জন্মের পর চিল্লানী দিয়া জীবন শুরু করছিলো হাসিবের মা । এরপর থেকে তার চিল্লানী চলতেই আছে , কোন থামাথামি নাই । বাচ্চাকালে চিল্লাইছে সইগো লগে "খেলা বুঝস তোরা কিছু..পারস তো খালি হান্ডি পাতিল লইয়া গুতা-গুতি করতে "। বড় হইলো, কিশোরী হইলো- চিল্লানী শুরু হইলো পাড়ার পোলাগো লগে ,"হারামজাদারা তোগো কোন কাম কাজ নাই । খালি মাইয়াগো পিছে ঘুরছ ক্যান ? " অথবা "চোখ পিটপিট করবি না মল্লিক্কার পোলা ।
চোখ গাইল্ল্যা দিমু কইলাম এক্কেবারে "। তরুণী হইলো , মনে কুসুম কুসুম প্রেম আসলো-তয় চিল্লানীর স্বভাব গেল না । তাহার এহেন অত্যাচারের অন্যতম বড় ভিক্টিম কওয়া যায় তার সেই ফুফুর ননদের পোলারে । বেচারা এমনেতেই ছিলো ভালা পোলা,আতেল টাইপ পড়াশুনা করা চশমাওয়ালা সিনেমেটিক কলেজ বয় । শুধু সুন্দরী বইলাই মনে হয় হাসিবের মা,থুক্কু, (তখন তো আর সে হাসিবের মা আছিলো না ,তার একটা সুন্দর/অর্ধসুন্দর কিন্তু কোনভাবেই বিচ্ছিরি নয় ,এমন একটানাম ছিলো) হাসিনার প্রেমে পড়ছিলো ওই বেচারা ।
যাই হোক পোলাটার কপাল অনেক ভালা আছিলো যে কুসুম কুসুম প্রেম ফুল হয়ে ফোটার আগেই হাসিনা বেগম টের পাইয়া গেছিলেন যে এই পোলা একটা হাদারাম ছাড়া আর কিছুই না । সেই যাত্রায় তাহাকে রক্ষা দিয়া পড়াশুনায় মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহনপূর্বক ক্ষান্ত দিয়াছিলেন ।
এরপর জীবনের কাটছে তো কাটে নাই তাতে কি ? বিগত পয়তাল্লিশ বছর ধর তার ফেভারিট কাজই ছিলো চিল্লানো । হোক কামে ,না হইলে আকামে । এমন রেকর্ডও নাকি আছে যে হাসিবের বাপের উপর ক্ষেইপ্যা গিয়া উনি এমন চিল্লানি দিছেন যে ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙ্গে গেছে (অবশ্যই ইহা কাজের লোক কর্তৃক রটিত) ।
তাছাড়া ছোটখাট যেসব লিজেন্ড শোনা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে অফিসের বস যে একমাত্র মানুষটাকে অফিসে ভয় পায় সেই হচ্ছেন মিসেস হাসিনা কবির ।
তো জেনেশুনে এমন মহিলার ছেলের সাথে প্রেম করার জন্য যতটুক সাহস দরকার তা মিনতির আছিলো না কোনদিনই । কিন্তু হাসিবই আছিল নাছোড়বান্দা । যাই হোক প্রেম যখন হয়েই গেছে তখন আর কি করার ! সেই প্রেমের মইধ্যে আবার দীর্ঘ চাইর বছরের বিচ্ছেদ । এতো কিছু পার হইয়া আজকে যখন হাসিব সমাজে এবং পরিবারে প্রতিষ্ঠিত তখন পারিবারিক পরিচালনায় তাদের বিয়ে-পৌনে এক বছরের সংসার সবই ঠিক ঠাক মতো চলতেছিল ।
মাঝখানে ঝামেলা বাধাইলো হাসিনা বেগম এর "গ্রামে ফিরে চলো" কর্মসুচী । স্বামীহীন পুত্র বধুময় সংসারে তার উপার্জন খুব একটা দরকারি আছিলো না কখনোই । সুতড়াং , চুলায় যাক চাকরী-তিনি গ্রামে ফিরে যাবেন ।
গ্রামে গেলেন আর হিসাব চুকে গেল এমন হইলে আর কোন প্রব্লেমই আছিলো না । কিন্তু সেইখানে গিয়া তিনি একটা নতুন সংসার পাতলেন ।
সেইখানেই ক্ষান্ত দিলেন না । তার পুরানা সংসার আর নতুন সংসারের মধ্যে যোগসুত্র স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিলেন । এবং ঠিক এইখানে আইসা তিনি ঝামেলা পাকাইলেন । দুইটা সমান্তরাল জগতের মানুষেরা কেবল নিজেদের দিকে তাকাই তাকাই ক্লান্ত হইতে পারে , কিন্তু কক্ষনোই এক বৃত্তে হাত ধইরা ঘুরতে পারে না । এই সত্য ভুইল্ল্যা গেছিলেন হাসিনা বেগম ।
তাই আইজ মিনতির জীবন এক অর্থহীন বিষাদে লিপ্ত ।
সমস্যার শুরু হাসিনা বেগমের নতুন পক্ষের মেয়ে নাজমারে লইয়া । সে মোটামোটি বিবাহযোগ্যা । গায়ে গতরে মাশাল্লাহ শতে একখান মাইয়া । চেহারাখানও মোটামুটি –গেরামে না জন্মাইয়া হলিউডে জন্মাইলে শিউর সুপার মডেল হইয়া যাইত ।
যাই হোক সেই মাইয়ারে বিয়া দেয়ার জন্য হাসিনা বেগম উইঠা পইড়া লাগলেন । মাইয়ারে জিগানেরও দরকার মনে করলেন না সে কাউরে পছন্দ-টছন্দ করে কি না । সেইটাই অভিশাপ হয়ে দেখা দিলো ।
অজো পাড়াগায়ের একটা মেয়ের মইধ্যেও যে এত্তো বিশাল এক নদী লুকাই থাকতে পারে তা হাসিনা বেগমের পয়তাল্লিশ বছরের পুরানা মস্তিষ্ক কিংবা মিনতির অতি আধুনিক স্বাধীনচেতা নারী সত্ত্বাও কোনদিন আন্দাজ করতে পারে নাই । নিজেদের জীবনে এমন অনেক অনুভূতিকে বিনা দ্বিধায় তারা রাস্তা-ঘাটে ফালাই আসছেন ।
কখনো দায়িত্ববোধ আবার কখনো অভ্যস্ততা-সব মিলাইয়ে তারা জীবনরে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত কইরার নিছিলেন যেইভাবে সমাজ চায় । কখনোই ভাবেন নাই নিজে আসলে কি চান-আসলে নিজেরাই কখনোই জানতেন না আসলে তারা কি চান । সবাই কি দেখতে চায় অথবা সবাইরে তারা কি দেখাইতে চান সেইটা নিয়াই সারা জীবন ধইরা ব্যস্ত ছিলেন । কখনোই আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নাই-কেন? কেন এই অর্থহীন দিনযাপন । আজকে পয়তাল্লিশ বছর বয়সে হাসিনা বেগম অথবা চব্বিশ বছরের মিনতি দ্বিধার সংজ্ঞা জানলেন , একটা পাড়াগেয়ো মেয়ের কাছে শিখলেন সাহসের অর্থ হলো সামনা সামনি দাড়ানোর অধিকার ।
নাজমা-একটা ঊনিশ বছরের কিশোরী-যুবতী । সে জানে বাচার অর্থ দিন-কাটানো না, প্রেমের অর্থ মন বন্ধক রেখে দেয়া না, আনন্দের অর্থ চোখে খুশির ঝিলিক না । সে জানে অধিকারের সংজ্ঞা কি, সে জানে কিভাবে রাতের পর রাত নিঃসংগ থাকন যায়, সে জানে মন না দিয়া দেহ দিলে সেইটা ব্যাভিচার ছাড়া কিছুই না । এক জীবন এক মানুষের সঙ্গে অনায়াসেই পার কইরা দেয়া যায় । কিন্তু সেই মানুষটারে সারা জীবন কি একই ভাবে ভালোবাসা যায় ? আর এক্সময় যদি ভালোবাসা নিঃশেষ হইয়া যায় তখন তার পাশে থাকা কি নিজেরে প্রতারিত করা নাকি তারেও প্রতারিত করা? নাকি এইটা স্রেফ লোক দেখাইন্যা সতীত্ব ? এইটা যদি সতীত্ব হয় তাহলে সেই মানুষটার সাথে যাপন করা প্রতিটা রাইত কি একেকটা স্বার্থপর আত্মরতিময় রাত না ?তাই বলে কি আমরা বহুগামী হইয়া পড়ব ? এক জীবনে মানুষ কয়বার ভালোবাসতে পারে ? এই প্রশ্নই বা কতোটুক যৌক্তিক ?বিনিমিত মন কি কখনো ফেরত নেয়া বা দেয়া যায় ? অথবা ভালোবাসা কি আসলেই কখনো নিঃশেষ হইতে পারে ? ভালোবাসা কি স্বর্গীয় কোন কিছু ? নাকি স্রেফ মানুষের নিঃসঙ্গতা-ভীতির কোন এক মনোস্তাত্ত্বিক সান্তনা ?
দুনিয়া ঊলট পালট হইয়া যায় মিনতির ।
ঠিক মতো কিছুই চিন্তা করতে পারে না সে । তার জীবনে দাড়া করানো অনেকগুলা ভিত নইড়া উঠে । হাসিবের সাথে সে সব সময়েই অনেস্ট আছিল । নিজের জীবনের কোন কিছুই সে তার কাছে গোপন রাখে নাই । এমন কি হাসিবের চার বছর বিদেশ থাকার সময় ইমরানের সাথে তার বন্ধুত্ব নিয়েও কখনো কোন প্রশ্ন উঠে নাই ।
কিন্তু ইমরান কিংবা আহাদ তাদের কেউ কি জীবনে এক মূহুর্তের জন্যও তাকে ভালোবাসে নাই? সেও কি কোন এক হাসিব-বিরহী মুহুর্তে ইমরানরে নিঃসঙ্গতা কাটনোর সান্তনা হিসেবে ব্যবহার করে নাই? হাসিবরে নিয়াই তার জীবনের সবকিছু-কিন্তু এইটা কি এমন না যে সে চায় বলেই হাসিবরে নিয়া তার জীবনের সবকিছু হবে ? কখনো কি সে টেষ্ট করে দেখছে জীবনে অন্য কাউরে আসতে দিলে হাসিবের গুরুত্ব কমে যায় কি না ? কখনো কি অতোটুকু সাহস তার হইছে ? নাকি কর্পোরেট ব্যস্ততার ভান দিয়া সেও জীবন পার কইরা দিতে পারবে ? নাকি ওইসব বিকৃত মনের বহুগামী নারীদের ঘৃণার চোখে দেখবে আজীবন ?
হাসিনা বেগম নিষ্প্রান হইয়া আসেন । তার সাড়ে তিন বছরের বৈধব্য জীবনে এতো অসহায় কখনোই বোধ করেন নাই তিনি । চিৎকার কইরা উঠতে ইচ্ছা করে তার । নিজের মনের অদৃশ্য দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হইয়া ফেরত আসে তার চিৎকার । জীবনে প্রথম তার চোখের আলো আহত হইয়া উঠে ।
“হাসিব , আমি তোমাকেই ভালোবাসতে চাই । শুধুই তোমাকে…তোমার পাশেই থাকতে চাই সারাজীবন…তোমার সন্তানের মুখেই মা ডাক শুনতে চাই”—হাসিবের বুকে মিশা যাইতে যাইতে ককায়ে উঠে মিনতি । তলাই যাইতে যাইতে তার কানে ভাইসা আসতে থাকে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর, “কি হলো ,দুঃস্বপ্ন দেখছ ? আরে কিছু হবে না , আমি আছি না ”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।