আমি নতুন কিছু পড়তে ভালবাসি
প্রথমে সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিলাম যে এই বিষয়ে কিছু লিখবো না। কিন্তু বিবেক বসে থাকতে দিল না। যতই চিন্তা করি ততই নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। তিনি যদি আমার বোন হতেন, তাহলে কি আমি বসে থাকতে পারতাম! অবশ্যই আমি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতাম। কিন্তু এখন আমি যেই দেশের নাগরিক সেই দেশের একজন অসহায় মেয়েকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে তা তো মেনে নেয়া যায় না।
তিনি যেহেতু এ দেশের নাগরিক তাই তিনি আমারো বোন। আর এই বোনের নির্মম মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই আমার আজকের এই লেখা।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারা জানেন গত ৭জানুয়ারী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি সীমান্তে কিশোরী ফেলানীকে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনী-বিএসএফ। ফেলানীকে হত্যার পর ৫ঘন্টা তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়! এই ঝুলন্ত লাশের ছবি প্রথমে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ছবি প্রকাশিত হয়।
বিএসএফ এর এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও মানবাধীকার সংগঠনগুলো এর তীব্র সমালোচনা করে আসছে। অথচ আমাদের দেশের সরকার এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ব্যাপারে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি!
সর্বশেষ ১৭জানুয়ারী বাংলাদেশী জনগনের কঠোর চাপের মুখে বাংলাদেশের সরকার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানালো! এরপরও সেই প্রতিবাদলীপিতে কি লেখা আছে তা কাউকেই জানতে দেওয়া হয়নি! প্রতিবাদলীপিটি শুধু ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েই মুক্ত হয়ে গেছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়! এই যদি হয় আমাদের দেশের সরকারে অবস্থা তাহলে কোন শত্রুই যে আমাদেরকে হামলা বা খুন করতে পিছপা হবে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
একজন চোর যদি একটি বাড়িতে এক ল টাকা চুরি করে বিচারের সম্মুখীন হয় আর বিচারকরা সেই চোরের কাছে ৫০হাজার টাকা জরিমানা দাবী করে উক্ত চোরকে ছেড়ে দেয় তাহলে সেই সমাজে যে চোরদের চুরি করা আরও কয়েকগুন বেড়ে যাবে তা আর কাউকে খুলে বলার প্রয়োজন নাই।
আমাদের দেশের অবস্থাও আজ এমনটিই হয়েছে।
ভারত আমাদের দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সেই দায় আবার আমাদের ঘারেই চাপিয়ে দিচ্ছে! বিএসএফরা বলছে যে বাংলাদেশীরা ভারতে গরু পাচার (ব্লাক) করার জন্য আসার কারনেই এই হত্যাকান্ড ঘটানো হচ্ছে। অনেকটা আমাদের দেশের র্যাবের হত্যাকান্ডের মত আর কি। এরপরও না হয় মানলাম যে গরুপাচার করার সময়ই আমার দেশের মানুষকে তারা হত্যা করছে, কিন্তু তারা যে আমাদের দেশের সেই সব মানুষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে তার হিসাব কে দিবে? ফেলানীর বাবাও তো অনেক টাকা দিয়ে ভারতের জনগনের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন, তাহলে সেই ভারতের জনগনের কি বিচার হবে? হত্যাই যদি হয় এর একমাত্র সমাধান তাহলে আমাদের বিজিবিরাও তো এরকম অনেক ভারতীয়কে হত্যা করতে পারে। আমরাও কি তাহলে সেই কাজটিই করবো! আমাদের সরকার কি আসলেই এত মেরুদন্ডহীন যে ভারত আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবে আর আমরা একটি প্রতিবাদও করতে পারবো না!
শেষ পর্যন্ত যেটা হয় সেটা হল পতাকা বৈঠক! তারা আমার ভাই-বোনকে হত্যা করবে আর আমাকে একটা পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সন্তুষ্ট থাকতে হবে! এই পতাকা বৈঠকও একদিকে চলে আর অন্যদিকে আমার ভাই-বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করছে ভারতীয় এই নারকীয় বাহিনী। অথচ আমাদের দেশের প্রধানরা শক্ত করে কখনই এর প্রতিবাদ করেনি! এটা যে ঐ চোরের মতই অবস্থা হবে তা আর বলতে কি! কারন তারা আমার দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে একটা পতাকা বৈঠকেই পার পেয়ে যাচ্ছে! এতে যে তাদের হত্যা করার নেশা আরও বেড়ে যাবে তা সকল সচেতন মানুষই অনুধাবন করতে পারবে।
যেই গরু পাচারের কথা বলছিলাম।
আমাদের বাড়ি সীমান্তবর্তী হওয়ার কারনে আমি দেখেছি যে ভারতীয়রা কিভাবে তাদের গরু আমাদের দেশের পাশে এসে দিয়ে যায়। আর এই ন্যাক্কারজনক কাজটা আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশি হয়। আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতারা এই কাজটা অন্যদের দিয়ে করিয়ে থাকে এটা বর্ডারের সকলেই কম-বেশি জানে। আওয়ামীলীগের নেতাদের এই কাজ করতে গিয়ে জীবন দিতে হচ্ছে আমার বোন ফেলানীকে! অথচ আওয়ামীলীগের সেই নেতারা রয়ে যাচ্ছে সকল আলোচনার বাইরে! আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ''খায় ছলিম উদ্দীন আর মোটা হয় কলিম উদ্দীন'' এই আর কি! অনেক কষ্ট করে সাধারন কিছু মানুষকে দিয়ে নেতারা ল ল টাকা কামাই করে নিচ্ছে অথচ তারা সারা জীবন গরীবই থেকে যাচ্ছে অথবা নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ জীবনটুকুও দিয়ে দিচ্ছে! হায়রে আমাদের রাজনীতি! হায়রে আমাদের নেতা!!!
আমাদের দেশে আজকে যারা সরকারে আছেন তার কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের বুলি আওড়ান।
তাদের মুখদিয়ে যেন মুক্তিযুদ্ধের খই ফোটে। অথচ তাদের সেই মুখ দিয়েও একটা প্রতিবাদ করার সাহস হল না! তাহলে কি আওয়ামীলীগ ভারতের ঋণ পরিশোধ করতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে? ভারত আমাদের দেশ স্বাধীনে সহযোগিতা করেছিল, তার মানে কি এই যে তারা অন্যায় করলেও তাদের সেই অন্যায়ের কোন বিরোধীতা করা যাবে না! কিন্তু বাংলাদেশে যারা স্বাধীন করেছিল তারা হল আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, তারা কখনই ভারতের এই অন্যায় আচরন মেনে নেব না। তারা অবশ্যই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ও জানাতেই থাকবে। এই প্রতিবাদের মুখে এসে কেউই দাড়াতে পারবে না।
আমার প্রিয় বোন ফেলানীকে হত্যার মাত্র নয় দিন পরেই তারা আবার আমার এক ভাই শাহজাহানকে বাংলাদেশ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এই মানুষ নামক জানোয়ার বিএসএফরা।
এবার তারা এই ঘটনা ঘটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চলতি মাসের মাত্র ১৬দিনেই বিএসএফরা হত্যা করে চারজন বাংলাদেশী নাগরিককে! ৮জানুয়ারী রাজশাহীর খানপুর সীমান্তে সিরাজুল ও আইজুদ্দিন নামে দুই বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার যদি এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে সজাগ না হন তাহলে আমি নিশ্চিত এই দেশের আম জনতাই সরকারকে প্রতিবাদের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলবে। এরমধ্যে হয়েছেও তাই। ইতোমধ্যে সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করে গত ১৭জানুয়ারী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছে।
আমার বিশ্বাস যেভাবে বাংলাদেশের জনগন জেগে উঠছে তাতে কাপুরুষ ভারতীয়দের পিলে চমকে যাবে।
ভারতের সাথে তো আরও কয়েকটা দেশের সীমানা আছে, কই কখনওতো শুনি নাই যে ভারত চীন বা মায়ানমারের কোন মানুষকে হত্যা করেছে! তার মানে ভারত শক্তের ভক্ত আর নরমের জম। অন্যান্য দেশ শক্ত ভুমিকা রাখার কারনে তাদেরকে কিছুই বলছে না আর আমরা জি হুজুর, জি হুজুর করার কারনে আমাদেরকে জাপটে ধরে কামড়ে খাচ্ছে। আজ আমরাও যদি তাদের মত হতাম তাহলে দেখতেন যে তারা এখান থেকেও লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে।
ভারতীয়রা যে আমাদের সাথে বরাবরই খারাপ আচরন করে আসছে তা এক ঐতিহাসিক সত্য কথা।
তারা জানে যে বাংলাদেশীদেরকে আমরা কত ঠকিয়েছি। আর এই কারনেই ভারত অন্য কোন দেশের মানুষকে না মারলেও বাংলাদেশের মানুষকে পাখির মত গুলি করে মারছে!
এই বিষয়টিই আরও ভাল করে বলেছেন ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ। যিনি ১৯৭১সালে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন।
তিনি বলেছেন-
''যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষনা করা হয় তাহলে ভারতের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। যেদিন আমার সৈনিকরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি এ কথা উপলদ্ধি করি।
বাংলাদেশীদের কখনই ভারতের প্রতি তেমন ভালবাসা ছিল না। আমি জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিৎ ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মত আচরণ করেছেন। '' স্টেটম্যান, ২৯এপ্রিল ১৯৮৮।
মানেক শ এর কথার সাথে যদি আজকের ভারতের মিল খুঁজি তাহলে মনে হয় একজন সাধারন মানুষও এই বিষয়টা বুঝতে পারবে যে তারা কেন আমার প্রিয় বোন ফেলানীকে এরকম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে।
গত কয়েকবছরে ভারত আমাদের যতগুলো তাজা প্রাণকে কেড়ে নিয়েছে তার তিপুরন কি তারা আমাদেরকে দিতে পারবে?
মানবাধীকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে ২০০৭সালে বিএসএফ ১২০জন বাংলাদেশীকে হত্যা ও ৮২জনকে আহত এবং ৯৮জনকে অপহরণ করে।
২০০৮সালে ৬২জনকে হত্যা, ৪৭জনকে আহত এবং ৮১জনকে অপহরণ করে। ২০০৯সালে ৯৮জনকে হত্যা ৭৭জনকে আহত এবং ২৫জনকে অপহরণ করে। আর ২০১০সালে ৭৪জনকে হত্যা, ৭২জনকে আহত এবং ৪৩জনকে অপহরণ করে! এই হল বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আচরণের সংপ্তি নমুনা।
এরা যে আমার বোনকে বর্বতার সাথে গুলি করে হত্যা করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। কিন্তু মন যে কিছুতেই এটা মেনে নিতে চায় না।
বিশ্বাস করুন, আমি যখন ফেলানীর লাশকে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে দেখলাম (মিডিয়ার কল্যাণে) তখন আমার মনে হল এ যেন ফেলানী নয় বরং অনেক রক্তের বিমিয়ে কেনা আমাদের এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রক্তিম মানচিত্র। যেই মানচিত্রকে কিনতে আমার মা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিলেন আর আমার বাবা না খেতে না খেতে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন। আজকে সেই মানচিত্রটি অবহেলা আর অ-যতনে ভারতের কাঁটাতারের উপর ঝুলছে!
ভারতের কাছে আমার জানতে ইচ্ছে হয় আর কত ফেলানীকে পেলে তোমাদের হৃদয় শান্ত হবে, তোমাদের রক্তের নেশা বন্ধ হবে আর কত? তোমরা না হয় সেই সংখ্যাটা আমাদের কাছে একবারেই পাঠিয়ে দাও, আমরা যে করেই হোক তোমাদের সেই নেশা মিটিয়ে দেব, তবু এভাবে আর আমার বোনকে অপমানিত করো না। অপমানিত করো না আমার প্রিয় এই মানচিত্রকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।