আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এখানে ঘুমিয়ে আছে ১/১১:

সবাইকে শুভেচ্ছা...

ছোট্ট একটা জেলা শহরের মাটি এবং মানুষের খুব কাছ হতে দেখার সূযোগ হয়েছিল বাংলাদেশের বিশাল উত্থান এবং এর নীরব পতন। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ছিল অভাব অনটন আর বেচে থাকার কঠিন লড়াই, কিন্তু এত কিছুর মাঝেও ছিল ন্যায় আর সততার প্রতি মানুষের চিরন্তন সন্মান এবং সীমাহীন আনুগত্য। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে দলীয় রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ছিল যে কোন মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু তাই করতে গেলেন এ দেশের স্বপ্নের মানুষ শেখ মুজিব। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তখন ৭১’এর রেশ, অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং যুদ্ধ ফেরৎ যুব সমাজের অপেক্ষার পালা। কিন্তু সে অপেক্ষার প্রত্যাশা পূরনে এগিয়ে আসেনি কেউ, বরং দলীয় শাসন নিশ্চিত করার নেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল এক সময় শতকরা ৯৯ ভাগ বাংলাদেশির দল আওয়ামী লীগ।

অযোগ্যতা আর ব্যর্থতার ঘোড়ায় চড়ে আওয়ামী লিখতে চাইল বাংলাদেশ গড়ার নতুন ইতিহাস। কিন্তু এ ইতিহাস নিয়ে তারা বেশী দূর এগুতে পারেনি। তাদের ব্যর্থতার জরায়ুতে জন্ম নেয় নতুন একদল শিকারির দল, উর্দিপরা সেনাবাহিনী! ছাউনির আড়ালে তারা গন্ধ পেতে শুরু করে ক্ষমতার, আর পাশাপাশি আঁকতে শুরু করে ষড়যন্ত্রের কুৎসিত ছবি। ক্ষমতা দখলের নোংরা লড়াইয়ে জড়িয়ে পরে ছাউনির হাবিলদার হতে জেনারেলের দল। ততদিনে আওয়ামী লীগও তার মৃত্যু পরোয়ানা লিখে ফেলেছে বাকশাল নামের একদলীয় শাসনের মৃত্যু ফাঁদে।

শেখ মুজিব হত্যা এবং তার পরবর্তী ইতিহাস ঘন্টা বাজিয়ে দেয় নতুন জন্ম নেয়া একটা জাতির প্রত্যাশার অকাল মৃত্যুর। জেনারেল জিয়া রাজনীতিকে কলুষিত করে তাতে অস্ত্র, পেশী শক্তি এবং অসততা যোগ করে এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন, যা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্ম-জন্মান্তরের গর্ব সততাকে সমাহিত করে রাজনীতির গন-শৌচাগারে। একটা জাতির মানুষ হিসাবে বেচে থাকার সবটুকু মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়ে জেনারেল জিয়া উন্মোচন করেন নতুন এক বাংলাদেশের, যে দেশের অলি-গলি রাজপথে জন্ম নিতে শুরু করে নতুন এক শ্রেনী, রাজনীতির সুবিধাভোগী বাংলাদেশী। এই সুবিধাভোগীরা নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে জন্ম দিতে শুরু করে ভয়াবহ এক প্রজন্মের; অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, খুনী, ধর্ষক এবং অন্ধ পূজারী। শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি, যার উপর দাড়িয়ে একটা জাতি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, সে ভিত্তিকে গুড়িয়ে দেয় জিয়ার কথিত জাতীয়তাবাদের ডাক।

রাজনীতি রাতারাতি রূপান্তরিত হয় ভাগ্য ফেরানোর মেশিনে; ছাত্র, শিক্ষক, উকিল, বিচারক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সহ সমাজের শিক্ষিত অংশকে চুম্বকের মত টানতে থাকে অসৎ ভাবে বেচে থাকার নতুন পৃথিবীতে। এক কথায় সমগ্র জাতিকে দুনীতির আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে দিয়ে রাজনীতিকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা ছাউনিতে। রুটি হালুয়া আর ক্ষমতার কামড়া কামড়িতে পরাস্ত হয়ে জেনারেল জিয়া বিদায় নেন যে পথে এসেছিলেন ঠিক সে পথে। জিয়া বিদায় নিলেও তার প্রেতাত্মা এরশাদের মাঝে ভর করে ফিরে আসে বাংলাদেশে। বিএনপি আর জাতীয় পার্টির নামে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌছে দেয়া হয় রাজনৈতিক চৌর্যবৃত্তি আর সামাজিক অনাচার।

চৌর্যবৃত্তির ফাঁদে ধরা দিয়ে ভাগ্য ফেরানোর অসৎ প্রতিযোগীতায় যোগ দিতে আওয়ামী লীগকে বেশী কষ্ট করতে হয়নি, কারণ এ পথ ততদিনে নুড়ি-পাথর দিয়ে পাকা পোক্ত করা হয়ে গেছে। চোখের সামনে নষ্ট হতে থাকে দেশের যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, শিক্ষক সমাজ। শিক্ষাঙ্গনে খাতা-কলমকে পিছনে ফেলে সামনে আসে অস্ত্রের ঝনঝনানি, রাজনীতির নামে পেশী প্রদর্শনী ক্যাম্পাসে নতুন মাত্রা যোগ করে ছাত্রদের বর্ণীল জীবনে। অন্যদিকে রাজনীতির নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের অসৎ লড়াই দেশকে ঠেলে দেয় দু দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিধান হতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শব্দটা বিদায় নেয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, পাশাপাশি জন্ম নেয় যেনতেন ভাবে ক্ষমতার সিঁড়ি ডিঙানোর অসুস্থ লড়াই।

দেশ এবং দলের উর্ধ্বে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে নেত্রী পুজার কলঙ্কিত অধ্যায়। ২১ শতাব্দীর শুরুতে যেখানে বিশ্ব রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে করছেন কৌশলগত লড়াই, সেখানে আমাদের রাজনীতিবিদ্‌রা তাদের কর্মীদের হাতে অস্ত্র আর লাঠি দিয়ে মাঠে ঠেলে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে খুন করার জন্যে। দেশ এবং জাতির এই ঘোর অমানিশা এবং অনিশ্চয়তার মাঝে ১/১১’এর উদয় ছিল নতুন এক প্রত্যাশার জন্ম। যারা রাজনীতির অসততায় কলুষিত হয়নি তাদের জন্যে ১/১১ ছিল নতুন এক '৭১। দিনের পর দিন চোখের সামনে পশু রাজত্বের উত্থান এবং তার মহিমা কীর্তন অনেককে দহন করেছে নীরবে নিভৃতে।

তাই অনেকের মত ছোট জেলা শহরের এই ক্ষুদ্র লেখকের কাছেও ১/১১ ছিল প্রত্যাশার নতুন ঢেউ, যার স্রোতে ভাসতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম কিছু কঠিন বাস্তবতা। অন্যায় এবং অসততার শক্ত ভিত্তি এত সহজে গুড়িয়ে দিয়ে ১১ জন উপদেষ্টা দেশকে নিয়ে যাবেন সভ্য পৃথিবীর কাতারে, এমন একটা স্বপ্ন দেখাটাই বোধহয় ছিল ভুল। কিন্তু সে ভূল করাটার ভেতর কোন অন্যায় ছিলনা, ছিলনা কোন গ্লানি। আমরা মানুষ, মানুষ হিসাবে বাঁচতে হলে আমাদের স্বপ্ন দেখতে হয়, হোক সে স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন। ১/১১ অধ্যায়ের শেষ অধ্যায় হয়ত লেখা হয়নি।

রাজনীতির বৈরী প্রতিপক্ষ নিজ নিজ স্বার্থের আলোকে বিচার করছে ১/১১’র উত্থান এবং পতন। কিন্তু আমরা যেদিন রাজনীতিকে পারিবারিক লড়াইয়ের যাঁতাকল হতে মুক্ত করতে পারবো, সেদিন হয়ত ১/১১’এর প্রয়োজনীয়তা, অপরিহার্যতা এবং ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। সে দিন কতদূর তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমরা অপেক্ষায় থাকব নতুন দিনের এবং স্বপ্ন দেখব নতুন প্রত্যাশার। আপাতত ১/১১'র টম্বষ্টোনে লেখা থাক ‘এখানে ঘুমিয়ে আছে ১/১১‘।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.