আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীর গৃহস্থালি কাজ ও অর্থমন্ত্রীর কথা



গত ২৯ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহিলা পরিষদের তৃতীয় জাতীয় পরিষদের সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশ। সরকারি পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ৩০ শতাংশ নারীর। কিন্তু তাঁর যে কথাটি আমাদের সবার, এমনকি পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছে সেটা হচ্ছে, নারীর গার্হস্থ্য কাজকে মূল্যায়ন করা হয় না। এটি মূল্যায়ন করা হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বাড়বে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার।

মহিলা পরিষদকে ধন্যবাদ। কাজেই আমি সরাসরি অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনেছি। তিনি বলেছেন, সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, প্রায় নাকি চূড়ান্ত হয়েছে। দুঃখের কথা, আমরা কেউ চোখেই দেখলাম না। শুধু আশ্বাস পাওয়া তো যথেষ্ট নয়।

যা হোক, গার্হস্থ্য কাজের বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ, নারীবাদী অর্থনৈতিক আলোচনায় এ বিষয়টি বাংলাদেশে আগে আলোচিত হয়েছে স্বীকৃতির প্রশ্নে, আন্তর্জাতিক এই আলোচনা অনেক দিনের। এ বিষয়ে নারী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই সচেতন রয়েছে এবং গার্হস্থ্য কাজের স্বীকৃতির জন্য সক্রিয়ভাবে সব সময় দাবি তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে কি শুধু গৃহবধূদের জন্য (ইংরেজিতে যাঁদের হাউসওয়াইফ বলা হয়), নাকি যাঁরাই গৃহস্থালি কাজ করেন সবার জন্য? আমি কিছু পুরোনো বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছি এ ব্যাপারে আমার চিন্তাকে আরেকবার একটু ঝালাই করে নেওয়ার জন্য। কারণ গার্হস্থ্য কাজ শুধু একজন বিবাহিত নারী, যাঁর স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার, তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও যেসব নারী আছেন, তাঁদের গার্হস্থ্য কাজ করতে হয় একইভাবে।

এর পরিমাপ করা সহজ কাজ নয়। আমি জোয়ান ভানেক-এর লেখা প্রবন্ধ ‘Housewives as Workers’ এবং ক্যারোলাইন শ্যো বেল-এর লেখা ‘Women and Work : An Economic Appraisal’ পড়ে তার কিছু তথ্য এখানে ব্যবহার করছি। এ কথা সবারই জানা, গৃহবধূ বলতে সাধারণত তাঁদেরই বোঝায়, যাঁরা বিবাহিত আছেন কিংবা ছিলেন এবং যাঁদের গৃহকাজের সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটি অনেকের জন্য ফুলটাইম কাজ, আবার কারও জন্য সময়ের মাপে হাফটাইম। কারণ, তাঁরা একই সঙ্গে বাইরের শ্রমবাজারেও আছেন।

একক পেশা হিসেবে যেকোনো দেশে ‘গৃহবধূ’ বা ‘হাউসওয়াইফ’ হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী পাওয়া যাবে। এমনকি পাসপোর্ট করতে গিয়ে নারীদের পেশা অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহবধূ হয়ে হয়ে যায়, যদি না সচেতনভাবে তিনি নিজেকে শ্রমিক কিংবা কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতে চান। জোয়ান ভানেক ১৯৭৪ সালের একটি হিসাব দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিন কোটি ২০ লাখ নারী শুধুই গৃহবধূ পেশায় ছিলেন, দুই কোটি গৃহবধূ অন্যান্য পেশায় কর্মরত ছিলেন আর প্রায় ৭০ লাখ নারী বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত কিংবা স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা কি গৃহস্থালি কাজ করেন না? বাংলাদেশে ২০০৭ সালের হিসাবে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ বিবাহিত, বিয়ে হয়নি ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারী হচ্ছেন ১০ দশমিক ৪ শতাংশ (সূত্র: Sample Vital Registration System, 2007, BBS Gender Statistics of Bangladesh, 2008)। বৈবাহিক যে অবস্থানেই থাকুক না কেন এবং যে বয়সেই থাকুক না কেন, গৃহকাজ নারীকে করতেই হয়।

শুধু কাজের ধরন ও মাত্রার পার্থক্য হতে পারে। আমি নিজে এবং নারী আন্দোলনের অনেকেই গৃহবধূ শব্দটি ব্যবহারের বিপক্ষে, কারণ মনে হয় বিয়েটা হয়েছে গৃহের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে নয়। আমরা নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় ‘গৃহ ব্যবস্থাপক’ কথাটি চালু করেছি। কারণ, তিনি গৃহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করেন। আশা করি, ভবিষ্যতে পাসপোর্ট কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রে গৃহবধূ বা হাউসওয়াইফ না লিখে গৃহ ব্যবস্থাপক বা হাউস ম্যানেজার লেখার ব্যবস্থা হবে।

তবে গৃহস্থালি কাজ সম্পর্কে কয়েকটি ভুল ধারণা আছে। যেমন, মনে করা হয় গৃহকাজের কোনো নির্ধারিত সময় নেই, যখন ইচ্ছা করা যায়, আস্তেধীরে করা যায়, আর সবচেয়ে বড় কথা, মনে করা হয় এ কাজের কোনো মূল্য নেই। সে কারণে এটাও অনেকে মনে করে যে কর্মজীবী নারী হলে তিনি গৃহকাজ করেন না বা কম করেন, আবার ঘরে যে থাকেন, তিনিই শুধু বেশি কাজ করেন। যন্ত্রণা বটে! অর্থনৈতিক মূল্যায়নের প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন বিষয়টি আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে। অর্থমন্ত্রী কি শুধু কথার কথা বলেছেন, নাকি তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন।

তাঁর এই ভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। অর্থমন্ত্রী ঠিকই ধরেছেন। গৃহের কাজের মূল্যায়ন নেই। নারীরা যখন শ্রমবাজারে আসেন, তখন তাঁকে সস্তা শ্রমিক বানানো হয়। আমি অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, নারী শ্রমিক এবং সব ধরনের কর্মজীবী নারী একই সঙ্গে গৃহকাজেও জড়িত।

তাঁদের ভোরবেলা উঠে আগে পরিবারের সবার খাবারের ব্যবস্থা করে নিজে খেয়ে না-খেয়ে ছুটতে হয় কাজে। অথচ এই নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না, তাঁদের ক্ষেত্রে মজুরিবৈষম্য করা হয়। গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করলে নারী শ্রমিকদের মজুরি দ্বিগুণ হওয়া উচিত। কারণ, তিনি একই সঙ্গে গৃহকাজও করে আসছেন, কিংবা তাঁর কাজটুকু করে দেওয়ার জন্য তাঁকে কাজে সহায়তার জন্য গৃহশ্রমিক নিয়োগ দিতে হচ্ছে। পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নও তোলা উচিত এবং তাঁদের ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকার দাবি মেনে নেওয়া উচিত।

অর্থমন্ত্রী গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করে জাতীয় আয়ে নারীর অবদান বাড়বে বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থনীতির ছাত্রী হিসেবে আমরা দেখেছি, দেশের জাতীয় আয় নিরূপণের ক্ষেত্রে গৃহের ভেতরে নারীর কাজের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। ক্যারোলাইন শ্যো বেল বলছেন, মূলত সেই সব কাজই মূল্যায়ন করা হয়, যা বাজারে আসে এবং যার আর্থিক দাম ধার্য করা হয়। এখানে শুধু নারীদের কাজই নয়, গ্রামীণ এবং শহরের বাজারবহির্ভূত অনেক পুরুষের কাজও বাদ পড়ে যায়। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে বিনয়ের সঙ্গে বলছি, গার্হস্থ্য কাজে নারীর অর্থনৈতিক মূল্যায়ন দিয়ে আমাদের সমস্যা সমাধান হবে না।

নারীর কাজের স্বীকৃতি এবং যেখানে তাঁর ন্যায্য মজুরি পাওয়ার বিষয় আছে, সেখানে ন্যায্য মজুরি দেওয়া, মজুরিবৈষম্য না করার জন্য কাজ করতে হবে। নিউজিল্যান্ডের প্রখ্যাত নারীবাদী অর্থনীতিবিদ মেরিলিন ওয়েরিংয়ের কথা দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছেন, জাতীয় আয়ের হিসাবের মধ্যে অন্যায় আছে এবং এগুলো প্রধানত ব্যবহূত হয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘের কিছু প্রতিষ্ঠানের দাতাগোষ্ঠী দ্বারা, তাদের নিজেদের স্বার্থে। জাতীয় আয়ের প্রথা শুরু হয়েছে যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য, পরে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের অবস্থা বোঝার জন্য। অর্থাৎ শুধু জিডিপিতে নারীর অবদান দেখানোর জন্য পরিসংখ্যানের চর্চার কথা শুনলে আমরা খুশি হব না, নারীর এই অবদানের মূল্য আমরা কীভাবে পরিশোধ করব, সেটাই হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী। উৎস:প্রথমআলো

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।