আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রদ্ধাঞ্জলি: নাট্যাচার্য ডঃ সেলিম আল দীন

জীবিত মানুষেরা মরে যায় অথচ জেগে উঠে মৃত মানুষেরা

[জানুয়ারী আমার জন্মমাস। এবার এ মাসেই আমার প্রিয় বাংলাদেশের সাহিত্যে ও শিল্পের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রয়াণ ঘটেছে, যারা আমাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে, কোন না কোনভাবে প্রভাবিত করেছেন। আজ তাদের একজন শ্রদ্ধেয় সেলিম আল দীনের তিরোধান, যার হয়েছিল অসুস্থতায় স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু বাকি দু'জনের মৃত্যুই ছিল অস্বাভাবিক - একজন প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, অন্যজনকে হত্যা করা হয়েছে। তারা হলেন, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ, চলচ্চিত্র শিক্ষক আলমগীর কবির এবং চলচ্চিত্রকর, সাহিত্যিক, সেলুলয়েডের মুক্তিযোদ্ধা, নবধারার সাহিত্য শিল্পী জহির রায়হান।

আজ সেলিম আল দীনের প্রতিই আমি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি, তার এক উচ্চাঙ্গের সৃষ্টি উপাখ্যান প্রাচ্য-র নির্মাণ বা সৃষ্টির কলা-কৌশলকে আমার জ্ঞান এবং ভাবনার দৃষ্টিতে তুলে ধরে। কেননা, তার এই উপাখ্যান রচনার সাথে রয়েছে তার সাথে আমার কিছু খুব অন্তরঙ্গ স্মৃতি। ] সেলিম আল দীনের ‘প্রাচ্য’ এক ক্লাসিক্যাল উপাখ্যান রবীন্দ্র উত্তর বাংলা নাটকে যিনি এক নব দিকপাল রুপে স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্দ্র্যে আবির্ভূত হন, তিনি নাট্যাচার্য ডঃ সেলিম আল দীন। তিনিই প্রথম মধ্যযুগের বাংলা নাট্য রীতিকে আধুনিক স্তরে অবতীর্ণ করেন এবং সদর্পে আমাদের নিজস্ব নাট্যরীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাশ্চাত্যের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বেড়াজাল থেকে আমাদের নাটককে মুক্ত করে আমাদের নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হন।

‘প্রাচ্য’ সে ধারারই এক অসাধারণ সৃষ্টি। প্রাচ্য বইয়ের ঠিক প্রথম থেকেই তিনি তার ছাপ রেখে গেছেন। তাইতো দেখি ‘ভূমিকা’ না লিখে তিনি লিখেছেন, ‘কথাপুচ্ছ’। রচয়িতা এই কথাপুচ্ছে, ‘প্রাচ্য’ ও তার পূর্ব রচনা ‘বনপাংশুল’ কে উপাখ্যান বলে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, ‘দুটি রচনাতেই আমি পাঁচালির মহাকাব্যিক আঙ্গিকের শক্তিকে একালের পাশ্চাত্য নিবিষ্ট শিল্পরীতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছি,…..’ এবং মঙ্গল পাঁচালির কাঠামোতে দেশজ রুচির অনুকূলে ‘কাঠামোগত-মহাকাব্য’ বা ‘স্ট্রাকচারাল-এপিক’-এর আদলে ‘প্রাচ্য’ নির্মাণ করেছেন। আর তাই এই উপাখ্যানের শুরু থেকেই আমরা তার বক্তব্যের সমর্থন খুঁজে পাই।

রচয়িতা উপাখ্যান রচনা করতে যেয়ে পাশ্চাত্য ধারার নাটকের মত ‘অংক’, ‘দৃশ্য’ এসব কে না এনে আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থেকে উপাখ্যান রচনার এক আধুনিক নিজস্ব রীতি তৈরি করেছেন। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যের একটি বিশেষ গুণ হলো এর বর্ণনা রীতি। এই উপাখ্যানে লেখক সেই বর্ণনা রীতিকে ব্যবহার করেছেন প্রধানতঃ গদ্যভাষা নির্মাণে। প্রতিটি গদ্যভাষারই প্রধান শিরোনামকে ‘কথা’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সাথেও থেকেছে ‘বোলাম’, ‘পুন বোলাম’, ‘পুন কথা’, ‘তত কথা’, ‘তত বোলাম ও কথা’, ‘কথা ও বোলাম’, ‘কথা বোলাম’ এ সকল শিরোনামগুলোও পুরো উপাখ্যান জুড়ে।

সে সাথে গদ্যভাষার ফাঁকে ফাঁকে যোগ করেছেন প্রচুর পদ্য ভাষা এবং এদের প্রধান শিরোনাম হয়ে এসেছে ‘পদ’। পদের সাথে আছে ‘শিকলি’, ‘নাচাড়ি’, ‘দিশা’। মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে নায়ক-নায়িকার জীবনের ঘটনা বর্ণনার মূলে ছিল দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা। যেমন, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী-র ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যে কালকেতু্-ফুল্লরার জীবনের ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য ছিল দেবী চন্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণনা। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর-এর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে দেবী অন্নদার মাহাত্ম্য বর্ণনায় এসেছে বিদ্যা ও সুন্দর-এর(নায়ক-নায়িকার নাম যদি ভুল বলে না থাকি।

অনেক আগে পড়া, হাতের কাছে বই নেই। কেউ কি এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন?) কাহিনী। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে দেবী মনসার বন্দনায় এসেছে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী। আর ‘প্রাচ্য’ হলো এক ভাগ্য বিড়ম্বিত প্রায় ভূমিহীন কৃষক, সয়ফরচানের নিয়তি নির্ধারিত জীবনালেখ্যকে অস্বীকার করার এক দুর্দমনীয় প্রয়াস। মনসামঙ্গলের কাহিনীর আড়ালে রচয়িতা এখানে যেন লখিন্দরের উপাখ্যান রচনা করেছেন।

কেননা এখানে সাপ কেটেছে বাসর রাতে মনসাকে অর্থাৎ সয়ফরের সদ্য পরিনীতা নোলককে। লেখক মনসা পুরাণের উল্টা দিকটা দেখতে চেয়েছিলেন বলেই বাসর রাতে নোলককে সাপ কাটার পর বর্ণনায় বলেন, “কুমারীগণ এক বিপরীত পুরাণ দেখে। বিশেষত সয়ফরের চাচাত বইন রত্না রুমা। – তাইলে বাসরে লখিন্দাররে ডংশায় না বেইল্যাও যায়। ।

” সেই সাথে এ উপখ্যানে লক্ষ্য করার বিষয়, রচয়িতা এখানে পাশ্চাত্য প্রভাবিত যতিচিহ্ন ব্যবহারের পরিবর্তে আমাদের পাঁচালি প্রভাবিত যতিচিহ্নই ব্যবহার করেছেন। মঙ্গল কাব্যের রীতি অনুযায়ী, রচয়িতা দেশজ বা গ্রামীণ রুচির প্রতি অনুরুক্ত থাকতে চেয়েছেন বলেই উপখ্যানের প্রথম থেকেই পু্ঙ্খানুপু্ঙ্খ বর্ণনার পাশাপাশি নিয়ে এসেছেন প্রচুর রঙ্গরস। যেমন, কনের বাড়িতে বর হিসেবে সয়ফরের ভোজ্যপাত্রে মুসাল্লামের আস্ত মুরগির ভেতরে ছিল হাঁসের ডিম। সেখানে কবি বলেন: শিকলি সদ্য ছোট শ্যালক পুরানা মলিন প্যান্ট শার্ট পরে। সদ্য দুলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে নির্বিঘ্নে বসে পড়ে।

। সে বলে মিয়া ভাই মুরগিটা ভাঙেন। ডিম আগে না মুরগি আগে সে কথাটা বুঝবার পারবেন। । আরো আছে কামরসের গ্রামীণ রসালো পদ, সংলাপ ও বর্ণনা।

আমাদের হাজার বছরের গ্রামীণ পদ, পাঁচালী ও পুঁথি সাহিত্যের প্রভাবে উপাখ্যানের বিষয়ানুযায়ী তিনি পুরো পদ, শিকলি ও নাচাড়িগুলো সৃষ্টি করেছেন যা এ উপাখ্যানের আবহ নির্মাণে যথোপযুক্ত হয়েছে। তাছাড়া পালকি নৃত্যক চরিত্র নির্মাণ রঙ্গরসের ধারাকে আরো উছলিত করেছে এবং এক অপরিহার্য অলংকার হিসাবে এ উপাখ্যানের পরিবেশে দাঁড়িয়ে গেছে। এই উপাখ্যানের বিকাশ পর্যায়ে, বিয়ের পর পালকিতে করে নোলককে নিয়ে যাত্রা আমার কাছে ভীষন অর্থপূর্ণ মনে হয়েছে এ উপাখ্যানের পরিণতিতে। সয়ফর গুটিকয় বরযাত্রী সহকারে নোলককে নিয়ে তার নিজ বাড়ীতে ফিরছে। এমন এক সময় বৃদ্ধ “সোমেজ বলে – বিবাহ যাত্রা আর শ্যাষ যাত্রায় আকাশ পাতাল মিল।

- আকাশ-পাতাল মিল হয় নাকি। – সাইদল বলে। - এমনে হয় না ভাবো অন্তরে নয়ন মেইলা। হয়নি না হয় দেহ। ।

” এই উপাখ্যানের পদে পদে রয়েছে এ ধরণের তীব্র সাহিত্যগুণ সম্পন্ন সংলাপ, পদ্য এবং বর্ণনা। বর্ণনায় কী যে অসাধারণ দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয়েছে চাঁদ বণিকের ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বরের সাথে সঙ্গতি রেখে যেদিন মনসার ভাসান যাত্রায় সয়ফর প্রথম দেখে নোলককে। এরপর ভাসান যাত্রার প্যান্ডেলের আঁধারিতে নোলককে ছায়া ছায়া লাগলেও ‘নোলক’ “নাম শুনেই সয়ফরের বুক কেমন করে। ভাসান যাত্রার সকল সুর সকল বেদনা লখিন্দরের পুনরুজ্জীবন সব ওই মুখের চারপাশে ভিড় করে। সহসা হালকা মিহি সুতলি বৃষ্টি নামে।

তারই মধ্যে চলে মানতের ভাসান যাত্রা। । ” কী চমৎকার বর্ণনা! পদ সয়ফরচান। নাম রেখেছিল তার দাদী। বলেছিল নামের পুরা কিসসাটা ওকে।

। ছোটবেলা শীত সকালে চালভাজা নারিকেল খেতে খেতে চাদরের ওমে বলত দাদী তার তরে বিয়া করামু একখানা সোবুজ নিশাপরী। । সম্ভবতঃ সয়ফরচান ও সোবুজ নিশাপরী আমাদের কোন পুঁথি সাহিত্যের রোমান্টিক চরিত্র। যেমন গ্রামীণ মানুষের মনঃজগতে এদের প্রতি আবেগ, তেমনি সয়ফরের নিদারুন প্রচন্ড আবেগ তার সোবুজ নিশাপরী নোলকের প্রতি।

ঘরের ভিটেয় ইঁদুরে নির্মাণ করে গর্ত, সুড়ঙ্গ, যাতে বসবাস করে বাস্তু সাপ। গ্বহস্তের মঙ্গল সাধনে বাস্তুসাপের ক্ষতি করতে নেই। সেই সাপের দংশনে মারা যায় নোলক। অথচ তাকে বহন করা পালকি এবং বাসর ঘরের পালঙ্কে আঁকা অকল্যাণ ও অপঘাতরোধকারী দেবী মনসা বা বাসুকির চিত্র। কী নিদারুন বৈপরীত্য! নোলকের মৃত্যু ও দাফনের পর তীব্র শোকাহত, উন্মাদ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সয়ফর তার পরম প্রিয় নোলকের ঘাতক সাপটাকে খুঁজে ফিরে ইঁদুরের করা গর্তে, সুড়ঙ্গে।

দাদী এ ভয়ংকর পরিস্থিতি মেনে নিতে পারে না তার একমাত্র বেঁচে থাকা বংশধরের। “দাদী এসে বলে। – ও সয়ফর। ও নাতী। নোলক গেছে আল্লায় নিয়ে।

তুই বাঁইচা থাক না। । - আমাগো আবার বাঁচন কিয়ের রে দাদী। আমাগো বাঁচন কালনাগিনের ডংশন। শ্যাষ জমি বন্দক দিয়া যে বিয়া করে তা কিনে আইজল মিয়া।

শ্যাষ জমি বন্ধক দিয়া যে বউ ঘরে আনে তারে মারে সাপে। যে সুড়ঙ্গ খুঁড়ি এই ইন্দুরের নাগাল তাতে হাপ ঢুইকা পড়ে। এইভাবে ছুবল মারে। । ” আঙ্গিকে এবং বিষয়ে আধুনিক পালাকার সেলিম আল দীন যে নব্য লখিন্দর পালা সৃষ্টি করেছেন, তার অন্তর্নিহিত কথা এখানে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে।

আসলেই কি আমাদের ভূমিহীন, সহায় সম্পদহীন প্রান্তিক কৃষকেরা বেঁচে আছেন? বাস্তুসাপ রুপি ভিটেতে বসবাস না করেও জিতু মাতব্বর ও তার ছেলে আইজল মিয়ার মত বংশ পরম্পরায় জমি বন্ধক নিয়ে সুযোগ বুঝে বিষাক্ত ছোবলে কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ প্রিয় সম্বলকে। কেড়ে নিচ্ছে সুন্দর ও স্বপ্নকে নিয়ে দাঁড়াবার নির্ভরতা, যেমনি চেয়েছিল সয়ফর নোলককে পেলে তার অবস্থা পাল্টিয়ে ফেলার সুখের ভিত রচনা করার। জিতু মাতব্বরকে গ্রামের লোক জানে পরোপকারী হিসেবে এবং বাস্তুসাপের প্রতিও প্রচলিত বিশ্বাস যে, এরা গৃহস্থের মঙ্গল ডেকে আনে। পালাকার তার পালায় যেভাবে সূক্ষাতিসূক্ষভাবে বাস্তুসাপ এবং ভূ-স্বামীকে সমান্তরালে উপস্থাপন করেছেন, তা উঁচুমাপের এক সাহিত্যিকের জীবনের প্রতি এক গভীর মূল্যায়নকেই তুলে ধরে। এই উপাখ্যানে অস্তিত্ববাদী দর্শন এসেছে তখনই যখন মহাজন জিতু মাষ্টার সয়ফরের দশ ডিসিম জমি নিয়ে নিয়েছে সয়ফরের কাছে থেকে পাওনা সুদ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে।

মৃত্যু শয্যায় সয়ফরকে “জিতু মাতব্বর ক্ষীণ কন্ঠে বলে। – বেবাক মাতব্বর যা করে আমিও তাই করছি। জমি থাকলেই কেনা বেচা থাকে সয়ফর। আমি যাইতেছি। – যে দশ ডিসিম জায়গা গাইগরু এই বছর কাইড়া নিছিলাম বেবাক ফিরত দিলাম।

আমার পোলা আইজল থাকল। তুইত বছর ঘুরে আবার জমি বেচবি তয় ঐ দশ ডিসিম তুই আইজলের কাছেই বেচিস। মাফ করলি ত বাবা। । ” আর তাই নোলককে পালকিতে নিয়ে ফেরা পথে সয়ফর “দূরে বাঁশ ঝাড়ের ছিটালোকে সেই মৃত জিতু মাতব্বর”-কে দেখে।

তার ভীতস্প্রদ প্রশ্ন: পদ সেই মৃত এদিকে আসছে কেন। । বিবাহের যাত্রা পথে কবরের গহবর ছিঁড়ে মহাজন কিভাবে বেরিয়ে আসে। কিন্তু কেন। ।

এভাবে এই উপাখ্যানে রচয়িতাকে অতি প্রাকৃত বা পরাবাস্তববাদী হয়ে যেতে দেখি। আরো দেখি যখন সয়ফর প্রথম আবিষ্কার করে তার বাবার কবরে দেয়া বাঁশ থেকে কবর ফুঁড়ে বাঁশ গাছ জন্মায়। এ যেন মৃত পুরীর কোন রহস্য, জীবনের চিহ্ন। তাই পালাকারের মধ্য আশাবাদ দেখা দেয়, জেগে উঠত যদি ভূমিভেদী মৃতলোক থেকে পুণর্বার জীবন্ত মানুষ। ।

এখানে সাহিত্য সাবলাইম (sublime) স্তরে পৌঁছে যায়। এই ধরনের আরো অনেক উচ্চমার্গীয় পদ রয়েছে এ উপাখ্যানে। যেমন, মৃত নোলকের দাফনের আগে গোসলের সময় তার শরীর থেকে অলংকার খুলে নেয়া হচ্ছে: কৌটা ও কবর সম দৃশ্যমান একটিতে নোলকের বিবাহের হার নানা অলঙ্কার অন্যটিতে নোলক যাবে ঢুকে। । এরকম গল্পের পরতে পরতে রয়েছে বিস্ময় এবং জীবন বিশ্লেষণী গভীর জিজ্ঞাসা।

আমাদের মঙ্গলকাব্যের যে বর্ণনাধর্মীতা আছে, তা সাহিত্যিককে নাট্যে উপন্যাসের ভাষা নির্মাণে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করেছে। আর তার মিশেল তিনি ঘটিয়েছেন এ উপখ্যানে। ঘরের ভিটে থেকে চতুর্দিকে বিস্তৃত সুড়ঙ্গ খননে সয়ফর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। দূর সম্পর্কের বোন রুপালি পেতলের গ্লাসে পানি নিয়ে আসে। ” – দাদা আর কিছু না খাও আল্লার দোহাই নাগে এট্টু পানি দাও মুখে।

। সয়ফর ঘামে বেদনায় শ্রান্তিতে মাটি মাখা হাত বাড়ায়। তার হাতে গ্লাসটি থির থির করে কাঁপে। হাতের কাঁপনে গ্লাসের পানিতেও কাঁপন লাগে। তখন তার মধ্যে দর্পণিত চাঁদও কাঁপে।

সহসা তার মনে মৃত অর্ধস্ফুট নোলকের কথা। স্মরণ করে বেদনায় মুহ্যমান ইমাম হোসেনও পানি খান নাই। কারবালার ফোরাত নদীতে নেমে। তার মনে হয় এই চাঁদের প্রতিবিম্বে গ্লাসের ভিতর নোলকের মুখ উঁকি দেয়। সে মুখে রক্ত ও ফেনার বুদ্বুদ পর্যন্ত দেখা যায়।

হঠাৎ গ্লাসটি শূন্যে বহুদূরে ছুঁড়ে দিয়ে সয়ফর হু হু করে কাঁদে। ” এই ধরনের বর্ণনায় উপাখ্যানটিকে বিশ্ব সাহিত্যের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। লেখক যে শুধু মধ্যযুগে পড়ে থাকেন নি তার আরও প্রমাণ পাই নোলকের রুপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায়: শিকলি নোলক কিশোরী। চওড়া কপালি। দীঘল চুল শাঁওলি ফুল।

হলুদ মাখা শ্যামল ত্বক শোভন রুপ। থুতুনি কাটা। দু’চোখ দীঘল। পাতলা ঠোঁট। নাকে নাকফুল।

পক্ষনীলিম। হালকা পাতলা কিন্তু কোমল। । উপাখ্যানের সমাপ্তিতেও রয়েছে সয়ফরের দাদীর নিয়ন্ত্রণ। ভোরবেলায় যখন সয়ফর সাপটিকে খুঁজে পায়, তখন রচয়িতা তার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা তুলনারহিত।

সর্পের রুপে সয়ফরের মাঝে তৈরি হয় একধরনের দোদুল্যমানতা। কিন্তু ফনা তোলা সাপকে যখন সে ছেনি দ্বারা আঘাত করতে এগিয়ে যায়, তখন দাদী বাস্তুসাপ নিধনের প্রচলিত বিশ্বাসে সয়ফরকে বাধা দেয়। সাপটাও ধীরে ধীরে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। নাটকের সমাপ্তি সম্পর্কে নাট্যকার নাটকের শুরুতে ‘কথাপুচ্ছ’-এ যা বলেছেন, এখানে তাই তুলে ধরলাম: “আমার মনে হয়েছে, জীবনের তীব্রমুহূর্তে আমাদের ক্রোধ, প্রতিহিংসা শেষ অবধি প্রকৃতি সংলগ্ন হয়ে যায়। আবার ‘প্রাচ্য’কে খুব কেউ সরলভাবে চরম ভাঙনের মুখে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের কাহিনী রুপেও গণ্য করতে পারেন।

… ডঙ্ককারী সাপটিকে যে ক্ষমা করা হয়েছে এ উপাখ্যানের অন্তে, কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। সে প্রকৃতির সৌন্দর্য, হিংস্রতা ও স্বাভাবিকতার অধিকারে আপন বিবরে চলে যায়। ” এই উপাখ্যানে রয়েছে কাব্যময়তা, উপন্যাসধর্মীতা, নাটকীয়তা এবং সর্বোপরি আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য ঐতিহ্য, যেন আধুনিক যুগে আমাদের সাহিত্যের এক নবরুপ এবং নিদর্শন। আমি আধুনিক এই পালাকারকে একজন বিদ্রোহী সাহিত্যিক বলতে চাই। যখন আমাদের সাহিত্যচর্চা এবং মন-মানসিকতা, আচরণও পাশ্চাত্যমুখীন, তখন তিনি আমাদের প্রাচ্যের দিকে চোখ ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

আমাদের পরিচয়কে তুলে নিয়ে আসছেন। আমাদের শেকড়ের সাথে সম্পৃক্ত করছেন। ‘প্রাচ্য’র অসাধারণত্ব এখানেই। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০০০ প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনী ১৩২ আজিজ সুপার মার্কেট (২য় তলা) শাহবাগ, ঢাকা মূল্য: ৭০ টাকা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।