বিশাল আকাশ জুরে
ফ্রেবরুয়ারি মাস ভাষার মাস। এ মাস এলেই আমরা বাংলা ভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। বড় বড় কথা বলে সবাইকে বঝানোর চেসটা করি যে আমাদের বাংলা ভাষার জন্য কত ভালোবাসা। আসলেই কি আমারা আমাদের ভাষাকে ভালবাসতে পেরিছি?
আমার আজকের বিষয় বস্তু এমন একজন ব্যাক্রিকে নিয়ে যিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বাংলা ভাষার জন্য দাবি তুলে তার প্রকৃত ভালবাসা প্রকাশ করতে একটুকু দীধা করেননি। সবচেয়ে দুঃখের কথা হল যে আমরা এই প্রকৃত দেশ প্রেমিকের কথা বুলতে বসেছি।
তাই আমার এই স্বল্প প্রচেষ্টা......
এই প্রকৃত দেশ প্রেমিকটি হলেন ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত জনক ও স্থপতি, সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিক্ষাবিদ, লেখক, তমদ্দুন মজলিস ও বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। তিনি ১৯২০ সালের ২৮শে জুন চট্টগ্রামের ছেবন্দী গ্রামের এক ধর্মীও আবহে ও লোকজ ঐতিহ্যে গঠিত নিুমধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রামের স্থানীয় মহিলা ওস্তাদের কাছে বাংলা, আরবী, ফারসী ও সামান্য উর্দূ শিক্ষার মধ্য দিয়ে শৈশবে শিক্ষা জীবন শুরু। সুন্দর, ফরসা চেহারার অধিকারী পিতা মতিউর রহমানকে তার শান্ত, ভদ্র, অমায়িক ব্যবহারের ও প্রতিভার গুনে গ্রমের সবাই মান্য করতো এবং ভালবাসতো। গ্রামের সালিশী বিচারক হিসাবেও তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র।
প্রায় রাতেই তিনি মিষ্টি কন্ঠে সুর করে পুথি পাঠ করতেন। মাতা সালেহা খাতুনও ছিলেন পরহেজগার ও মেধাবী মহিলা। তিনি মিষ্টি কন্ঠে কোরআন তেলায়ত করতেন। তার মেধা এত প্রখর ছিল যে, শুনে শুনে তিনি পাঠ্য বইয়ের বহু কবিতা ও পুথির বহু অংশ ও শ্লোক মুখস্ত বলতে পারতেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম জন্মসূত্রেই মাতা পিতার মেধা ও চারিত্রিক গুনাবলী লাভ করেছিলেন।
তিনি ১৯৩০ সালে বরমা “ত্রাহি-মেনকা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়” এ ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকে ধৈয্যশীল, মেধাবী আবুল কাসেম লজিং থেকে এবং টিউশানী করেও স্কুল জীবনে প্রত্যেক শ্রেনীতে প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব অর্জণ করেন। পরীক্ষায় নিয়মিত ভাল রেজাল্ট করার জন্য তিনি অবৈতনিক ছাত্র হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। স্কুলের সব শিক্ষকের কাছে তিনি ছিলেন আদরের পাত্র। প্রতি বছর প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য তিনি মোহসিন বিত্তি পেতেন।
১৯৩৯ সালে তিনটি বিয়য়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং সরকারী জেলা বৃত্তি লাভ করেন। এই বৃত্তি লাভে তার উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম হয়। ১৯৪১ সালে “চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ” থেকে প্রথম বিভাগে আই.এস-সি পাশ করেন এবং চট্টগ্রাম বিভাগে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বি.এস-সি অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে বৃত্তি লাভ করেন। তার সাবসিডিয়ারী বিষয় ছিল গনিত ও রষায়ন।
তখন তিনি গনিত পরীক্ষায় প্রথম স্থান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পান। ১৯৪৫ সালে তিনি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এ-সি. পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং থিসিসে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যায়ে থাকা কালিন সময়ে তিনি প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ডঃ সত্যেন বোস এবং ডঃ খাস্থগীরের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ডঃ সত্যেন বোসের অধিনে তিনি তার থিসিস সম্পাদন করেন। তার থিসিসের নাম ছিল ‘থেলিমাইডের গঠন’ ।
তিনি এই থিসিসে সর্বাধিক নাম্বার পেয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থাণ অধিকার করেন। এর জন্য পরিক্ষকদেরও অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করেন তিনি। তার এই থিসিসটির সংক্ষিপ্ত সার ইংলেন্ডের বিজ্ঞান জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার হিসাবে যোগদান করেণ। এসময় ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার মাত্র সতের দিনের মাথায় ১লা সেপ্টম্বর ইসলামের প্রগতিশীল ভাবধারার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক এবং ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন “তমদ্দুন মজলিস” প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৫ সেপ্টম্বর ১৯৪৭ ভাষা আন্দোলনের ঘোষনাপত্র “পাকিস্তানের রাষ্টভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
এর মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রাভাষা, পূর্ব বঙ্গের সরকারী অফিসাদির ভাষা ও শিক্ষার বাহন করার দাবীতে আন্দোলন সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্রে যেমন আসীকলপেদীর অবদানের কথা সর্বজন স্বীকৃত, তেমনী ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই পুস্তিকাটির ছিল তেমনি অবদান। ভাষা আন্দোরনের প্রথম দিকের প্রতিটি সভা ও মিছিলের তিনিই ছিলেন উদ্যোক্তা, প্রধানতম নেতা ও সভাপতি। তখনকার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে ১৯৪৭ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলা ভাষার দাবীতে প্রথম স্মারকলিপি প্রদানে তার ভূমিকা ছিল মূখ্য। ১৯৪৭ সালে ৬ই ডিসেম্বর তারই সভাপতিত্বে প্রথম বাংলা ভাষার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাঙ্গনে ছাত্র সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠীত হয় এবং পরবর্তিতে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ হরতাল পালিত হয়।
এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তদানীন্তন নাজিমুদ্দিন সরকার বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবী মেনে নিয়ে ৮ দফা চুক্তি সাক্ষর করেন। তিনি সেই সময সংগ্রাম পরিষদের নেত্বতৃ দেন। অধ্যাপক আবুল কাসেম (পরে প্রিন্সিপাল) পরিচালিত ভাষা আন্দোলনের এটিই প্রথম বিজয়। ১৯৪৮ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশ করেন। এর পর প্রায় চার বছর পর ১৯৫২ তে খাজা নাজিমুদ্দিনই উক্ত চুক্তির বরখেলাপ করায় ২১শে ফ্রেব্রযারী গেীরবময় বিস্ফোরকের অধ্যায় সূচিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৫৪ সালে পুর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হবার পর ১৯৫৬ সালে তিনি বাংলাকে সরকারী অফিসাদির ভাষা ও শিক্ষার বাহন করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং পরে যা পাকিস্থানের প্রথম সংবিধানে অন্তরভুক্ত হয়।
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার সাংবিধানিক স্বীকৃতির পরও বাংলাকে উচ্চ শিক্ষার বাহন করার প্রশ্নে সরকারসহ বিভিন্ন মহলে টালবাহানা শুরু হয় উচ্চ স্তরের শিক্ষার জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক ও পরিভাষা না থাকার অজুহাতে। এই অবস্থায় অধ্যাপক আবুল কাসেম নিজে দুই হাজারের অধিক পরিভাষা সৃষ্টি করে বিজ্ঞান বিষয়ক ৪০টি পাঠ্যপুস্তক রচনা ও ১৯৬২ সালে দেশে বাংলা মাধ্যমের প্রথম কলেজ ‘বাংলা কলেজ’ স্থাপন করে এক্ষেত্রেও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের প্রকাশিত বইএর সংখ্যা একশত এর বেশী।
মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চতর শ্রেনীর পাঠ্য, ইসলামী আদর্শ, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান, বিবর্তন, সংগঠন, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ক বই লিখেছেন তিনি। তার কিছু লিখিত বই এর নাম নিচে দেওয়া হলঃ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, একুশ দফার রূপায়ন, শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি, আধুনিক চিন্তাধারা, মুক্তি কোন পথে, ইসলাম কি দিয়েছে ও কি দিতে পারে, একমাত্র পথ, আমাদের ভাষার রুপ, বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম (বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত), ছাত্র আন্দোলন, পাকিস্থানের অর্থনীতি, বিবর্তনবাদ সৃষ্টিতত্ত্ব ও আল্লার অস্তিত্ব, বিজ্ঞান বস্তুবাদ ও আল্লাহর অস্তিত্ব, কোরানিক অর্থনীতি, ওংষধস ংপরবহপব ্ গড়ফবৎহ ঞযড়ঁমযঃং, উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থিকা (১ম ভাগ) (পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড পুরষ্কার প্রাপ্ত), উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থিকা (২য় ভাগ), উচ্চ মাধ্যমিক রষায়ন(১ম ভাগ), উচ্চ মাধ্যমিক রষায়ন (২য় ভাগ),বিজ্ঞান প্রকাশ, সহজ পদার্থিকা, উচ্চ মাধ্যমিক ক্যালকুলাস, উচ্চ মাধ্যমিক ত্রিকোনমিতি, উচ্চ মাধ্যমিক ডিনামিক্স, উচ্চ মাধ্যমিক স্ট্রাটিকস ইত্যাদি।
তার অসামান্য কৃতিত্যের জন্য তিনি কতগুলো রাষ্টীয় ও সামাজীক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো হলঃ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৮৯ সালে জাতীয় সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক, ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে ইসলামী ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল (বি.এন.পি) পদক ও ভাষা সৈনিক সম্মাননা , ২০০০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পদক, ২০০০ সালে মাতৃভাষা পদক (তমদ্দুন মজলিস), ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড পুরস্কার, ১৯৬৪ সালে বাংলা কলেজ ছাত্র মজলিস স্বর্ণপদক, ১৯৮৭ সালে ডাকসু কর্তৃক সংর্বধনা, ১৯৭৭ সালে কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিস সংবর্ধনা, ১৯৮৮ সালে আঞ্জুমানে হেদায়াতুল ইসলাম সংবর্ধনা, ২০০০ সালে চট্টগ্রাম সমিতি পদক, ২০০১ সালে মাওলানা ইসলামাবাদী স্বর্ণ পদক, ১৯৯৫ সালে ভাষা আন্দোলন চেতনা পরিষদের ভাষা সৈনিক সংবর্ধনা এবং ১৪০০ সাল উদযাপন পদক ইত্যাদি। বাঙলা কলেজ কমিটি সে কলেজের ছাত্রাবাসটি “প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ছাত্রবাস” নামে নাম করন করেছে এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০০৬ সালে মিরপুর বাংলা কলেজের সামনের রাষ্টাটি ( আগের দারুস সালাম রোডটি) তার নামে নাম করন করেছে।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম শেষ জীবনে তার পরিকল্পিত সহজ বাংলা বাস্তবায়নের নানারুপ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি সহজ বাংলা বাস্তবায়ন পরিষদ গঠনের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চালান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা তাকে সে প্রচেষ্টার মধ্যে নানাভাবে ব্যাপৃত থাকতে দেখেছি। এক কথায় প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম কেবল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জনক ও স্থপতিই ছিলেন না, তিনি ভাষা বিপ্লবের নায়ক ছিলেন। এই মহান দেশপ্রেমিক ১৯৯১ সালের ১১ ই মার্চ ঢাকায় মৃত্যু বরন করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।