মোমার্ত
১ম পর্ব
যাত্রা পথে
নতুন একটা জায়গা দেখা হবে এ আশায় অধীর হয়ে দুজন নিউ দিল্লী রেল ষ্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাড়ার কথা রাত ৯:৩০-এ । আসবে সেই মুম্বাই থেকে। প্রায় ৪০ মিনিট দেরী করে ট্রেনটা এলো। আমাদের টিকেট দুটো ছিল টু-টিয়ার এয়ারকন্ডিশনড ক্যাটেগরির।
এর অর্থ ৪ বার্থ বিশিষ্ট ছোট একটা কুপের দুটো বার্থ আমাদের। সহজেই খুঁজে পেলাম ওটা। পরিচয় হল অন্য দুজন সহযাত্রী বয়ষ্ক এক দম্পতির সাথে। ওনারা সাহারানপুর বলে এক জায়গায় নামবেন। দিল্লী থেকে ট্রেনে প্রায় ৪ঘন্টার পথ।
ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, আচরণে গম্ভীর ও সতর্ক ভাব। তাই আলাপ বেশী জমলো না ... হাঁ, ইয়েসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো কথাবার্তা। যদিও পরে ওনার সৌজন্যবোধ আমাদের মুগ্ধ করেছে। অন্যদিকে ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও মুনের সাথে ভদ্রমহিলার আলাপ জমে উঠলো। ছবি তোলা হল কয়েকটা।
দাওয়াত পেলাম সাহারানপুর বেড়ানোর। বার বার বললেন ওনাদের সাথে নেমে যেতে, বড় বাসা, থাকার জায়গার অভাব নেই। পরে অমৃতসর পৌঁছে দেয়া হবে আমাদের। আল্লাহকে ধন্যবাদ, সদ্যপরিচিত মানুষের ভালবাসায় আরেকবার সিক্ত হলাম।
রাত ১০:৩০ এ ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে ডিনারের অর্ডার নিতে এলো এটেনডেন্ট।
ভারতীয় খাবারের বৈচিত্র্য আমাদের টানে। তাই যাত্রা পথে সুযোগ পেলেই চেষ্টা করি অপরিচিত খাবারের স্বাদ নিতে। দুই রকম খাবার - ভেজ (নিরামিষ) ও নন-ভেজ (আমিষ)। দুটোরই টেস্ট নেয়ার জন্য একটা করে অর্ডার দিলাম। সহযাত্রী দম্পতি দেখি বাক্স খুলে খাবার বের করছেন।
রুটি, ডাল, সব্জি এবং অবধারিতভাবে আচার। ওদের ভেজ নন-ভেজ সবখাবারের সাথে আচার থাকবেই। আমাদের ডিনার আসা পর্যন্ত ওনারা অপেক্ষা করলেন। তারপর শুরু হল সাধাসাধি। ভদ্রমহিলার প্রবল মাতৃভাব আমাদের বাধ্য করল ওনাদের খাবারে ভাগ বসাতে।
ডিনার শেষে ছোট একটা ঘুমের আয়োজন করলেন ওনারা। ঠিক ২:১৫ টার দিকে সাহারানপুর পৌছুল ট্রেন। নামার সময় মুনকে আদর করলেন ভদ্রমহিলা। বিদায় হ্যান্ডশেকের সময় প্রথম হাসি দেখলাম ভদ্রলোকের মুখে। পুরো কুপেটা এখন আমাদের।
সাহারানপুর থেকে আর কেউ উঠেনি।
খুব ভোরে আবছা অন্ধকারের মধ্যে বিরাট ট্রেনটা প্রবেশ করল অমৃতসর ষ্টেশনে। শীতের ভোরে জবুথবু হয়ে থাকা ষ্টেশনটা মূহুর্তে গমগম করে উঠলো যাত্রীদের কোলাহলে। ট্রেন থেকে নেমে চিন্তা করছি কোনদিক দিয়ে বের হব। সবচেয়ে বেশি মানুষ যেদিক দিয়ে বের হচ্ছে আমরা সেদিক রওনা হলাম।
ষ্টেশন থেকে বের হয়ে অবাক! এতো মানুষ নামলো ট্রেন থেকে অথচ বাইরে ২/৩টা সিএনজি স্কুটার, ৩/৪টি রিক্সা আর সেগুলোর ড্রাইভার ছাড়া কেউ নাই। সবাই ঝটপট নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা দিয়েছে। বাইরে বিবর্ণ ধোঁয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি দেখে দুজন সিএনজি ড্রাইভার এগিয়ে এলো। হিন্দী নয় সম্ভবত পাঞ্জাবী ভাষায় কি বলল বুঝলাম না, খালি একটা শব্দ বুঝলাম মাইজি ... আর ভাবে বুঝলাম কোথায় যাব জানতে চাচ্ছে। মোটা-সোটা ড্রাইভারের ঢুলু ঢুলু লাল চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নোংরা পোষাক দেখেই ওকে নেয়ার চিন্তা বাতিল করে দিলাম।
কিন্তু পিছু ছাড়েনা, অন্য ড্রাইভারদের ডাকলেও আসে না, বুঝলাম একটা সমঝোতা আছে এদের মধ্যে। মুন ইশারায় সম্মতি দিতেই মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে উঠে বসলাম স্কুটারে। বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী মিশিয়ে বললাম একটা ভাল হোটেলে নিয়ে যেতে। দেখি এই সন্ত্রাসী চেহারার ড্রাইভার কোথায় নিয়ে যায় আমাদের! পরবর্তীতে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যশওয়ান্ত সিং নামের এই পাগড়ী-দাড়ি ছাড়া হতদরিদ্র শিখ ড্রাইভার তার নির্লোভ আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নেয় এবং অমৃতসরে আমাদের প্রায় ১৬ ঘন্টার আনন্দময় অবস্থানের এক উল্ল্যেখযোগ্য স্মৃতিতে পরিণত হয়।
চলবে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।