সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের জলবায়ুবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে আবহাওয়ার যতগুলো নেতিবাচক রূপ রয়েছে, তার সব কটির প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে। জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পোস্টডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বর্তমানে যে হারে বাড়ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৯০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে, যার পরিণতিতে বাংলাদেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হবে। উল্লেখ্য, সিডর ও আইলার উপর্যুপরি আঘাতে এখনো উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ অতিরিক্ত লবণাক্ততার প্রভাবে এবং সুপেয় পানির অভাবে কষ্টকর জীবন যাপন করছে।
আবহাওয়ামণ্ডলে এ পরিবর্তন কেন ঘটছে?
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ১৭৫০ সালের তুলনায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
এ কার্বন ডাই-অক্সাইডই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস, যা প্রকৃতির সব ধরনের স্বাভাবিক আচার-আচরণ বদলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে। প্রবিষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইডের অর্ধেক গাছপালা ও সাগর শোষণ করে এবং বাকি অর্ধেক বায়ুমণ্ডলে রয়ে যায় এবং এ অশোষিত গ্যাস জীবজগতের ক্ষতি করছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতির কার্বন শোষণক্ষমতা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে এবং ভবিষ্যতে কার্বন শোষণক্ষমতা আর বাড়বে না। তাই প্রকৃতিতে রয়ে যাওয়া বাকি কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১৯০০ সালের চেয়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (শূন্য দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বেড়েছে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ দশমিক ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা (১ দশমিক ১ ডিগ্রি থেকে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বেড়ে যাবে, যা মনুষ্যকুল ও সমগ্র জীবজগতের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
ঊর্ধ্বাকাশ থেকে ছুটে আসা অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠ থেকে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত রশ্মি আকারে প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলিত সেই রশ্মির বেশ কিছুটা অংশ শোষণ করে বাতাসের মধ্যে মিশে থাকা সেই দুটি ট্রেস গ্যাস—কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প। এর ফলে বাতাসের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, যেমনটা ঘটে কাচঘর বা হট হাউসের মধ্যে। অন্যদিকে অরণ্য বা বনাঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু তার অনেকটাই অরণ্যের গাছপালা শোষণ করে নেয় এবং সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তা থেকে তৈরি করে কার্বোহাইড্রেট, অবশিষ্ট অংশ শোষণ করে সাগর-মহাসাগর।
বিজ্ঞানীরা বাতাসে বিদ্যমান আরও একটি ট্রেস গ্যাস মিথেনের কথা বলেছেন, যেটা কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ায়। এ মিথেন গ্যাসের উৎস হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা এমনকি রান্নার চুলায়ও আমরা যে গ্যাস ব্যবহার করছি, তার ৭০ থেকে ৯০ শতাংশই মিথেন। এ ছাড়া জৈব জঞ্জালের পচন ও গ্যাস পাইপলাইনের ফাটল ও গরু-মহিষের পায়ুপথ থেকে নির্গত হয়ে এ গ্যাস আবহাওয়ামণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাতাসে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়েছে।
মনে রাখা দরকার, একটি কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু আবহাওয়ার তাপমাত্রা যতটা বাড়ায়, একটি মিথেন অণু বাড়ায় তার ২৫ গুণ বেশি। আবহাওয়ার বর্তমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির ২০ শতাংশের জন্য দায়ী মিথেন।
ট্রেস গ্যাসের মতো আরেক ধরনের গ্যাসের উপস্থিতির ব্যাপারেও কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এদের বলা হয় সিএফসি বা ক্লোরো ফ্লোরোকার্বনস CFCs)। এ গ্যাস শীতক যন্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের স্প্রেতে ব্যবহার করা হয়।
এগুলো আবহাওয়ার তাপমাত্রা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। দেখা গেছে, উষ্ণকরণের ক্ষেত্রে এ গ্যাসের একটি অণুর ক্ষমতা ১০ হাজার কার্বন ডাই-অক্সাইডের অণুর সমান। ব্যাপকভাবে এ গ্যাসের ওজোনস্তর ধ্বংসের ব্যাপারটা নজরে আসার পর আন্তর্জাতিকভাবে আইন তৈরি করে এ গ্যাসের উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং ‘মন্ট্রিল প্রটোকলে’ এটা গৃহীত হয়েছে যে, ১৯৯৬ সালের পর থেকে এ গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহার কোনো দেশ করবে না। তবু আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এর উৎপাদন ও ব্যবহার চলছে।
একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ ‘এল নিনো এবং ‘লা নিনার’ প্রভাব, যার ফলে মেক্সিকো উপকূল থেকে চরম অস্থির উপসাগরীয় উষ্ণ স্রোত বাতাসে তাড়িত হয়ে সুদূর প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরকে উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে উত্তাল করে তুলেছে। এ উষ্ণ স্রোত এশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের বিস্তৃত অঞ্চলের ওপর বৈরী প্রভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সমুদ্রের পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণে ঘনত্ব বেশি (১০২৭ কিগ্রা/ প্রতি ঘনমিটারে, সাধারণ পানির ঘনত্ব ১০০০ কিগ্রা/ প্রতি ঘনমিটারে)। অধিক ঘনত্বের এ লবণাক্ত পানির কার্বন শোষণ করার ক্ষমতা বিপুল।
তাই অধিক ঘনত্বের শীতল লবণাক্ত পানি সাগরের ঢেউয়ের আছড়ানিতে তলদেশে চলে যায়, কম ঘনত্বের নিচের পানি সাগরের উপরিভাগে চলে আসে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আবহাওয়ামণ্ডলে স্থিতাবস্থা বা ভারসাম্য রক্ষা হয়ে আসছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সাগরের কার্বন শোষণক্ষমতা বিপুল, কিন্তু সীমাহীন নয়। পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, সাগর-মহাসাগর পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া অর্ধেক গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করে আবহাওয়ামণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক যুগে অপরিমিত মাত্রায় কার্বন নিঃসরণের ফলে সাগরের তাপ শোষণক্ষমতা একেবারে নিঃশেষ।
তাপমাত্রা এতটা বেড়ে গেছে যে, এখন সাগর গ্রিনহাউস গ্যাসের শোষক না হয়ে উৎস হিসেবে কাজ করছে। সাগরের এ উষ্ণ স্রোতপ্রবাহ মেরু অঞ্চলে বরফ গলিয়ে দিচ্ছে, বিরাট বিরাট বরফ তাক গলে গিয়ে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চতা যে বেড়েছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না, যখন আমরা দেখি আমাদের দেশে বঙ্গোপসাগরের কূলে অবস্থিত ভোলা ও কক্সবাজারের বিরাট এলাকা এখন কিছুদিন পর পর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের জন্য এ প্লাবিত হওয়ার বিষয়টা এক বিরাট অশনিসংকেত।
আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সাগরের ভূমিকা ব্যাপক।
সাগরের পানি থেকে যে উত্তাপ উঠছে, তাতে থিতানি বাড়ছে, বাষ্পীভবন বেশি হচ্ছে এবং একই সঙ্গে সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলে সাইক্লোন, হারিকেন, টর্নেডো এবং জলোচ্ছ্বাস ঘটেই চলেছে। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ সাগর-মহাসাগর এবং ৯৭ শতাংশ অঞ্চল পানিবেষ্টিত এবং সাগর প্রতিনিয়ত কার্বন শোষণ করে চলেছে। তাই জীবজগৎ প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। এ কার্বন সাগরের তলদেশে চলে গিয়ে সেখানে সামুদ্রিক জীব ‘প্লাংকটন’ উৎপাদন ও বৃদ্ধির জন্য খাদ্য বা পুষ্টি হিসেবে কাজ করে ৩ শতাংশ স্থলভাগের প্রাণীকুলকে রক্ষা করছে।
অর্থাৎ, কার্বনটা খরচ হয়ে যাচ্ছে, কোনো বিষম ক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আগেই। সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী এ প্লাংকটন এবং আরও অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীব সাগরের শোষিত কার্বন খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পৃথিবীর স্থলভাগের মনুষ্যকুল ও প্রাণীজগতের দৃষ্টির অগোচরে বাড়তে থাকে। তাদের থেকে বিকীর্ণ ‘ডাই মিথাইল সালফায়েড’ কণা আবহাওয়ামণ্ডলে চলে এসে জলকণা সৃষ্টি করে, যা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে প্রতিফলিত করে ঊর্ধ্বাকাশে পাঠিয়ে দেয়। এদের প্রতিফলনক্ষমতা মেঘের চেয়ে বেশি। এসব রহস্যে ঘেরা পথ বেয়ে পৃথিবী উষ্ণকরণের হাত থেকে লাখ লাখ বছর ধরে রেহাই পাচ্ছে।
এ এক কঠিন বিজ্ঞান, যার অনেক রহস্য এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
মো. আসাদ উল্লাহ খান: পরিবেশবিদ, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।