বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায়
আজকে বাবা দিবসে ইচ্ছে করছিলো খুব বাবাকে নিয়ে লেখার কিন্ত টাইপবোর্ডে হাত রাখতেই মনিটর চোখের সামনে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছিলো ।
শুনেছিলাম নিজের কষ্টগুলো নাকি অন্যর সাথে শেয়ার করলে কষ্টর ভার অনেকটা লাঘব হয় । তাই বাবাকে নিয়ে লেখা আমার একটি পূর্ব প্রকাশিত পোস্ট ব্লগে আবার প্রকাশ করলাম নিজের কষ্টকে আপনাদের সবার সাথে শেয়ার করার জন্য ।
তোমাকে মনে পড়ে
সামনে আসছে সেপ্টেমবার ,এই মাসে আমি আমার প্রিয় একজন মানুষ আমার বাবাকে হারিয়ে ছিলাম । ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ পড়তেই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল ।
বাবাকে আমার এখন প্রতিটি মুহুর্তে মনে পড়ে। মনে পড়ে অনেক জমে থাকা ব্যাথার কথা । খেলাধূলার জগতে জীবনে ১মবার জাতীয় পর্যায়ে যখন পুরস্কার পেলাম আমার বাবা তার ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় আসতে পারলেননা, আমি জীবনে ১ম পুরস্কার নিচ্ছি কিন্ত আমার বাবাকে অনেক খুজঁলাম ভীড়ের মাঝে পেলামনা। সেই কিশোর বয়সের চাপা অভিমানে বেশ কিছুদিন বাবার সাথে কথা বলিনি।
আমি ছোটবেলায় প্রায় স্কুল পালিয়ে মাঠে যেয়ে ফুটবল খেলতাম ।
আর প্রতিদিন বাবা আমাকে মাঠ থেকে ধরে আনতেন কিন্ত শুধু বকা দিয়ে বলতেন আর যেন এরকম না করি । কিন্ত কখনো আমার গায়ে হাত তুলেননি । আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার আগে প্রি টেস্টে উচ্চতর গনিতে পেলাম ১৩ ,বাবাকে যথারীতি স্কুলে এসে হেড মাস্টারের কাছে অনেক কিছু শুনতে হল আমার জন্য,আমার মনে হচ্ছিল বাবা যেন আমাকে খুব করে মারে, অনুশোচনায় আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা । বাবা হেডমাস্টারের রুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে শুধু তাকিয়ে বললেন "তোমার জন্য আমাকে আজ স্কুলে আসতে হল"।
আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেদিন আর কখনো পড়ালেখায় অমনোযোগী হবোনা ,তিন মাস পর পরীক্ষা দিলাম ,যথারীতি ফল বের হল ৫টি লেটার সহ স্টারমার্ক কিন্ত সবচেয়ে বেশী খুশী হলাম যখন দেখলাম সেই উচ্চতর গনিতে পেয়েছি ৯১।
বাবার মুখে দেখলাম পরিতৃপ্তির হাসি মনে হল, এযেন লেটার মার্কের চেয়ে অনেক বড় এক পুরস্কার আমার জন্য । বদলে গেলাম আমি , একই সাথে বদলাতে লাগলো আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্হা। সেই সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম আমার সৎ ব্যবসায়ী বাবার ব্যবসা দিন দিন খারাপের দিকে এগুচ্ছিল,দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে। তাই আমিও বদলে গেলাম নিজে টিউশনি শুরু করলাম ,নিজের খরচ অনেকটা নিজে ম্যানেজ করে নিতাম । বাবাকে বোঝাতাম আমি স্বাবলম্বী হতে চাই ।
তাই নিজের খরচ নিজের উপার্জনে চালাতে চাই। জানিনা আমার বাবা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কিনা সে সময়।
যদি ও আমার মাইক্রো বায়োলজি তে পড়ার বেশ ইচ্ছা ছিল। কিন্ত বুঝতে পেরেছিলাম আমার পক্ষে আর উচিত হবেনা আমার বাবার ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপানো। তাই সির্ধান্ত নিলাম দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ান যায় এমন কোন পেশায় যোগদান করবো।
চলে আসলাম বর্তমান পেশায় । বাবা প্রথমে রাজী না হলেও পরে আমার সির্ধান্তকে উনি সম্মান করলেন,মেনে নিলেন। শুর হল জীবনে প্রথম একা একা পথচলা , এর মাঝে মাঝে ব্যস্ততার ফাঁকে যখন বাড়ী আসতাম, কখন ও বাসায় ছুটিতে আসতে আসতে গভীর রাত হত দেখতাম আমার বৃদ্ধ বাবা তার একমাত্র ছোট ছেলের অপেক্ষায় দাড়িঁয়ে আছে । উনি জোর করতেন আমার হাত থেকে ব্যাগ নেয়ার জন্য। সেই ছেলেমানুষীর পেছনে যে গভীর স্নেহের পরশ ছিল তা বুঝতে পারতাম তাই ওনাকে নিরাশ না করে ইচ্ছে করেই ব্যাগটা হালকা করে আনতাম।
কারন আমি যেমন তার স্নেহের পরশের আশায় চেয়ে থাকতাম তেমনি উনি তা দেয়ার অপেক্ষায় থাকতেন। এযেন ছিল এক অন্যরকম সম্পর্ক আমার আর বাবার মাঝে।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায় আমি বিয়ে করি সরকারী কোর্য়াটারে উঠি আমার বাবা মা আমার বাড়ীতে আসেন বেড়াতে তাদের চোখেমুখে দেখি গভীর তৃপ্তির হাসি। আমার বুকটাও ভরে উঠে তাদের খুশী দেখে।
এরপর প্রতিটি কাহিনীর যেমন ছন্দপতন হয় ,জন্মের সাথে যেমন মৃত্যুর এক অমোঘ সম্পর্ক ।
ঠিক তেমনি আমার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার কয়েকমাস পর আমার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো। তিনি এমন চাপা স্বভাবের ছিলেন যে আমরা কেউ টের পাইনি কি কঠিন এক অসুখ তার শরীরে বাসা বেধেঁছে। আমার বাবা ও চায়নি তার ছেলেকে তার অসুখের কথা জানাতে । কি অদ্ভুত এই পিতার স্নেহ !
আমি একজন যোদ্ধা, যুদ্ধ ছাড়া কিভাবে মানতে পারি মৃত্যুর কাছে জীবনের এই পরাজয় । তাই শেষ মুহুর্তে ও হাল ছাড়লামনা ,নিজের কাছে যা ছিল তার সাথে ধারকর্জ করে অবশেষে অতি অল্প সময়ে এক নামকরা হাসপাতালে তার অপারেশনের ব্যবস্হা করলাম।
আর আমার বাবা তার জীবনের সন্ধিক্ষনে এসেও সারাক্ষন আফসোস করছিলেন তার জন্য আমি নাকি অনর্থক এত অর্থ খরচ করছি, বারবার বলছিলেন সরকারী হাসপাতালে অপারেশন করলে তো আরও কম খরচে অপারেশন করা যেত।
এদিকে ডক্টর জানালেন এক কঠিন সংবাদ এই অপারেশেন নাকি
তার জীবনের ঝুঁকি আছে যেহেতু উনার বয়স হয়েছে। আমি উনাকে সবকিছু খুলে বললাম , উনি সব শুনে আমাকে শুধু বলেলন তোমাদের কোন সমস্যা না থাকলে আমি তৈরি । মৃত্যু আজ না হোক কাল তো হবে তাই ভাল ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে দোষ কি। আমি জানি আমার বাবার এই সির্ধান্ত নেয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল প্রথমত উনি চাননি তার এই অসুখে কারও সমস্যা হোক,আর দ্বিতীয়ত উনি কষ্ট পেয়ে ধুঁকে মরতে চাননি।
আজ ও মনে পড়ে অপারেশনের আগে বাবার সাথে কিছুক্ষন কথা হল একান্তে ,আমি বললাম "বাবা কোন সমস্যা?"
উনি ব্যথা চেপে উত্তরে বললেন "কই নাতো। "উনি আমাকে বললেন "আর কতক্ষন পর অপারেশন?"
আমি বললাম "আব্বা আমি জানিনা অপারেশনের ফলাফল কি হবে ? তুমি কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত?" উনি হেসে বললেন "সবাইকে তো যেতে হবে একদিন। "
আমিও হেসে বললাম "তাতে কি পরবর্তী জীবনে তো আবার তোমার সাথে আমার দেখা হবেই। "
আমাদের এই অদ্ভুত আলাপচারিতায় হাসপাতালের এক লোক আমাকে বললো উনি নাকি জীবনে এরকম মৃত্যুপথযাত্রীর সাথে হাসিঠাট্টা করতে দেখিনি । আমাকে একটু হালকা তিরস্কারও করলেন তিনি।
অবশেষে সময় হয়ে এলো বাবাকে এগিয়ে দিলাম ওটি পর্যণ্ত।
তারপর সব ইতিহাস, অপারেশন ভালো হয়েছিল কিন্ত পরদিন হঠাত্ত হার্ট এটাকে উনি মারা যান।
বাবাকে নিয়ে আসলাম বাসায় ,আমি নিজ হাতে মৌলভীর সাথে আমার বাবাকে তার জীবনের শেষ গোসল করিয়ে দিলাম। অনেক
যত্ন করে তার মাথা ধুয়ে দিলাম । যে হাতের পরশে মনে এক অসম্ভব ভালোবাসা দোলা দিতো সেই হাতের আংগুল গুলো পরিস্কার করে ধুয়ে দিলাম।
তারপর যথারীতি তাকে পরম মমতায় নিয়ে চললাম শেষ ঠিকানাস্হলে। একদিন উনি আমাকে হাসতে হাসতে যেই ঘরের দরজা দিয়ে নবজাতক হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতাল থেকে ,আজ সেই আমি তাকে নিয়ে চললাম শেষ বিদায় দিতে।
বাবাকে খুব আস্তে আস্তে শোয়ালাম ঠান্ডা মাটির উপরে মনে মনে বললাম বাবা অপেক্ষায় থাকো আমার জন্য । আবার দেখা হবে।
বাবার ইতিহাস এখানেই শেষ।
অপেক্ষায় আছি বাবার সাথে আবার কবে দেখা হবে...............?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।