বৃথা হয়রানি
সেই চারকোণা ছোট্ট কপাল- ফরসা বাজুতে হালকা পশম, ঝরণার মতো ঢলে পড়া রেশমী চুলের গোছা, তুমি কী সেই! লাল ইটের ছোটো ছোটো বাক্স বাড়ি। ঠাসাঠাসি। তাতে এক চিলতে উঠোন- আমগাছের কাঁপা কাঁপা ছায়ার পাশে সোনালী রোদের হাঁটাচলা। আহা, ঐতো আমার কৈশোর। বলতে না বলতেই বাদামী ফ্রেমের চশমাপরা রোগা ছেলেটা হেঁটে আসে।
অংকে ৫৮ আর ইংরেজিতে প্রতিবার ৩০ পেয়ে ফেল করে, বাবা রাতভর আটকে রাখে কলতলার ছোট্ট ঘরে। কিনকিনে সাইরেনের চাবুক খেয়ে ঘুম ভাঙে পাড়াটার। বাবারা দলে দলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যায় সার বেঁধে। কারখানার রাক্ষুসে গেটটা একটা একটা করে মানুষ গিলে। পিঁচুটি জড়ানো চোখে আমি শুধু আমগাছের ছায়াটা দেখি।
মুহূর্তে সে কতো কিছু হয়ে যায়। একটু আগে যে দিব্যি আরবি ঘোড়ার আদল নিয়ে চিঁহিহি করছিল, সামান্য হাওয়াতে তা হয়ে গেল মেমসাহেবের ছাতা। ততক্ষণে মায়ের হাতে গুড়ের চা। তাতে লাল আটার রুটি চুবিয়ে পেট ভরে পানাহার। কখনো মটরশুটির তরকারি...
উফ্.... নিজেকে বড়ো অপরিচিত-বিভ্রান্ত লাগছে।
একি স্বপ্ন দেখছি, নাকি স্মৃতির মুখোমুখি আমি? কে বলবে এই পোকা-খাওয়া ফসিলটাও একদিন ডানা মেলেছিল আকাশে! থামো- প্যাথেড্রিনটা দিও না, প্লিজ...। তোমাকে আর ক’পলক দেখতে দাও, প্রিয়তমা। ওই প্যাথেড্রিন আমার যন্ত্রণা থামাতে পারেবে না, অযথাই একটা শিশি নষ্ট হবে। বরং পাশের বেডের যুবকটিকে দেখো, সারা রাত চিলচিৎকার শেষে এখন মুরগীর ছানার মতো চিঁচিঁ করছে- ওকে স্বস্তি দাও, জীবন এখনো ওর জন্য অবারিত। এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কী ভাবছো।
নীল মাস্কে ঢাকা মুখে সেই স্বপ্নালু দুটি চোখ। সেই চোখ! যে চোখে ডুব দিলেই রেল পাড়ার এঁদো-গলিটাকে পেয়ে যাই সুড়ঙ্গের মতো করে।
আমি তখন টেনে, তুমি আরো দু-ক্লাস পেছনে। ততদিনে বগলের তলায় কঁচি লোমের চুলকানি। তোমাকে বিভোর হয়ে দেখি।
কখনো গালর্স স্কুলের গে’টে, কখনো পাড়ার রাস্তায়, কিংবা সোহেল ভাইয়ের ক্লাসে। তোমাকে দখলেই গরু-ভেড়ার অংকটা ভুল হয় বারবার। ভাইয়া চোখ পাঁকিয়ে ধমকে দেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের পিচকারি মারা হাসি। আর তুমি শুধু তাকিয়ে থাকো- কি জানি তাচ্ছ্বিল্যে নাকি বিস্ময়ে।
আমি আড়চোখে তোমাকে দেখি। আকাশে অনেকগুলো রঙিন মুনিয়া উড়ে যায়। মনটা কেবল উড়– উড়–। খাতা ভরা বীজগণিতের ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো কবিতার লাইন। না-না, কবিতা নয়, সে ছিল আমার হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণের চিহ্ন।
একদিন দু:সাহস উঁকি দিল মনের ভেতরে। কতোগুলো ভাঙাচুরা কবিতার লাইন চিরকুটের বুকে বুকে হেঁটে গেলো তোমার টেবিলে। তারপর তোমার কোচিং বন্ধ, বাবা ছাড়া স্কুল আসো না। এক সন্ধ্যায় তুমি নিতুদের সঙ্গে হাঁটছিলে গলির রাস্তায়। আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলে, অন্যদের সেকি হাসি।
বড়ো মায়া হলো তোমাকে দেখে। ছবির পর্দার মতো এসে দাঁড়ালাম তোমার সামনে। তোমার মুখের একপাশে চুরি যাওয়া গোধূলির আলো। কী নিষ্পাপই না লাগছিল তোমাকে! তুমি যথারীতি তাকিয়ে রইলে। ফ্যালফ্যাল করে।
স্বপ্নালু দুটো চোখ।
ব্যস এতটুকুই তো ঘটনা। কে জানত তোমার বড়ো মামা গাইবান্ধার ডিসি। ভাগ্নীর ভবিষ্যৎ নিষ্কন্টক করে তুলতে তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায়, বলা নেই কওয়া নেই ওরা এসে তুলে নিল ৫৪ ধারায়।
তারপর শক্ত একটা মামলা দেখিয়ে চালান দিল কোর্টে। তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলো আদালতে। সুবেশী ম্যাজিস্ট্রেটের ঠাণ্ডা গলার ধমক একটা দস্তখত বাগিয়ে নিল অনায়াসে। তারপর কিশোর সংশোধন কেন্দ্রর ৪২টি মাস.... যেন একটা দীর্ঘশ্বাস... শুধু তোমাকে ভেবেই কেটে গেলো। যখনই বুক ফেটে কান্না এসেছে, তোমার স্বপ্নালু চোখ দুটিতে ডুব দিয়ে ছুটে গেছি রেল কলোনির কড়ই গাছগুলোর তলায়।
মুঠো মুঠো শীতল হাওয়া এসে ভুলিয়ে দিয়েছে সব অনুযোগ। সংশোধন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে দেখি পৃথিবী অন্যরূপ। বাবা এরিমাঝে আমাকে কাগজে কলমে ‘ত্যাজ্য’ করেছেন, মার ঠোঁটে সেই হাসির ঝিলিক নেই, মামারা চান তাদের গ্যারেজে গিয়ে কাজ শিখি। কোথায় গেলো এশিয়ার খনিজ সম্পদ আর কোথায়বা জার্নি বাই ট্রেন! একবার গোল্লা থেকে উল ছড়িয়ে পড়লে সেকি সহজে আর ফেরে? হিংস্র বাঘের মতো অন্ধকার আমার ঘাড়ে কামড়ে একটু একটু করে টানতে লাগল। একটা দুটো করে মানুষের রক্তে ভিজতে লাগে দুটি হাত।
থানার দারোগা আমাকে চেনে, ওসির বাসায় গিয়ে চা খাই, তারপরো ওরা আমাকে ফর্দ করে খোঁজে। আগুন নিয়ে খেললে আগুন তো একদিন স্পর্শ করবেই। তাই হলো। কতগুলো লোক এসে তুলে নিল আমাকে। চোখে পট্টি, হাতে কড়া।
অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি ছুটল। হয়ত ঘন্টা কিংবা তারো বেশি। একটা বিরাণ মাঠের ধারে এনে নামানো হলো আমাকে। তারপর সব বন্ধন টুটিয়ে দিয়ে কষে একটা লাত্থি মারল পাছায়। যা, ফুট শালা...।
আমি ছুটলাম প্রাণেপণে। পেছনে পেছনে কতগুলো ফুটন্ত বারুদের দানা।
তারপর ঘুম ভেঙেই দেখি তুমি। সেই তুমি.... বান্ধবীদের উপহাসে বিচলিত অথচ আমার জন্য কতোটাই না উদগ্রীব! আমি আর তুমি- যেন পাড়ার রাস্তায় মুখোমুখি। তোমার চোখে প্রশ্নের বাণ, হয়ত তার পাশে কিছুটা অনুশোচনাও।
নাহ, আমি আজ কিছুই বলব না। কোন অভিযোগ নেই আমার। এক জীবনে পেলাম না তাতে কি, ভয় নেই প্রিয়তমা, আর জন্মে নিশ্চই দেখা হবে...
জানুয়ারি ২০০৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।