আমি অতীতের কথা বলেই বর্তমানকে সাজাই ভাবীকালের উপযোগী করে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কোলকাতার অধুনা-লুপ্ত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার ২২শে এবং ২৯শে জুন তারিখে রবিবাসরীয় পাতায় দু'কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। এখানে শুধু দ্বিতীয় কিস্তি তুলে ধরছি।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি শুধু ইংরেজিরই আধিপত্য দেখতাম, অন্যকোন ভাষার আধিপত্য না দেখতাম, তাহলে বলতাম এর কারন ইংরেজির ওই রাষ্ট্রভাষিক মর্যাদা, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার অতি-মুল্যবানতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার নিম্নতর স্থান নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বাঙালিদের ব্যবহারিক জীবনে শুধু ইংরেজি নয়, উর্দু এবং হিন্দির সমান আধিপত্য।
যে ক্ষেত্রে একজন উর্দু বা হিন্দিভাষীর সঙ্গে একজন বাঙালির কথা বলার দরকার হয়, সে ক্ষেত্রে বাঙালি কোন ভাষার আশ্রয় নিয়ে থাকেন? যদি উভয় পক্ষেরই ইংরেজি জানা থাকে তবে কথা হয় ইংরেজিতে।
যদি দু'জনের মধ্যে একজন ইংরেজি-অজ্ঞ হন, তবে কথা হয় সাধারনত সেই অবাঙালির মাতৃভাষায়, সে কোটিপতি ব্যবসায়ী হোক অথবা ষ্টেশনের কুলি হোক, যদি বাঙালি পক্ষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকারী এম. এ. হন তবুও। সহজ কথায় মোটামুটি বলা যেতে পারে যে, ইংরেজিতে কথা বলব না- দেশব্যাপী এই প্রতিজ্ঞা যদি আজ করা
হয়, তবে আজ জওহরলাল থেকে শুরু করে বোধহয় তার আরদালি পর্যন্ত সকলের সঙ্গেই ড. সুনীতি চ্যাটারজী এবং হুমায়ুন কবীর কথা বলবেন খুব সম্ভব হিন্দিতে, বাংলায় নয়। জওহরলাল বাংলা বলবেন না, তিনি জানেন না। কিন্তু সুনীতি চ্যাটারজী ও হুমায়ুন কবীর উভয়েই হিন্দি জানেন অন্তত; কথা বলবার মতো, যেমন প্রায় বাঙালিই জানেন।
বস্তুত এটাই হল সাধারন সত্য।
প্রায় বাঙালি এটা মনেপ্রানে জানেন যে, হিন্দি-উর্দু ভাষীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তাকে হিন্দি অথবা উর্দুতে বলতে হবে, কেননা অপর পক্ষ বাংলা জানেন না। জ্ঞাতসারেই বাঙালি এই অবশ্য-কর্তব্য নিজের ঘাড়ে নেয়। স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হলেও এটা একটা বাধ্যবাধকতা; এরুপ বাংলা জানা এবং বলার বাধ্যবাধকতা ও গরজ এখন পর্যন্ত অবাঙালির নেই।
আমি এই কোলকাতার কোনো এক অভিজাত মুসলিম পরিবারের কথা জানি, যে পরিবারের কর্তা আমাদের জেলার লোক, খাটি বাঙালি। তার স্ত্রী(২য় পক্ষ) উর্দুভাষীনী।
স্ত্রীর অত্যান্ত অসুবিধা হয় বলে বরাবরই উর্দুভাষী চাকর রাখা হয়েছে। বর্তমানে কর্তা বৃদ্ধ এবং কর্ত্রী প্রায় পৌঢ়া। তাদের ছেলে মেয়ে সবশুদ্ধ ৮টি। আজ সেই খাটি বাঙালি প্রতিপালিত সংসারটি সম্পুর্নরুপে অবাঙালি উর্দুভাষী পরিবারে পরিনত হয়েছে। স্বয়ং কর্তাকেও স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে হয়।
আমার প্রশ্নঃ সেই উর্দুভাষীনী গৃহিনীর প্রতি বিবেচনাই কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল? এই কোলকাতার কোন একটি মেসের সঙ্গে সংশ্লিস্ট অবস্থায় দেখেছি, সেখানকার উর্দুভাষী চাকরটির সঙ্গে সকলেই কথা বলে উর্দুতে। চাকরটি এই সেদিন পর্যন্ত ছিল রিকসাওয়ালা, দাঙ্গা পরিস্থিতিতে রিকসা টানা নিরাপদ নয় বলে বাবুরচির কাজে লেগেছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, সে আজ ৮ বছর ধরে বাংলায় বাস করছে। এই ৮ বছরে নিশ্চয়ই অধিকাংশ বাঙালিকে রিকসায় টেনেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলা বলতে শেখেনি, বুঝতেও শেখেনি। কেননা সে প্রয়োজন আজ পর্যন্ত সে অনুভব করেনি, তাকে এবং তার মত লক্ষ লক্ষ অবাঙালিকে বাংলা শেখানোর প্রয়োজনীয়তা ৬ কোটি বাঙালি কোনদিন প্রয়োজন মনে করেনি।
ইংরেজের সঙ্গে এমনকি একজন ৩য় শ্রেণীর ইংরেজের সঙ্গে কথা বলতে হলেও ইংরেজিতে কথা বলতে হবে, এমনি একটা সহজাত ধারনা যেমন বাঙালিদের আছে, তেমনি একটা উর্দু-হিন্দীভাষী কুলি চাকর রিকসাওয়ালা মেথরের সঙ্গে কথা বলতে হলেও উর্দু-হিন্দিতে কথা বলতে হবে, এরুপ একটা সহজাত ধারনা শুধু হেজিপেজি বাঙালির নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীর প্রথমস্থান অধিকারী বাঙালিরও আছে। এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবুও সধারনভাবে সত্য। অথচ উর্দু-হিন্দি ইংরেজির মতো রাস্ট্রভাষা নয়। উর্দু-হিন্দি ভাষীরা শাসক-সম্প্রদায় এবং বাঙালিরা শাসিত সম্প্রদায় নন।
এর প্রধান কারন এই যে বাঙালির জাতীয়তাবোধ এখনও পরিপুর্নভাবে স্ফুরিত হয়নি।
তার জাতীয় মর্যাদাবোধ এখনও অত্যান্ত কাচা, তার পুর্ন জাতীয় ব্যক্তিত্ববোধ এখনও অপ্রতিষ্ঠিত। এই কারনেই বাঙালিরা সাধারনতঃ বুঝতে পারেন না যে, নিজ বাসভুমেও ইংরেজ তথা অবাঙালিদের সঙ্গে তাদেরই ভাষায় কথা বললে জাতীয়তাবোধের দিক দিয়ে নিজেকে ছোট করা হয়, নিজের অমর্যাদা করা হয়, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া হয়। ইংরেজের সঙ্গে ইংরেজিতে এবং নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলার অর্থ কেবলমাত্র এইটুকুই নয় যে, ইংরেজি আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং ব্যবহারিক জীবনে ইংরেজির মর্যাদা বেশি। এর কারন আমাদের অধ স্ফুরিত জাতীয়তাবোধ, অধ স্ফুরিত জাতীয় মর্যাদাবোধ। তা'নইলে নিজেদের মধ্যেও কোনো বাঙালি ইংরেজি বলতেন না এবং বলতে পেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতেন না- বাংলায় ভালো বলতে পারিনে, বাংলায় কিছু লিখতে পারিনে, বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারিনে বলে লজ্জার পরিবর্তে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতেন না।
জাতীয় মর্যাদাবোধ অতি ক্ষীন বলেই এবং সেই মর্যাদাবোধের অঙ্গস্বরুপ বাংলা ভাষার মর্যাদাবোধ অতি ক্ষীন বলেই, উর্দু হিন্দি ভাষীর সঙ্গে বাঙালিরা বাংলার পরিবরতে উর্দু-হিন্দি বলার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে থাকেন।
অথচ কেমন উর্দু-হিন্দি আর কেমন ইংরেজি যে অধিকাংশ বাঙালি বলেন, তা ভেবে ওয়াকেফহাল মাত্রেই কৌতুক অনুভব না করে পারেন না। আমরা কয়জন ব্যাকরন শুদ্ধ উর্দু-হিন্দি জানি? অথচ সাধারন অর্থে শতকরা যতজন বাঙালি শিক্ষিত তার চেয়ে অনেক বেশি বাঙালিকে জীবনের কোনো না কোনো দিন উর্দু-হিন্দি বলতে হয়-ই। সে উর্দু-হিন্দি কার কাছে শেখা? সেইসব উর্দু-হিন্দি ভাষীদের কাছে শেখা, যাদের অধিকাংশই আমাদের মতো অশিক্ষিত এবং আমাদের অশিক্ষিতদের মতো তাদেরও অশিক্ষিতদের ভাষা অমার্জিত। শুধু তাই নয়, আমাদের বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা যেমন বিভিন্ন রকম, উর্দু-হিন্দিও তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম।
সেই বিভিন্ন অঞ্চলের উর্দু সেই সব অঞ্চলের প্রধানত অশিক্ষিত লোকদের কাছে শিখে আমরা যে কী অপরুপ খিচুড়ি উর্দু-হিন্দি বলে থাকি, তা' আমরা নিজেরা না বঝতে পারি, মার্জিত উর্দু-হিন্দিভাষীরা নিশ্চয়ই বুঝেন। আমাদের সেই উর্দু-হিন্দি ভাষা তেমনই হয়, বেকায়দায় পড়ে উর্দু-হিন্দিভাষীরা যেমন বাংলা বলতে শিখেছে এবং যেমন বাংলা শুনে, প্রকাশ্য না হলেও মনে মনে প্রত্যেক বাঙালিই কৌতুক অনুভব করেন।
উর্দু-হিন্দির মতো ইংরেজি বলার বেলায়ও তেমনি ঘটে। আমরা যে ইংরেজিতে কথা বলি তা' কেতাবী ইংরেজি, আর এই ইংরেজি শিখেছি ১৬শ-১৭শ শতাব্দীর শেক্সপিয়ার থেকে আরম্ভ করে দেশি বি. এ., এম. এ. পাস মাস্টার ও অধ্যাপক পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যেক এবং ইংরেজি অভিজ্ঞদের কাছে। আধুনিক মার্জিত কথ্য ইংরেজির তুলনায় কী অপরুপ খিচুড়ি ইংরেজি যে আমরা বলি, তা' আমরা না জানলেও মার্জিত-ভাষী ইংরেজ এবং মার্জিত ইংরেজ-অভিজ্ঞ এদেশীরাই জানেন।
মার্জিত খাটি আধুনিক ইংরেজি এদেশে কেউই জানেন না এবং বলতে পারেন না তা নয়; আমি তাদের কথা বাদ দিয়েই বলছি। কিন্তু তারা ছাড়া আর সবাই, এমনকি ইংরেজির বহু এম. এ.-ও যে খাটি আধুনিক মার্জিত ইংরেজি পুরোপুরিভাবে জানার এবং বলার দাবি করতে পারেন না, বিশেষত উচ্চারনের দিক দিয়ে, তা অত্যন্ত বিদিত সত্য। তবু তাদের থেকেশুরু করে আন্ডার মেট্রিক পর্যন্ত আমাদের শিক্ষিতরা গভর্নর বারোজ থেকে শুরু করে একজন শুড়ি ইংরেজ পর্যন্ত সকলের সঙ্গে এবং নিজেদের পরস্পরের মধ্যে ইংরেজি বলবেনই, ইংরেজি ছাড়া বাংলায় তারা চিঠি পর্যন্ত লিখবেন না, এবং ইংরেজি জানার আত্মপ্রসাদে বাংলা ভালো জানিনা বলে আভিজাত্য প্রকাশ করবেনই।
এরুপ ইংরেজি-প্রীতি, এরুপ উর্দু-হিন্দি প্রীতির কোনো মুল্য, কোনো মর্যাদা নেই খাটি বাংলা-প্রেমীদের কাছে। এভাবে ইংরেজি ভাষী উর্দু-হিন্দিভাষীদের কাছে নিজেদের মাতৃভাষার অমর্যাদা যারা করেন, তারা আত্ম-অমর্যাদা করেন, তাদের খাটি দেশপ্রেমী বলতে অন্ততঃ আমার মন চায় না, আমি তাদের মধ্যে দেখতে পাই ইংরেজিয়ানাপ্রীতি, অবাঙালিয়ানাপ্রীতি।
আমার মনে একটা প্রশ্ন সবসময়ে উদ্যত হয়ে থাক। আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দিভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মত এই যে, এদেশে যেসব অভারতীয় অথবা অবাঙালি বাস করবে, তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এদেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি শেখা আমদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘোর অমর্যাদাকর। আন্তর্জাতিক সম্বন্ধের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংযোগের জন্য যতটুকু ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি শেখা দরকার, শুধু ততটুকুই আমরা শিখব এবং অন্ততঃ ততটুকু বাংলা পৃথিবীর জাতিপুঞ্জকেও শিখতে হবে।
ভারতের অন্য অঞ্চলে যেয়ে যেমন সে অঞ্চলের এবং ভারতের বাইরে যেয়ে যেমন সেখানকার ভাষা ব্যবহার না করে আমাদের গত্যন্তর নেই, তেমনি ভারতের অন্য অঞ্চলের এবং ভারতের বাইরেকার দেশের লোকদের বাংলায় এসে, বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে গত্যন্তর না থাকা উচিত। তাতেই প্রকৃত জাতীয় মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
তথ্যসুত্রঃ ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব, আবদুল হক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।