আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাঝখান থেকে একটা চ্যাপ্টার....

মাথায় অনেক গল্প আসে; কিন্তু লেখার মত পর্যাপ্ত ধৈর্য-শ্রম-অধ্যবসায় নেই। গল্পগুলোকে তাই ছোট করে কবিতা বানাই...

৭. অনিমের ঘুম ভাঙল বেলা বার'টার পর। হাত-মুখ ধুয়ে রুমে এসে দেখে ঝুমু বসে আছে। ঝুমু'টাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে, অনিম ধরতে পারছেনা অন্যরকম'টা কিসে। অনিম মুখ মুছতে মুছতে বলল, "কিরে, এত সাত-সকালে?" - "এটা সাত-সকাল নাকি?" অনিম ঘড়ি দেখল।

তার জন্য এটা সকাল-ই। - "অনিম ভাই, তোমার একটা ফোন এসেছিল" - "ও", অনিম আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। - "তৃণা নামের কেউ" অনিম কথা না বলে চুল আঁচড়াতে লাগল। ঝুমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার নিজেই প্রশ্ন করল, "উনি কে? তোমার ফ্রেন্ড?" অনিম এবার ঝুমুর দিকে তাকাল, "উনি'টা আবার কে?" - "তৃণা? তোমার সাথে পড়ে?" - "আরে নাহ", অনিম হাত নাড়ল, "তোর সাথে পড়ে" ঝুমু চুপ হয়ে গেল। অনিম ভাইটা সবসময় এভাবে কথা বলে কেন? সে আর কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে রাখল।

অনিম এবার নিজে থেকেই কথা বলল, - "ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি? না রে পাগলী, তৃণা আসলেই তোর সাথে পড়ে। এবার ক্লাস টেন-এ। খাস্তগীর-এ বোধহয়..." - "তাহলে তোমার ফ্রেন্ড হল কিভাবে?" - "আমার ফ্রেন্ড কে বলল?" - "ও", ঝুমুর গলার কাছে কয়েকটা প্রশ্ন এসে আটকে গেল। অনিম আশা করছিল ঝুমু ঝগড়ার ভঙ্গিতে পরের প্রশ্ন করবে, 'তুমি কি আজকাল খাস্তগীরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক নাকি?'; কিন্তু ঝুমু সেদিকে না গিয়ে জিজ্ঞেস করল, - "চা খাবে?" - "গুড ! কড়া করে এক কাপ দে তো?" ঝুমু হেঁটে যাওয়ার সময় বেশ একটা শব্দ হল। মনে হয় হাতে চুড়ি পড়েছে অনেকগুলো।

ঘরের মধ্যে অনেকগুলো চুড়ি পড়ে ঘোরার মানে কী? ঝুমু যখন চা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, অনিম হঠাৎ বুঝতে পারল 'অন্যরকম' ব্যাপারটা কোথায় ! - "সর্বনাশ ! তুই দেখি আজ শাড়ি পড়ে বসে আছিস ! তোকে তো পরীর মত লাগছে!" ঝুমু হাত নেড়ে বলল, "যাও!" তার গাল দু'টো লাল হয়ে উঠছে। - "কী ব্যাপার বল তো? হঠাৎ শাড়ি? আর এত সুন্দর শাড়ি তোকে কে দিয়েছে?" - "বাবা দিয়েছে। জন্মদিনে। " - "কোন জন্মদিনে? আগে তো কখনও পড়িসনি !" - "এবারের জন্মদিনে..." অনিম কিছুক্ষণ ভেবে বলল, "এ বছর তোর জন্মদিনটা গেল কবে? আমি কোথায় ছিলাম?" ঝুমু চুপ করে রইল। - "কি রে, বললি না?" অনিম চা-য়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে।

- "আমার জন্মদিন আজ। শুধু তুমি ছাড়া আর সবার মনে আছে সেটা..", ঝুমু'র চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। অনিম আচমকা ঝুমু'র হাত ধরে বলল, "চল বাইরে যাবি?" - "যাব" - "ওকে, টগরকে রেডি হতে বল, আমি জাস্ট পান্জাবীটা পড়লেই রেডি" ঝুমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "টগর যেতে পারবে না। ওর গত তিনদিন ধরে জ্বর।

তুমি আজকাল কারও খবর রাখো না" কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অনিম বলল, "চল এখনই বের হই। কোথায় যাবি?" - "তোমার যেখানে ইচ্ছা" - "একটু দাঁড়া, আমি পান্জাবীটা পড়ে নিই", উঠতে গিয়ে অনিম দেখল তার হাত তখনও ঝুমুর হাতে ধরা। ঝুমু শক্ত করে ধরে রেখেছে। - "আমি রেডি হতে যাব? না তোর হাত ধরে এখানে বসে দিন কাটাব?" ঝুমু যন্ত্রের মত আবার বলে উঠল, - "তোমার যেখানে ইচ্ছা" অনিম ঝাঁকি দিয়ে বলল, "এই পাগলী, কী হয়েছে তোর?" ঝুমু আচমকা হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাল। ******************************************************************** বাস টার্মিনাল পর্যন্ত গিয়ে অনিম আবার জিজ্ঞেস করল, "তুই ক্যাম্পাসেই যেতে চাস? আর কোথাও না?" - "হুম", ঝুমু মাথা নাড়ল, "কেন, তুমিই তো বল, এত সুন্দর ক্যাম্পাস, একদিন নিয়ে যাবে ঘুরতে।

এখন আবার যেতে চাচ্ছ না কেন?" - "না, মানে এখন তো শর্ট-টার্মের বন্ধ চলছে। পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা - তোর ভাল লাগবে না। " - "আমি কখন বললাম ভিড়-ভাট্টা আমার ভাল লাগে?" অনিম হাল ছেড়ে দিয়ে একটা CNG ট্যাক্সি ভাড়া করল। টার্মিনাল থেকে চুয়েট ক্যাম্পাসের দুরত্ব ২৩-২৪ কিলোমিটার হবে। সে হিসাবে ট্যাক্সি ভাড়া অনেক কম।

১০০ টাকা'র মত। শেয়ারে পাঁচজন গেলে জনপ্রতি বিশ টাকা ভাড়া পড়ে। রিজার্ভ করলে মানুষ বুঝে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত রাখে। দু'পাশে সবুজ ধানক্ষেত রেখে কাপ্তাই রোডে ট্যাক্সি প্রায় উড়ে চলল। বাতাসে ঝুমু'র চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে।

শাড়িতে ঝুমু'কে হঠাৎ অনেক বড়-বড় লাগছে। অনিম বলে বসল, "তোকে তো একদম বউ-বউ লাগছে আজ!" ঝুমু আবার লাল হল। এ মেয়েটা লাল হয়ে উঠলেই দেখতে বেশি ভাল লাগে। একটু সামলে ঝুমু বলল, "তোমাকেও পান্জাবীতে জামাই-জামাই লাগছে। চল আমরা বউ জামাই সেজে ঘুরি", এই বলে অনিমের এক হাত জড়িয়ে ধরল।

ট্যাক্সি ড্রাইভার রিয়ারভিউ মিররে দুজন'কে দেখে হাসতে লাগল। সেটা খেয়াল করে ঝুমু বলে উঠল, "ড্রাইভার সাহেব, আপনি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান! যে স্পীডে টানছেন, মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে একটা newly-wed-couple-কে অ্যাক্সিডেন্ট করে মেরে ফেলবেন!" ড্রাইভার কি বুঝল কে জানে, অনিম শব্দ করে হেসে উঠল। ঝুমুর হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে নিতে বলল, "তোকে দেখে ইদানিং ভাবছিলাম, বড় হতে হতে তুই সব দুষ্টামিগুলা হারিয়ে ফেলছিস। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, না, তুই আগের মতই ফাজিল আছিস এখনও!" হাত সরিয়ে নিতে দেখে ঝুমু'র এমন রাগ হল হঠাৎ! হ্যাঁ, যদি ফাজলেমিই করে থাকি তো বেশ করেছি! সারাটা জীবন করব এমন ফাজলেমি। ঝুমু'র চোখ দু'টো আপনা-আপনি ঝাপসা হয়ে উঠছে।

সে দূরে কোথাও তাকাবার চেষ্টা করল প্রাণপণ - কিছু দেখতে পাচ্ছে না। আচ্ছা, অনিম'টা কি কিছুই বুঝে না? এও কি সম্ভব? নাকি সব বুঝেও তাকে ইচ্ছা করে জ্বালায়? রাজ্যের যত ধূলো-বালি সব ঝুমুর চোখে এসে জমা হল। তাকে এখনই চোখ মুছতে হবে। পাশে বসে অনিম-ও ভাবছিল ঝুমু'র কথা। তবে সে ভিন্ন কথা।

ভিন্ন স্রোতের কথা। খুব বেশিদিন আগের কথাও তো না - অনিম ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, ঝুমু তখন ক্লাস ফোর-এ। ঝুমু'রা পাশের বাসায় এসেছে তখন সবে এক বছর হয়। এর মাঝেই অনিমদের বাসাটাই ঝুমু'র বাসা হয়ে যায় - সে যেন এই বাড়ির মেয়েই ছিল আজন্ম। একটা আদুরে পুতুল হয়ে সারাটা বাসা ঘুরে বেড়াত আর কেউ কিছু বললে গাল ফুলিয়ে অনিমের কাছে নালিশ করতে আসত।

তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ছিল অনিম। সে জানত, আর সবাই তাকে বকা দিলেও, 'ভাইয়া' কখনও তাকে বকা দিবে না। তার সব সমস্যার সমাধান শুধু ভাইয়া জানে। সেই অনিম একবার বেখেয়ালে হঠাৎ ধমক দিয়ে বসেছিল, তাতেই সে কী কান্ড ! মেয়ে খাওয়া-দাওয়া ভুলে সে কী কান্না! অনিমের মা কান ধরে অনিমকে পাঠিয়েছিলেন ঝুমুকে শান্ত করতে। নাটক কম করত না এই পিচ্চি মেয়ে।

ভেবে অনিমের হাসি পেল আজ। অনিম যে বাবা-মা'র এক ছেলে, ঝুমু আর টগরের জন্য সেটা টের পেতে হয় নি গত ছ-সাত বছর। হঠাৎ তার খেয়াল হল, আচ্ছা, ঝুমু তো তাকে সবসময় 'ভাইয়া' বলে ডাকত, কিন্তু ইদানিং 'অনিম ভাই' ডাকে ! কবে থেকে শুরু হল, তা-ও সে খেয়াল করে নি! ব্যাপারটা কি জিজ্ঞেস করতে ঘুরেই দেখে, ঝুমু কখন তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে! আশ্চর্য, সে চিন্তায় এত মগ্ন ছিল যে টের-ই পায় নি ! অনিম আবার তাকাল, যেন ডানাকাটা একটা পরী। অনিমের মনে হল, ঝুমু যেন আজ হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে! আজ তার জন্মদিন, কত তম জন্মদিন? পনের নাকি ষোল? অনিম আবার অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সে এটাও ঠিক মত জানে না! জিজ্ঞেস করতে হবে। মেয়েরা নাকি বয়স বলতে চায় না, ঢং ! ঝুমু'র কথা আলাদা, সে ঢং করে কথা বলতে পারে না; তার সব কথায় কেমন যেন একটা গভীর মায়া মিশে থাকে।

অনিম দেখল ঝুমু'র গালের উপর একটা জলে ফোঁটা চকচক করছে। একে তো শীতকাল, তার উপর হু হু করে বাতাস আসছে, ঘামানোর তো কথা না! অনিম ভেবে পেল না, চোখের জল? তা-ই বা হবে কেন? সে আলতো করে হাত বুলিয়ে ফোঁটা-টা মুছে দিল। অনিম জানে না ঝুমু জেগে ছিল। তার চোখ থেকে আরেক ফোঁটা জল এসে আগেরটা'র জায়গা দখল করল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।