মুন রিভার ...
কবির তখন সওদাগরী মন...
মাস ছয়েক আগে শীর্ষস্থানীয় এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দিলাম দুরু দুরু বক্ষে। আমার গন্ডি খুব ছোট। সবুজ, আকাশ, বৃষ্টি , লিরিক আর আমি। এর বাইরে গত প্রায় বছর দুয়েক আক্ষরিক অর্থেই আমার কেউ ছিলো না। একটা লম্বা সময় বোহেমিয়ান এদেশ- ওদেশ কাটিয়ে শুধুমাত্র গান লিখার তাগিদে দেশে ফিরে এসে প্রথমবারের মত আমি খানিক দ্বিধাগ্রস্থও বটে।
মনের ভিতর খাস বাংলায় প্রশ্ন করি নিজেকে, ' কিরে ব্যাটা, ক্যামনে কি! '
মাথার ভেতর শব্দ নিয়ে ঘোরা মানুষ আমি, হঠাৎ ঝা চকচকে অফিসে কাজ শুরু করে ভ্যাবদা মেরে যাই খানিক। প্রথম দিন ডেস্কে বসে লিখে ফিলি, ' কবির তখন সওদাগরী মন, হিসেব অংকে বিকেল আততায়ী...'
লিরিকেই থেকে যাই নিজের অজান্তেই।
মজার ব্যাপার হলো,কিছুদিন যেতেই আমার ভালো লাগতে শুরু করে বিজ্ঞাপন লেখার কাজ । সবচেয়ে যে জিনিসষটা আমাকে সুখানুভুতি এনে দিলো- আমি একদম নির্ভার হয়ে লিরিকে মন দিতে পারলাম। লিরিক লিখে রেমুনারেশন এর জন্য চাতক পাখি হয়ে থাকতে হলো না আর!
শুধু ইনসমনিয়া টা কিভাবে কিভাবে যেনো চলে গ্যালো আমার!
আহারে, প্রিয় বন্ধু রাতগুলো...
বিজ্ঞাপন, জিংগেল, ক্লিওপেট্রা আর...
একটু একটু করে ঢুকে যাই বিজ্ঞাপন জগতে।
অফিসের সবাই খুব ভালো...বন্ধুতা গড়ে ওঠে অনেকের সাথে। পুরোনো বন্ধুরা মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয়, ' দোস্ত, ঘুম থেকে উঠতেসিস তো ঠিকমতো?' , ' কস কি ব্যটা! তুই চাকরিতে ঢুকসোস ' , ' রানা, টাইমটা মেইনটেইন কর ' ...এ রকম অনেক কথার আন্তরিকতায় এক এক দিন গড়ায়। আমি আমিই থাকি, বদলাইনা। জিঙ্গেল লিখি, বিজ্ঞাপনের কপি লিখি। ভালো লেগে যায়....
আমি খেলাপাগল ছেলে।
অফিসের ভিতর টিটি বোর্ড দেখে দারুন মজা পেয়ে যাই। কাজ না থাকলেই আমি টিটি বোর্ডে। খেলা, লেখালেখি, ছাদে সিগার ব্রেক আর অফিস থেকে বের হয়েই শব্দ খোঁজার সেই পুরোনো অভ্যাস- জীবন সুন্দর হয়েই ধরা দেয় আমার কাছে। একদিন দেখা হয়ে যায় ক্লিওপেট্রা-র সাথেও। লিখে ফিলি, ' তোমার জন্য নেফারতিতি'...
গত সপ্তাহের অলস এক দুপুরে...
বসে আছি।
মারুফ ভাই এর ডাক- ' রানা, এই কামটা কইরা দে ভাই। ' কাগজ হাতে নিয়ে দেখি হিন্দি তে কি কি যে হিজিবিজি লিখা। আমি মনে মনে বলি ' হোলি কাউ। ' জানতে পারলাম এটা হলো আই সি সি-র বিশ্বকাপ থিম সং এর হিন্দি ভার্শন। সাথে খুব অদ্ভুত শব্দচয়নে বাংলা ট্রান্সলেশন-ও করা।
মারুফ ভাই এর কথা অনুযায়ী আমাকে এই বাংলাটা কারেকশন করতে হবে। ট্র্যাক- টা মুম্বাই এর শঙ্কর-এহসান-লয় এর করা। আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। খেলা বিষয়ক যে কোনো ব্যাপারে আমার আগ্রহ সীমাহীন। তো শুনলাম, ভালোই লাগলো।
কিন্তু বাংলাটা দেখে আমি আবারও মনে মনে বলি,' হোলি কাউ। ' কয়েক লাইন তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিছু ভার্স ছিলো এ রকম-
ডুব সাতারে পেড়িয়ে সাগর, দুনিয়াকে লেটস শো আওয়ার ড্রিম
হাল্লা গুল্লার খুশীর বৃষ্টি, ভাসিয়ে দেবে ঝম ঝমা ঝম
চল খেলোয়ার, ওয় রে ওয় রে...
আমার হাত মাথায় !
মন খারাপের একটা দিন...
প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরি। আমাদের দেশে হবে বিশ্বকাপ, তার থিম সং করছে ইন্ডিয়া, আচ্ছা মানলাম এই থিম সং তিন ভাষায় হবে কিন্তু তাই বলে এর বাংলাটাও ওরা করবে, আর এই হবে তার বাংলা ! পরদিন অফিসে ফিরে মারুফ ভাইকে বিনয়ের সাথে জানাই যে এটা আমার পক্ষে সম্ভব না কিছুতেই। আমি করতে পারবো না।
মারুফ ভাই বুঝতে পারে আমার মনের অবস্থা। খানিক জোরাজুরি করে ফিরে যায় ডেস্কে। আমি চুপচাপ বসে মিনিট পাঁচেক ভাবি। উঠে দাড়াই। মারুফ ভাই এর ডেস্কে যেয়ে বলি, ' আমি একটা কাজ করতে পারি।
আমি একদম আমার মত করে এই ট্র্যাক এর উপর নতুন একটা গান লিখে দিবো। কিন্তু কারেকশন! কিছুতেই না...' মারুফ ভাই খানিক দ্বিধাগ্রস্থ। আমাকে নিয়ে যায় শাওন ভাই এর কাছে। শাওন ভাই যেহেতু বস, সেহেতু উনার ডিসিশন ফাইনাল। ' ধুরো, এইটা কিছু হইলো ওয় রে ওয় রে...তুই তোর মতো লেখ।
' মনে মনে বলি,' আপনে সোনার বস! সাব্বাস বাঘের বাচ্চা!'
এক মুহুর্ত-ও নষ্ট না করে ফিরে আসি ডেস্কে। একটানে লিখে ফেলি ' জিতবে এবার জিতবে ক্রিকেট'। কি যে আনন্দ নিয়ে গানটা আমি লিখেছি, এটা আসলে লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব না।
তারপর....
গান লেখা শেষ হলে যা হয় আর কি। লেখা আমাকে ছেড়ে চলে যায়... আমিও ডুব দেই বিজ্ঞাপনের ভাষায়।
ভাবনায় আকুপাকু শুরু হয় বৃষ্টি নিয়ে একটা লিরিক লিখবো বাপ্পা ভাই এর জন্য।
দুই-তিন পর ফোন। শাওন ভাই এর।
' তোর মোবাইলে ফোন আসবে মুম্বাই থেকে। রাঘব স্টুডিও থেকে তোর সাথে কথা বলবে।
'
আমি সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম পুরো ব্যাপারটা।
কথা হয়ে রাঘব এর সাথে। ও জানতে চায়' মার ঘুড়িয়ে ' কথাটা বলতে পারবে কিনা গানে। আমি সানন্দে সম্মতি দেই।
সেদিন বিকেলে অপার্থিব আনন্দে পাখি হয়ে যাই।
অফিসের কলিগদের আন্তরিক অভিনন্দনে খুব ভালো লাগে আমার।
মনে মনে ভাবি, এটা আমাদের সবার বিজয়। আমাদের ভাষায় আমাদের গান...
গান চলে আসে ২-৩ দিন পরেই। শুনি। আমার ভালো লাগে।
সবার প্রথমে জানাই বাপ্পা ভাই কে। ধীরে ধীরে বন্ধু, কাছের মানুষ ইনসমনিয়াক ফেলাদের। গানটা ভালো লাগতে শুরু করে সবার।
আসুন, গানটা শুনি, মিনিট চারেক ফুর্তির আমেজে থাকি আর প্রার্থনা করি, গো টাইগার্স গো...
জিতবে এবার জিতবে ক্রিকেট
লিরিক- রানা
ভয়েস- রাঘব
কম্পোজিশন- শঙ্কর-এহসান-লয়
জিতবে এবার জিতবে ক্রিকেট
জিতবে এবার জিতবে ক্রিকেট
আরো জোরে সবার আগে
চতুর্পাশে ক্রিকেট তাপে
চার ছক্কা মাঠ পেরিয়ে
খেলছে দ্যাখো দামাল ছেলে...
পেরিয়ে বাঁধা, ঘূর্ণি ধাঁধাঁ, কিংবা গতির তুমুল কোনো ঝড়
বাতাস কেটে, তুমুল বেগে, হাজার উল্লাসে জয়ের নিশান গড়। ।
আকাশে আজ তোরই কথা
নীল মেঘ চাই তোর বন্ধুতা
রোদ্দুর তোর সাহস ঘামে
জড়িয়ে দেখ বিজয় আনে...
তোকে দেখে তরুণ যুবা, হাজার অযুত দৃপ্ত শপথ
তোকে দেখে সবুজ পাতা, বৃষ্টি ভেজা এই যে পথ। ।
গ্যালারী দ্যাখো রুদ্ধশাষে, অপেক্ষা আজ বিজয়ীর
শেষ ওভার, বল আসছে ছুটে, বিজয় ছিনিয়ে আনবে বীর...
উল্লাসে তাই পড়ছে ফেটে, হাজার কোটি ক্রিকেট ফ্যান
ক্রিকেট জ্বরে পুড়ছে বিশ্ব, ক্রিকেট ক্রিকেট গাই জয়গান। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।