আত্মমাঝে বিশ্বকায়া, জাগাও তাকে ভালোবেসে
‘আকাশ ও সমুদ্র অপার’ অডিও অ্যালবামের গানগুলো শুনছি। ফাহমিদা নবীর মায়াবী কণ্ঠে সেলিম আল দীনের কালজয়ী শব্দ-বাক্য আর চিত্রকল্প ঘিরে ফেলেছে আমার চারপাশ। মনের ভেতর ভিড় জমাচ্ছে অগণিত সব স্মৃতি, কালের গহ্বরে আজ লুপ্ত অথচ আমার সক্রিয় মস্তিষ্কে কতই না সচল ওই সময়যাপনের চিত্রগুলো।
সেলিম স্যার গাইতে পারতেন না ভালো। এ নিয়ে তাঁর মনোকষ্ট ছিল কিনা ঠিক বোঝা সম্ভবপর হয়নি তাঁর অপার রসবোধের কারণে।
হারমোনিয়াম কিংবা কিবোর্ড বাজিয়ে গাওয়া না বলে গাওয়ার মতো কিছু একটা করার চেষ্টা তিনি প্রায়ই করতেন। তাতে গায়ন সৌন্দর্য না থাকলেও সুরের আভাস ঠিকই টের পাওয়া যেত, কিন্তু ততোটা নয়, যে মাত্রায় পৌঁছলে নিভৃত কোণে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে। স্যারের গায়নকণ্ঠ আমাদের চৈতন্যে ছাপ ফেলেনি এ কথা আজো সমান সত্য।
সেলিম স্যার ‘কহন কথা’ নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গানের একটি দল গঠন করেছিলেন। দলটি নিয়মিত কোনো অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও স্যারের লেখা ও সুরে অনিয়মিত গানের চর্চা চালাতো।
তবে প্রতিবছর ‘মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব’ এ দলটির গান পরিবেশন ছিল বাধ্যতামূলক। এক উৎসবে প্রথম যেদিন অনুজা চন্দের কণ্ঠে স্যারের কথা ও সুরে একটি গান শুনি সেদিন শরীরের কোথায় যেন ক্ষরণ টের পেয়েছি। অনুজা গাইছিল-
রাতের চাঁদের আলো
নিরেট চিবুকে তোমার
দোলাচল দোলাচল
খেলা করে যায়।
জাহাঙ্গীরনগরের সেই নিটোল প্রকৃতির অপ্রাকৃতি রাতের আঁধার চিঁড়ে আজও সেই গান আমার মনোভূমে এক ঝলক বাতাস হয়ে ঝাপটা মারে কখনো কখনো। আজ ফাহমিদার কণ্ঠে স্যারের সেই বাণী ও সুর যখন ধ্রুপদী স্তরের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন আমার কেবলি স্যারের গান গাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার কথাই মনে পড়ে বার বার।
সেলিম স্যার চলে গেছেন আজ তিনবছর পূর্ণ হলো। আমাদের মানসজুড়ে এখনো সদাজাগ্রত স্যারের অমোচনীয় সচল অবয়ব। সবকিছুই তো ঠিক আছে। শুধু কথা বলার কিংবা একটু সঙ্গে তীব্র ইচ্ছেটুকু পুরো হয় না এখন আর। অথচ স্যারের সঙ্গে হাঁটা অথবা কথা বলার হাত থেকে বাঁচতে কতই না পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি।
জীবনের যে সময়টুকু যায় তাতো একেবারেই যায়। ফেলে আসার পর পেছনে ফিরে তখন হু হু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই থাকে কি? যাওয়া কি যায় কোনোকালে অতীতের কোনো সময়খণ্ডে! শিমূল ইউসুফের সুরে সেলিম স্যারের একটি গান শুনে মনের ভেতর গুমড়ে উঠেছি। শিমূল ইউসুফ গাইছেন-
ফেলে এলাম ফেলে এলাম
সাদা মেঘে জল কল্লোল শংখ বাতাস
[...]
তোমার মুখ বিচিত্র রং
ছায়াসন্ধি সন্ধ্যাতারা।
একই গান স্যারের সুরে গাইলেন ফাহমিদা নবী। একই বাণী দুই সুরে, অথচ কী আশ্চর্য, যেনবা একই আবেদন নিয়ে মাতিয়ে তুলেছে এই আমাকে।
একটি বিষয় প্রায়ই মনে হয় আমার। কেউ কেউ তাতে অন্যমত পোষণ করতে পারেন। কেন যেন মনে হয়, শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে কোনো শিল্পী যদি শিখরস্পর্শী হন তবে অপরাপর শিল্পেও তিনি সহজাত সামর্থ্যবান হয়ে ওঠেন। অন্তত আমার তাই মনে হয়। সেলিম স্যারের কর্মকাণ্ড দেখে এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে।
পাশেই শিমূল ইউসুফের মতো সঙ্গীতে পারদর্শী একজন সহকর্মী কাছের মানুষ থাকার পরও তিনি নিজেই বাণীতে সুরের প্রলেপ লাগালেন, ফাহমিদার কণ্ঠে গানগুলো শুনে এখন মানতেই হবে তিনি সফলও হয়েছেন।
দেহগতভাবে কম সময়ই ছিলেন সেলিম আল দীন। তাই গান নিয়ে আর কী কী করা তারপক্ষে সম্ভবপর হতো তা চিরকালের জন্যই হারিয়ে গেছে। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা তিনি দেখিয়েছেন তাতে বাঙালি জাতি বঞ্চিত হয়েছে ভাবা অসঙ্গত নয়।
তারপরও আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে।
আমাদের ভেতর থেকেই তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্নের চেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে। একটি রিলে রেসের মধ্যে আমরা সবাই। স্যার তাঁর দৌড় সম্পন্ন করেছেন। ব্যাটনটি দিয়ে গেছেন আমাদের। আমরা হয়তো অন্যদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাবো।
এরই নাম পরম্পরা। এটাই রীতি। সেলিম আল দীন তাঁর এক গানে বলেছেন-
আকাশ ও সমুদ্র অপার
তারও অধিক জীবনে জীন
এই শূন্যতার শেষ নেই শেষ নেই তার
কত জন্ম কত মৃত্যু পারায়ে পারায়ে যায়
শেষ নেই শেষ নেই।
মৃত্যুর সিথানে সিথান
কবরের পাশে কবর
আকাশ রাত্রি ছোঁবে, দিন ছোঁবে সাঁঝ
শূন্যতার আবর্তন শেষ নেই,
শেষ নেই তার।
জীবন যেমন আছে, মৃত্যুও।
কিন্তু শোককে পুষে রেখে পিছিয়ে গেলে তাতে সভ্যতার ক্ষতি। বরং শোক পেরিয়ে যাবো আমরা সবল পায়ে, কেননা তখনই কেবল সম্ভব স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের তৃতীয় প্রয়াণ বার্ষিকীতে (১৪ জানুয়ারি, ২০১১) এমন বোধই জাগ্রত হোক সবার ভেতর।
১৫ জানুয়রি, ২০১১।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।