার গায়ের রং সাদা। পরবর্তী দুই দিন শুভ্র তাদের সঙ্গেই থাকে। মায়ের সঙ্গে বসে শুভ্রর থাকার জায়গা ঠিক করা, খাওয়ার মেন্যু ঠিক করা ইত্যাদি নিয়ে মেয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটায় আর ফাঁকে ফাঁকে নোটবুকে কী সব লিখে রাখে। তার খাতাতে পাওয়া যায়, ‘শুভ্র আজকে আমাদের বাসায় এসেছে।
গাড়িতে আসতে আসতে আমি ওকে বাসার সব কথা বলেছি। বলেছি খাদিজা আপু আর বিলকিস আপু তাকে ডিস্টার্ব করতে পারে। সে যেন কিছু মনে না করে। কারণ, আপুরা ভালো, খালি নতুন কাউকে পেলে ডিস্টার্ব করে। বাবা অফিস থেকে এলে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরি।
আজকেও ধরব। তখন কিন্তু আমি শুভ্রকে কোলে রাখতে পারব না। ’
...‘শুভ্র আলুভর্তা খেতে চাইল না। আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। আলুভর্তা আমার খুব প্রিয়।
কিন্তু ও কেন খেল না। ’
শুভ্র আসলে একটি খেলনা ভালুক!!!!
একইভাবে গণিতের ক্লাসে ওদের ক্লাস করতে হয় মার্বেল দিয়ে। ওরা সংখ্যারেখার ওপর লাফালাফি করে। ওদের স্কুলে একটি থিয়েটার আছে। সেখানে ওরা নিয়মিত সিনেমা দেখে, ভিডিও দেখে।
নিজেরা আবার নাটকও করে। কোনো কোনো দিন ওই স্কুলে গেলে আপনি দেখবেন, শিক্ষকের চোখে কাল রুমাল বেঁধে ওরা কানামাছি খেলছে! আপনি যখন নিশ্চিত হবেন যে ওই স্কুলে কোনো পড়ালেখা হয় না, তখনই অধ্যক্ষের কক্ষে ঝোলানো ফলাফল বোর্ড থেকে আপনি জানবেন, স্কুলটি হলো এই এলাকার সেরা বিদ্যাপীঠ!!!!
শিক্ষার নামে আমাদের কোমলমতি শিশুদের নিয়ে যে পরীক্ষাগুলো চলছে, সেগুলো কি বন্ধ করা যায় না?
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।