পাখি পর্ব চলছে
লোকক্রীড়া বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি গ্রামীণ মানুষের খেলাধুলা। গ্রামের মানুষ নিজেদের বিনোদনের জন্য একত্রিত হয়ে যে ধরণের খেলায় অংশগ্রহণ করে সেগুলোই আমাদের কাছে লোকক্রীড়া হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানিক ধারনায় এভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় লোকক্রীড়াকে। এর বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, উৎপত্তিকাল সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতা, নিয়মকানুন ও আয়োজনের আড়ম্বরহীনতা, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, লোকক্রীড়ার জন্য যেসব উপকরণের প্রয়োজন হয় সেগুলো অংশগ্রহণকারী খোলোয়াড়েরা তাদের আশপাশের পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারে অনায়াসে।
এর জন্য কোনধরণের পরিবেশগত তির সম্মুখিন হতে হয় না। বলা চলে এটি লোকক্রীড়ার সবচেয়ে বড় গুণ।
বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণের পেছনে যেসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে লোকক্রীড়া অন্যতম। বর্তমান সময়ের প্রোপটে লোকক্রীড়াকে বিচার করলে চলবে না। একে দেখতে হবে অতীতের আলোকে।
এর ব্যাপ্তির দিকে তাকালে দেখা যায়, আদিম মানুষ থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের আধুনিক মানুষ কেউ এর পরিধির বাইরে নয়। তবে ধারণা করা যায়, এর বৈশিষ্ট্য ও ধরণ সবসময় এক রকম ছিলো না। মানব সভ্যতার আদি পর্বে লোকক্রীড়ার অবস্থা কেমন ছিলো তা নির্ণয়ের তেমন কোন তথ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গবেষকগণ এর উৎপত্তির যে ইতিহাস বয়ান করেন তা থেকে লোকক্রীড়ার প্রচীনত্ব কিছুটা অনুধাবন করা যায়। দীর্ঘ হলেও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হলো এখানে।
‘শ্রম-উৎপাদন-ভোগ-বিশ্রাম যাপিত জীবনের যে প্রবহমান ধারা সক্রিয়; তার একটি বিশেষ পর্ব সূচিত হয় শরীরক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। বিবর্তনের পর্যায় ধরে শারীরিক কসরত হয়ে ওঠে উৎপাদক শ্রেণীর অবকাশ যাপনের নান্দনিক উপাদান। ধীরে ধীরে নান্দনিক এই শারীরিক ক্রিয়া উৎপাদন বিচ্যুত শ্রেণির আনন্দের খোরাক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু উৎপাদনের সাথে সক্রিয় জনগোষ্ঠী এর আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করতে পারে না। শারীরিক এসব ক্রিয়া অবকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবে প্রমোদের বিষয় হয়ে ওঠে।
এগুলো আবার সামাজিক সংহতির মধ্য দিয়ে সমবেত আনন্দের খোরাক নিবৃত করে। টিকে থাকে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে। ’
এই দীর্ঘ মন্তব্যটি থেকে লোকক্রীড়ার উৎপত্তি বিষয়ে খানিক ধারণা পাওয়া যায়। লোকসংস্কৃতি বিষয়ের বিভিন্ন গবেষক মনে করেন, মানব সভ্যতার আদি অবস্থা থেকে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ভাবে লোকক্রীড়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এর জনপ্রিয় উদাহরণ হিসেবে শিকারজীবি সমাজে মানুষের অবসর মুহূর্তের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেন অনেকে।
যেমন, পাথর ছুঁড়ে শিকারের অনুশীলন কিংবা বিভিন্ন জন্তুজানোয়ারের চলাচফেরার অনুকরণ ইত্যাদি। এখনো অনেক ধরণের খেলা খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলোতে মানুষের এই আদিম প্রবণতাগুলোর অস্তিত্ব বর্তমান। বিশেষ করে মানুষ যে আজো তার শিকারজীবি অতীতের কথা ভুলতে পারেনি তা বোঝা যায় বিভিন্ন খেলার মধ্যে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ‘বাঘবন্দি’ খেলাটির কথা অনেককেই জানেন।
চিত্র ০১: বাঘবন্দি খেলার রেখাচিত্র
মাটিতে রেখা অঙ্কন করে (চিত্র ০১) দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। তিনটি তিনটি করে ছয়টি গুটি এই খেলার মূল উপকরণ। গুটিগুলো ইটের খোয়া, গাছের পাতা ইত্যাদি যে কোনকিছুই হতে পারে। খেলোয়ারড়দের মধ্যে একজন বাঘ, অন্যজন ছাগল। বাঘের কাজ হচ্ছে ছাগলরূপী খেলোয়াড়ের সব গুটি খেয়ে ফেলা।
আর ছাগলের কাজ হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত চালের মাধ্যমে বাঘের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে তাকে বন্দি করে ফেলা। খেলাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি। বাঘকে বন্দি করে ফেলার যে প্রচেষ্টা এটা শিকারজীবি সমাজের মানুষের সমবেত প্রচেষ্টার অনুকৃতি। যখন মানুষ আত্মরার তাগিদে বাঘের মতো হিংস্র প্রাণীর সাথে লড়াই করতো বা লড়াই করতে বাধ্য হতো বেঁচে থাকার তাগিদে; সেই শ্বাপদসঙ্কুল আরণ্যক জীবনের গল্প লুকিয়ে আছে এই খেলাটির মধ্যে বলে মনে করা হয়। এরকম আরো একটি খেলা আছে যেটি ‘গাছুয়া খেলা’ নামে পরিচিত।
অবশ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই খেলাটির বিভিন্ন আঞ্চলিক নাম রয়েছে। যেমন, খুলনা এলাকায় একে বলা হয় ‘চম্পা-চম্পি’, দিনাজপুর এলাকায় বলে ‘ডোলবাড়ি’, রংপুর এলাকার ‘গাছুয়া চুন্নি’ খেলাটিও একই বৈশিষ্ট্যের। এই খেলায় একজন ‘বুড়ি’ থাকে। এই বুড়ি গাছের নিচের একটি বৃত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছের উঁচু ডালে অন্য খেলোয়াড়রা আশ্রয় নেয়।
গাছে থাকা খেলোয়াড়েরা বিভিন্নভাবে বুড়িকে বৃত্ত থেকে সরিয়ে সেই বৃত্তে ঢোকার চেষ্টা করে। বুড়ি কোন না কোনভাবে গাছে থাকা খেলোয়াড়দের ছুঁতে চেষ্টা করে। বুড়ি অন্য যে খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে ফেলে সে মরা হয়ে যায়। খুলনা অঞ্চলে এই খেলায় খেলোয়াড়েরা একটি ছড়া ব্যবহার করে। ছড়াটি হচ্ছে:
‘গাছে বসি আয় না
বাঘ-ভাল্লুকে ছোঁয় না।
গাছে যদি বসি
বাঁচে মাসিপিসি। ’
খেলায় এই ছড়াটির ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গাছে বসে থাকা কিংবা কোন উঁচু স্থান যে বাঘ-ভাল্লুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ সেটা বলাইবাহুল্য। অরণ্যসঙ্কুল পরিবেশে এভাবে মানুষের আত্মরার গল্প আমাদের অজানা নয়। এই খেলাটিতে তারই একটি চিত্র পাওয়া যায়।
এধরণের আরো অনেক খেলা রয়েছে। যেমন, বোচা বোচা খেলা, বরফ পানি খেলা ইত্যাদি। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পরেও মানুষের মধ্যে যে আদিম স্মৃতি বেঁচে আছে এই খেলাগুলোর মাধ্যমে তা জানা যায়।
লোকক্রীড়া শুধুমাত্র গ্রামীণ মানুষের আনন্দের উপল নয়। বরং সভ্যতার বিভিন্ন পর্বে যে বিভিন্ন ধরণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, বিভিন্ন পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তার কিছু কিছু সূত্র রয়ে গেছে এই খেলাগুলোর মধ্যে।
এরই সূত্র ধরে এই খেলাগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ইতিহাসবিদ, নৃতাত্ত্বিক কিংবা সমাজবিজ্ঞানীদের। আরোকিছু খেলা আলোচনা করলে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আরণ্যক জীবনে হিংস্র জন্তুজানোয়ারের সাথে যেমন মানুষকে লড়তে হয়েছে, তেমনি লড়তে হয়েছে ভিন্ন গোষ্ঠী বা গোত্রের মানুষের সাথেও। নিজেদের রা করতে গিয়ে প্রতিটি গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মতো করে নানা ধরণের যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করে। যেগুলো সময়ের ধারাবাহিকতায় নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে লোকক্রীড়ার অবয়বে টিকে রয়েছে এখনো।
এখানে আমাদের জাতীয় খেলা ‘হা-ডু-ডু’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে।
চিত্র ০২: হা-ডু-ডু খেলার একটি মুহূর্ত (ছবি সংগৃহীত)
খোলা মাঠে দাগ (কোট) কেটে দুই দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই খেলা। এক দলের খেলোয়াড় প্রতিপ দলের কোটে যায় তাদের ছুঁতে। এক দলের খেলোয়াড় প্রতিপরে কোটে গিয়ে সেই দলের খেলোয়াড়কে ছুঁলে যেমন পয়েন্ট পায়। তেমনি প্রতিপ দলের খেলোয়াড় তাদের কোটে আসা অন্য দলের খেলোয়াড়কে ধরতে পারলেও পয়েন্ট পায়।
এক দল আরেক দলকে ছুঁতে যাওয়া কিংবা অন্য দলের খেলোয়াড়কে আটক করার এই বিষয়টিকে এক গোষ্ঠীর অন্য গেষ্ঠীকে আক্রমন করা এবং অন্যগোষ্ঠী কর্তৃক আক্রমন প্রতিহত করার প্রতীকি রূপ হিসেবে গন্য করা হয়।
তবে সব খেলাই যে মানুষের আদিম ইতিহাস নির্ভর সেটা মনে করার কোন কারণ নেই। অর্বাচিন কালের অনেক ঐতিহাসিক উপাদনও লোকক্রীড়ার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে। এরকম একটি জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ‘লাঠি খেলা’। এই খেলাটিকে বীর রসের খেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে প্রচলিত রয়েছে এই খেলাটি। যশোর-খুলনা অঞ্চলে একে ‘ঢালি’ খেলা নামে অভিহিত করা হয়। ঢাল ও সড়কি সজ্জিত পদাতিক সৈন্যদের ঢালি বলা হয়। যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে ৫২ হাজার ঢালি সৈন্যের খবর আমরা জানি। যশোর-খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঢালি সৈন্য হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো একসময়।
সড়কি ও লাঠি চালনায় অত্যন্ত দ এবং প্রি ছিলো এরা। ব্রিটিশ ভারতে ঢালি সেনাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের যুগ শেষ হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। একসময় যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপরে সামনে যে সড়কি-লাঠির কসরত আতঙ্কের কারণ ছিলো, সময়ের হাত ধরে তাই মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য উপস্থিত হয় লঠি খেলা নামে। দণি বাংলা এবং বাংলাদেশের বিস্তৃত চরাঞ্চলের মানুষের হাতে লাঠি খেলা নানা মাত্রা পেয়েছে এবং এখনো তার চর্চা ও প্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে।
চিত্র ০৩: লাঠি খেলা (ছবি: সিআরএসি ডিজিটাল আর্কাইভ)
মানবসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষকে পারি দিতে হয়েছে বন্ধুর নানা পথ।
এই পথপরিক্রমার একপর্যায়ে মানুষের ভেতর মতা আর আধিপত্যবাদের ধারণা জন্মায়। এরপর থেকে মানুষের জীবনে নানা ধরণের নতুন নতুন সংকট দেখা দিতে থাকে। উচ্চবর্গের মতা আর আধিপত্যবাদের কাছে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ ক্রমে অসহায় হয়ে পড়তে থাকে। এসময় সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের উপর এক ভিন্ন ধরণের আঘাত আসতে থাকে। সাধারণ মানুষের জীবনের এইসব ঘটনা প্রবাহ নানা আঙ্গিকে লোকক্রীড়ার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে।
এর উদাহরণ হিসেবে ‘গোল্লাছুট’ খেলাটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এই খেলাটিতে একটি ছোট বৃত্তকে কেন্দ্র করে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে থাকে কয়েকজন বালক-বালিকা। তাদের বৃত্তাকার ঘূর্ণন পথের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আরো কয়েকজন বালক-বালিকা। ক্রীড়ার পরিভাষায় যারা ঘূর্ণনরত বালক-বালিকাদের প্রতিপ। ঘূর্ণনরত বালক-বালিকারা ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ বুঝে প্রতিপরে খেলোয়াড়দের ফাঁক গলে পালিয়ে যায়।
এভাবে পালাতে পালাতে শেষের খেলোয়াড়টিও পালিয়ে যায়। কিন্তু পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রতিপরে নির্ধারণ করা শাস্তি ভোগ করতে হয় সবাইকে এবং পুণরায় বৃত্তকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হয় তাদের। প্রশ্ন হচ্ছে ঘূর্ণনরত বালক-বালিকারা (গোল্লা) কেন বৃত্ত ভেঙ্গে বাইরে পালাতে চায়? আর কেনইবা বৃত্তের বাইরে থাকা প্রতিপরে খেলোয়াড়েরা তাদের আটকিয়ে শাস্তি দেয়? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের যাপিত জীবনের এক অজানা অধ্যায়ের গল্প। ধারণা করা হয়, গোল্লাছুট দাস জীবনের স্মৃতি বহনকারী একটি খেলা। প্রভূদের অত্যাচারে বিবর্ণ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করতো দাসরা।
পালানোর সময় কখনো কখনো ধরা পড়ে গেলে তাদের উপর নেমে আসতো পূর্বের চাইতেও ভয়াবহ অত্যাচার এবং তাকে পুণরায় দাস জীবনে ফিরে যেতে হতো।
দাস জীবনের বঞ্চনাকে উপজীব্য করে আরো একটি জনপ্রিয় খেলা প্রচলিত রয়েছে বাংলাদেশে। এটি হচ্ছে ‘এলাটিং বেলাটিং’। দুটি দলে বিভক্ত হয়ে এই খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর একদল হচ্ছে রাজা, অন্যদল প্রজা।
দু’দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছড়া আবৃত্তি করতে থাকে। ছড়াটি হচ্ছে:
এলাটিং বেলাটিং সৈ লো
কী খবর আইলো?
রাজা একটি মিয়া চাইলো।
কোন মিয়াটাক চাইলো?
অমুক মিয়াটাক চাইলো।
কী পইরা যাইবো?
বিনারুশী পইরা যাইবো।
কী চইরা যাইবো?
পাল্কী চইরা যাইবো।
কতটাকা দিবো?
হাজার টাকা দিবো।
এভাবে নির্দিষ্ট নামধারী খেলোয়াড় রাজার দলে যোগ দেয়। এক এক করে রাজার দলে খেলোয়াড়েরা আসতে থাকে এবং একপর্যায়ে খেলাটি শেষ হয়। উল্লেখ্য, কী পইরা যাইবো, কী চইরা যাইবো আর কত টাকা দিবো? এই প্রশ্ন তিনটির উত্তর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় রাজা ডেকেছে বলে মেয়েটি বা প্রজারা রাজার বাড়িতে যাচ্ছে।
কিন্তু এর অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। সামন্তযুগে রাজা-বাদশারা তাদের জীবনের আবশ্যিকতাকে বহুমাত্রিকভাবে জিইয়ে রাখতে দাস-দাসী ক্রয় করতো। শুধু রাজা-বাদশারাই নয়। অনেক সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষের বাড়িতে দাস-দাসী থাকতো বলেও জানা যায়। এই দাস-দাসীরা নানাধরনের কায়িক শ্রমে নিয়োজিত হতো আবার কখনো কখনো প্রভূদের যৌন জীবনের সঙ্গী হতেও বাধ্য হতো।
ভারতবর্ষসহ সারা পৃথিবীতে এই ছিলো দাস ব্যবস্থার চিরায়ত রূপ। সামাজিক ইতিহাসের এই বেদনাদায়ক আখ্যান উঠে এসেছে এলাটিং বেলাটিং নামক লোকক্রীড়াটিতে ব্যবহৃত ছড়ায়।
এধরনের আরো একটি খেলা আছে-ওপেনটি বাইস্কোপ। বাংলাদেশের প্রায় সব স্থানেই এই খেলাটির প্রচলন রয়েছে। খেলার সময় আবৃত্তি করা ছড়াটি বোধ হয় খেলাটির চাইতেও বেশি পরিচিত এবং জনপ্রিয়।
বিভিন্ন আঞ্চলিক পাঠ রয়েছে ছড়াটির। বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব বিভিন্ন বিষয়ও যুক্ত হয়েছে এতে। ছড়াটি এরকম:
ওপেনটি বাইস্কোপ
নাইন টেন তেইশকোপ।
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা।
বাবু বলেছেন যেতে
পানসুপারি খেতে।
পানের আগায় মৌরি বাটা
ইস্কাবনের ছবি আটা।
আমার নাম সোনামনি
যাতি হবে অনেকখানি।
আমার নাম নেণুবালা
যাতি হবে যশোর জিলা।
যশোর জিলার সাহেবরা
নিয়ে গেলি ফরৎ দে না।
নারী জীবনের বঞ্চানার কথা বলা হয়েছে উপেনটি বাইস্কোপ খেলার এ ছড়াটিতে।
সুলতানা বা চুলটানা বিবিয়ানা একটি তুরুণীকে বাবুর বৈঠকখানায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সুগন্ধিযুক্ত মসলা দিয়ে প্রস্তুত পান খাওয়ার জন্য। তরুণী বলছে তার নাম সোনামণি এবং তাকে আরো দূরে যেতে হবে বলে তার হাতে সময় নেই। এই ছড়াটি কলকাতাকে কেন্দ্র গড়ে ওঠা বাবু কালচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাবু কালচারের অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে নারীসঙ্গ ছিলো একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। ছড়াটির শেষের চার লাইন যশোর-খুলনা অঞ্চলের সংযুক্তি।
এ অংশেও একইরকম বক্তব্য পাওয়া যায়।
ডাংগুলি, কানামাছি, বৌ চোর, ফুল টোক্কা ইত্যাদি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত খেলাগুলো বিশ্লেষণ করলে ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান আমাদের সামনে উপস্থিত হবে এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একারণে আমরা বলতে চাই লোকক্রীড়াগুলোকে শুধুমাত্র গ্রামীণ মানুষের ক্রীড়া বলে উন্নাসিকতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বরং এগুলোর যথাযথ সংরণ এবং বিশ্লেষণ আমাদের ইতিহাস বিনির্মাণের নতুন তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া কিছু কিছু খেলার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি হা-ডু-ডু খেলা কিছুটা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে কাবাডি খেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এবং ইতিমধ্যেই এই খেলাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। ভারতীয় লোকক্রীড়া ‘খো খো’ও ইতিমধ্যে লোকায়ত ধরন ছেড়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত। আমরা এক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় একটি খেলার কথা উল্লেখ করতে পারি। এটি হচ্ছে ‘ষোল গুটি’ বা ‘চকাচল’।
কখনো কখনো এই খেলাটি ২৮টি গুটিতেও খেলা হয়। এটি দাবার মতো একটি খেলা। মাটিতে দাগ কেটে দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যে এই খেলাটি সম্পন্ন হয় গ্রামে গঞ্জে অবসর সময়ে। তবে শহরের ফুটপাথে, পার্কের বেঞ্চেও দাগ কেটে এই খেলাটি খেলতে দেখা যায় কখনো কখনো। আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত হবার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে এই খেলাটির।
চিত্র ০৪: ষোলগুটি খেলার রেখাচিত্র
ষোলগুটির মতো একই ধরনের একটি খেলা রয়েছে চীন দেশে। এর নাম Chinese Chess। এর চীন দেশীয় নাম Xiangqi। ষোলগুটির মতো অবসর সময়ে এই খেলাটি খেলে থাকে চীনের মানুষ। এখন চেজ বোর্ড বানিয়ে খেলা হলেও এটি আসলে মাটিতে দাগ কেটে খেলা হতো একসময়।
লোকায়ত উৎসের এই খেলাটি এখন চীন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
চিত্র ০৫: Chinese Chess
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু খেলা যখন লোকায়তের অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বের দরবারে জায়গা করে নিচ্ছে, তখন আমরাই বা পিছিয়ে থাকবো কেন? লোকক্রীড়াগুলোকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য প্রথমে প্রয়োজন এগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সংগ্রহ এবং পরে এগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের প্রোপটে এদুটোর কোনটিই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়নি আজো। লোকসংস্কৃতি বিষয়ের কোন কোন গবেষক ব্যক্তিগত আগ্রহের যায়গা থেকে কিছু খেলার নমুনা সংগ্রহ করেছেন বটে। কিন্তু সেটা কতোটা বিজ্ঞান ভিত্তিক সেবিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আবার লোকক্রীড়ার বিচার-বিশ্লেষণের যে ধারা আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে সেটাকেও ঠিক আধুনিক বলা যায় না। এবিষয়ে নান মুণির নানা মত রয়েছে। তাই এবিষয়ে যুগপৎ সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের ধারা ঠিক করে নেয়া উচিৎ আমাদের। সেই সাথে এটাও খুঁজে বের করা দরকার কোন কোন খেলাগুলোর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: সিআরএসি লাইব্রেরী
সহায়ক সূত্র:
১. শামসুজ্জামান খান (সম্পাদিত) বাংলা একাডেমী পত্রিকা (ফোকলোর বিশেষ সংখ্যা), ৫২ বর্ষ, ২য় সংখ্যা; এপ্রিল-জুন ২০০৮।
অনুপম হীরা মণ্ডলের প্রবন্ধ বাংলাদেশের লোকক্রীড়া: সামাজিক সম্বন্ধের পাঠ।
২. মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা। প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৩.Chinese Chess –এর ছবি http://hem.passagen.se/melki9/chinesechess.htm থেকে নেয়া।
প্রথম প্রকাশ:
বেঙ্গল বারতা
১৪ জানুয়ারি ২০১১
নোট: এই লেখাটির মূল শিরোনাম লোকক্রীড়া: ইতিহাস ও সম্ভাবনার সরল পাঠ।
এই শিরোনামটি পরিবর্তন করে লোকক্রীড়া শিরোনামে প্রকাশ করে বেঙ্গল বারতা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।