সত্য বলেছি, সত্য বলছি এবং আরো সত্য বলেই যাব
তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গ্রন্থকার, শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর যে প্রীতি ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সে হিসেবে দেশে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির আবির্ভাব অদ্যাবধি ঘটছে বলে আমাদের মনে হয়না। মাতৃভাষা ছিল তাঁর কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। এ রকম ভাষা প্রেমিকের জন্ম হয়েছিল বলেই ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা যাকে বলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সুতিকাগার।
তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ আবুল কাসেম (১৯২০-১৯৯১) ছিলেন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। ব্রিটিশ শাসনাবসানে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৭ পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। অধ্যাপক আবুল কাসেমের বিচক্ষণ মনে সেদিনই নতুন কিছু করার জন্য ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর মানসচক্ষু যেন দেখতে পেয়েছিল, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সংঘর্ষ, আন্দোলন, সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজের আদর্শিক বিষয় তো ছিলোই।
এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে একটি নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই স্বপ্নেরই বাস্তব রূপ ছিল ‘তমদ্দুন মজলিস’।
১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠালাভ করে। তখন আবুল কাসেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসভবনই ছিল তমদ্দুন মজলিসের অফিস। প্রথম থেকেই মজলিসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শাসসুল আলম ও ফজলুর রহমান ভূঁইয়া।
পরবর্তীতে অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া, আব্দুল মতিন, নঈমুদ্দীন, সানাউল্লাহ নূরী, শাহেদ আলী প্রমুখ। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে এরকম একটি বিপ্লবী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ছিল অত্যাধিক। নতুন রাষ্ট্রে তরুণরা তখন মহৎ কিছু করতে উদ্দীপ্ত। দেশের শিল্প, সাহিত্য ও ভাষা সংস্কৃতি কেমন হবে, জাতিরাষ্ট্রের আদর্শিক মাপকাঠি কেমন হবে, বহু প্রত্যাশিত স্বাধীন পাকিস্তানের ভিত্তি কি হবে-এসব বিষয় তমদ্দুন মজলিস উদ্যোক্তাদের চিন্তিত করে তুলেছিল। এই শুভ চিন্তার স্বার্থক রূপায়ন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস।
পরবর্তীতে মজলিসের মুখপত্র হিসেবে সৈনিক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ একই ভাবনা থেকে উৎসারিত। অধ্যাপক আবুল কাসেমের মেধা, শ্রম আর সাধনায় মজলিসের পরিধি ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। আদর্শবাদী তরুণ যুবকদের খুঁজে বের করে মজলিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার জন্য দিবা নিশি শ্রম দিতে লাগলেন। মোটকথা তমদ্দুন মজলিশই তখন হয়ে উঠে তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যান ও স্বপ্ন।
তমদ্দুন মজলিস ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন।
তারপরও বিপক্ষ শক্তি শুরু থেকেই এর বিরোধিতায় নেমে পড়ে। বিশেষ করে বামপন্থীরা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। সদ্য আযাদিপ্রাপ্ত দেশে এরূপ একটি সংগঠনের জন্মকে তারা কুনজরে দেখতে শুরু করে। কেউ কেউ এ সংগঠনের উদ্যোক্তাদের ভারতের ‘এজেন্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে অপপ্রচার চালায়। তারা লিফলেট, বক্তব্য বিবৃতির মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ায়।
জনগণকে তারা নানাভাবে বিভ্রান্ত ও হয়রানি করে। প্রকৃতপক্ষে এরাই ছিল সুবিধাবাদী ও রাষ্ট্রের আত্মঘাতি চক্র। আমাদের জাতিসত্তা, ধর্মবিশ্বাস, জাতিরাষ্ট্র এবং জনগণের সাথে এরা সেসময়ে যে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছিল, সেই ধারা থেকে আজো সরে আসেনি। একবিংশ শতাব্দিতে এসেও তারা দেশকে অকার্যকর করতে, মার্কিন ভারতের কলোনি বানাতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের জীবন দর্শনের মূলোৎপাটন করতে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি খর্ব করতে সদা সক্রিয়। এসব দলবাজ ও মতলববাজরা দেশ জাতির ঐক্য সংহতির পথকে রুদ্ধ করে বিভাজনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তমদ্দুন মজলিসকে প্রগতিশীল আদর্শে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোক্তাগন কঠোর পরিশ্রম করেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আবুল কাসেমের ভাষায়, ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস আদর্শবাদী কর্মিদের বৈজ্ঞানিক সংগঠন, চিন্তা বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবন মারফত সর্বমানবীয় কল্যাণধর্মী আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমই মজলিসের লক্ষ্য ছিল’। খাঁটি ইসলামি আদর্শের বাস্তবায়নের মারফত বর্তমান সমস্যা জর্জরিত আর অসাম্য, অত্যাচার ও হিংসা নিপীড়িত মানব সমাজের মুক্তি, মানবীয় মূল্যবোধের ওপর সাহিত্য, শিল্প ও কাজের মাধ্যমে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে সহায়তা, গণজীবনে মন বিপ্লব সাধন করে খাঁটি ইসলামি আদর্শের দিকে মানুষকে এগিয়ে নেয়া, কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করে ‘সুস্থ ও সুন্দর’ সংস্কৃতি সভ্যতা গড়ে তোলা, নিখুঁত চরিত্র গঠন করে মানবজীবনের উন্নয়নে সহায়তা প্রভৃতি ছিল তমদ্দুন মজলিসের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। নেতৃত্ব নির্বাচনে সম্পর্কে এর গঠনতন্ত্রে বলা হয়, ‘নাস্তিক, মোনাফেক, স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী লোকদের জায়গা তমদ্দুন মজলিসে নেই।
আদর্শবাদী ও নিশ্বার্থ তমদ্দুনিক কর্মীরাই তমদ্দুন মজলিসের ধারক, বাহক ও পরিচালক থাকবেন’।
দেশবিভাগের পরপরই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে মজলিস উদ্যোক্তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে সাহিত্য-সভা, সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন কওে তমদ্দুন মজলিস। এছাড়া জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিবৃতি ও হ্যান্ডবিল প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া সরকারের নিকট স্বারকলিপি পেশ করাও ছিল মজলিসের প্রাথমিক কর্মসূচী।
প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ তোয়াহ বলেছেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা এ নিয়ে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীমহলের চিন্তার সূত্রপাত করে তমদ্দুন মজলিস। এই তমদ্দুন মজলিস ছিল ইসলামি আদর্শে প্রভাবিত আধা-রাজনৈতিক ও আধা-সাংস্কৃতিক সংগঠন’। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মজলিসের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক বিখ্যাত পুস্তিকা। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে প্রকাশিত এ প্রথম পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং আবুল কাসেমের তিনটি প্রবন্ধ স্থান পায়। এ বইটি জাতীয় পর্যায়ে দারুণ প্রভাব ফেলে।
বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মোহাম্মদ আবুল কাসেম এসব উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বায়ান্ন’র ট্রাজেডি ঘটত কিনা সন্দেহ, আর তাহলে হয়ত আজো উর্দুর বেদীমূলে নির্বাসিত থাকত বাংলাভাষা। তাই বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত জনক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এবং তার সংগঠন তমদ্দুন মজলিস।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তমদ্দুন মজলিসের প্রাথমিক স্তরের সেই গতিশীল ভূমিকা এখন আর নেই। মন্থর হয়ে পড়ছে এর কার্যক্রম ও গতি। নামমাত্র সংগঠন হিসেবে টিকে আছে।
বছরে হয়ত দু চারটা আলোচনা সভার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বর্তমান প্রেক্ষাপট খুব একটা ভালো নয়। এ জাতিকে শেকড়শূণ্য করতে, মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে, ধর্মবিশ্বাসকে উপড়ে ফেলতে চলছে নানামুখি ষড়যন্ত্র। দেশি বিদেশি চক্র আমাদের চিরায়ত সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর মরণ আঘাত হানছে। তারই প্রতিফলন ঘটছে পত্র পত্রিকা, বেতার, টিভি, নাটক, চলচ্চিত্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর।
ফলে রাজনীতি ও জনজীবনে নেমে এসেছে বিশৃঙ্খলা, চরম নৈরাজ্য। সর্বত্র এক হতাশাজনক ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আর তাই গত শুক্রবারে জাতীয় প্রেস্ক্লাবে ভাষা মতিন তমদ্দুন মজলিসের সভায় প্রতিবাদের আর আক্ষেপের সুরেই বলেন, " দেশ বিভক্তির পর থেকেই ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি। এ আন্দোলনের সাথে অনেকেই জড়িত ছিল। কিন্তু তাদের অংশগ্রহণকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
আর অনেকেরি কোন ভুমিকা ছিলনা, আজ তাদের কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে। এর ইতিহাসকে রাজনৈতিক স্বার্থে বিকৃত করা হচ্ছে। "
অপর ভাষা সৈনিক প্রফেসর বার্নিক বলেন" বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহন ছিল না। ৪৭/৪৮ সালে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। তবে এরপরে আর ছিল না।
প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের ভাষার দাবীতে গঠিত কমিটিতেও তার নাম ছিল না। আজ যারা তার কথা বলছেন তারা আবেগের স্বরে অথবা রাজনৈতিক স্বার্থে বলছেন। " তিনি আরো দাবী করেন, বর্তমানে যেসব ভাষা সৈনিক বেচে আছেন তারা যেন আর কোন বিকৃতির পূর্বেই জাতির সামনে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরেন।
সূত্র ঃ ক) প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ও ভাষা আন্দোলন-মোসতফা কামাল
খ) ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন-মোসতফা কামাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।