আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিল্পায়ন বিকাশে সমস্যা ও করণীয়

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

শিল্পায়ন বিকাশে সমস্যা ও করণীয় কৃষি প্রধান বাংলাদেশে শতকরা ৮৫ ভাগ লোক এখনও কৃষিজীবী। তাই কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের অর্থনেতিক উন্নতি সম্ভব নয়। কিছু কিছু শিল্প কাঁচামাল হিসাবে কৃষিপণ্য যেমন পাট, আখ, বাঁশ-বেত, তৈলবীজ ইত্যাদি ব্যবহার করে। ঐ সমস্ত শিল্প বন্ধ করে দিলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন এবং শিল্পায়ন দু’টিই বিঘ্নিত হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৮০টি জুট মিল ছিল, ভারতের ছিল তখন মাত্র ১৭টি।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০টি এবং ভারতে ৯২টি জুট মিল চালু আছে। পাটকে এক সময় সোনালী আঁশ বলা হতো আর এখন বলা হয়-"কৃষকের গলার ফাঁস"! একসময় শুধু কাঁচা পাট ইউরোপ, ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে সর্ব্বোচ্চ অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। পৃথিবীর সর্ববৃহত পাঠ উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে এ দেশের খ্যাতি ছিল। রপ্তানি করার পরও উদ্ধৃত কাঁচা পাটকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশে দেশে আদমজী সহ অন্যান্য পাটকল স্থাপিত হয়। এ সমস্ত পাটকলে উৎপাদিত পাটজাত দ্রব্য পৃথিবীর বহু দেশে রপ্তানি হতো।

স্বাধীনতার পর পাটকলগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য পাটকল কর্পোরেশন গঠিত হয়। পাটকল কর্পোরেশন একমাত্র সাফল্য অর্জন করেছে বড় বড় পাটকল গুলো বন্ধ করে দেয়া। অথচ বিরাষ্ট্রিয়কৃত প্রাইভেট সেক্টরের পাটকলগুলো ভালভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছে। বেসরকারী পাটকলগুলোর উতপাদিত পণ্য দেশের ভিতরে ও বিদেশে বিক্রির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে পরিবেশ বান্ধব প্রাকৃতিক আঁশ হিসাবে খাদ্য-দ্রব্য, ভোজ্য দানা, ওষুধ ইত্যাদির সংরক্ষণ, পরিবহন ও গুদামজাত করার জন্য চটের বস্তার প্রয়োজনীয়তাও সমাদর পৃথিবীব্যাপী বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

আরও বাড়ছে চটের কাপড়ের তৈরী, জুতা-স্যান্ডেল, ব্যাগ, থলে, বিভিন্ন ধরনের উপহার ও গৃহস্থালীর সামগ্রী যা হস্তশিল্পে বা ছোট আকারের কুঠির শিল্পে উৎপাদিত হয়। এগুলোর চাহিদা যেমন আভ্যন্তরীণ বাজারে আছে তেমনি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। যথাযথ বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া হাতে নিলে বিদেশের বাজার আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। সুতরাং পাটকলগুলো বন্ধ না করে সেগুলোর বি.এম.আর.ই ও ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে আভ্যন্তরীণ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত চুরি-চামারি দূর করতঃ নতুনভাবে পরিচালনা করলে পাটকলগুলো লোকসান কাটিয়ে লাভজনক হয়ে উঠতে পারতো। অথবা বিকল্প হিসাবে বেসরকারী খাতে মিলগুলো বিক্রি করে দিলেও পাটকলগুলো নিজস্ব সম্পদ ও দায় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো।

অতীতে বেসরকারী খাতে বিক্রিত পাটকলগুলোর প্রায় সবকয়টি বর্তমানে মুনাফা করে যাচ্ছে। পাট শিল্পের পরেই বিপত্তি নেমে এসেছে চিনি শিল্পের উপর। সাম্প্রতিক একটি পত্রিকার খবর হলো, চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ব ১৪টি চিনি কলে গত অর্থ বছরের উৎপাদিত চিনির এক বিরাট অংশ (প্রায় ১৫০ কোটি টাকা) মূল্যের অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে প্রায় প্রতিটি মিলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে, তাঁদের ঈদ বোনাস পরিশোধ তো দূরের কথা, মাসিক বেতন পরিশোধ করাও সম্ভব হয়নি অনেক মিলে। তদুপরি নতুন বছরের আখ মাড়াই শুরু হয়েছে প্রবল তারল্য সংকট ও লোকসানের বোঝা নিয়ে।

অথচ এ মিলগুলোই বিগত বছরগুলোতে মুনাফা অর্জন করেছে। তাছাড়া আরও সংকট সৃষ্টি হবে উৎপাদিত নতুন চিনি গুদামজাত করার স্থানের অভাবে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে দু’টি প্রধান কারণ হচ্ছে উৎপাদন খরচ কম থাকায় ভারতীয় চিনির মুল্য কম হওয়ায় আমদানী বাড়ছে এবং বিশাল সীমান্ত অঞ্চল অত্যন্ত সীমিত উপরন্তু প্রায় নিরস্র বিডিআর থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে অবৈধ পথে ভারতীয় চিনি প্রচুর পরিমাণে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে বেশী দাম হওয়ায় দেশীয় চিনি বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। এ সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ দেশীয় অবিক্রিত চিনি অতি দ্রুত বিক্রির ব্যবস্থা করা।

সেটা করতে হলে প্রথমেই ভারতীয় চিনির চোরাই পথ সম্পুর্ণ বন্ধ এবং আমদানী সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হবে। তাতে “বন্ধু রাস্ট্র” শুধু মনক্ষুন্ন হবেনা, বরং ক্ষুদ্ধও হবে। তবে ভারতের ক্ষুদ্ধ হওয়া উচিত নয় কারণ ভারতও তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে সাময়িকভাবে বাংলাদেশ সহ বিভিন্নদেশের সাথে কিছু কিছু দ্রব্যের আমদানি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। আমাদেরকেও জাতীর স্বার্থে মুমূর্ষু চিনি কলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এ কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ হিসাবে মিলগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে।

উৎপাদন খরচ কমাতে হলে কতকগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন বি,এম,আর,ই করে যন্ত্রপাতির উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে হবে, অতিরিক্ত বা অদক্ষ শ্রমিক কর্মীদের ছাঁটাই করে মজুরীর পরিমাণ কমাতে হবে, ভূয়ানামে/বেনামে পরিশোধিত অবৈধ মজুরী বিলুপ্ত করতে হবে। আঁখ ও অন্যান্য কাঁচামাল ক্রয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে অতিরিক্ত খরচ কমাতে হবে। জ্বালানি, যানবাহন মেরামত, খরচ ইত্যাদি খাতে দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এ সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে উৎপাদন, প্রশাসনিক ও অন্যান্য খরচ কমে আসবে এবং চিনির বিক্রয় মূল্য আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক স্থানে দাঁড়াতে পারবে।

সরকারী মালিকানাধীন এ দেশের কাগজ শিল্পের মধ্যে কয়েকটি ইতোমধ্যেই কবর দেয়া হয়েছে, কোনটি ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল এক সময় দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে নিউজপ্রিন্ট রপ্তানি করত। সেই মিল কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কর্ণফুলী পেপার মিল লোকসানে নিমজ্জিত। অথচ আমদানীকৃত কাগজের সাথে পাল্লা দিয়ে কর্ণফুলী পেপার মিলে উৎপাদিত কাগজ এক সময় দেশের প্রয়োজন মেটাতো।

এখন যেমন উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, গুনগত মানও কমেছে এবং দামের দিক দিয়ে আমদানীকৃত কাগজের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় টিকতে পারছে না। অথচ বেসরকারী মালিকানায় কাগজ মিলগুলো যেমন বসুন্ধরা, ম্যাক পেপার, ইত্যাদি কারখানা মুনাফার সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ও কর্ণফুলী পেপার মিলের কাঁচামাল বাঁশ যা পর্যায়ক্রমে পরিমাণে কমে যায়। কিন্তু বর্তমানে পাট থেকে তৈরী মন্ড এবং রিসাইকেল পেপার দিয়ে কাগজ তৈরী করা যায়। পাটগাছকে কাগজের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করলে পাট চাষ তেমন বৃদ্ধি পাবে, দেশের অর্থনীতিও লাভবান হবে।

কাজেই এগুলোকে বেসরকারী হাতে ছেড়ে দিলেও দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলকর। স্বাধীনতা-উত্তর কালে ছাতক সিমেন্ট মিল ছাড়া অন্য কোন উল্লেখযোগ্য সিমেন্ট কারখানা ছিল না। আমরা চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে সিমেন্ট আমদানী করতাম। আজ দেশে বেসরকারী সেক্টরে ডজন ডজন সিমেন্ট কারখানা লক্ষ লক্ষ টন সিমেন্ট উৎপাদন করে শুধু দেশের চাহিদা মিটাচ্ছে না, বিদেশেও রপ্তানি করছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার জন্য।

পাট,চিনি,কাগজ শিল্পকে সরকারী মালিকানায় না রেখে একটি পরিকল্পিত পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে বেসরকারী মালিকানায় ছেড়ে দেয়াই হবে উত্তম সিদ্ধান্ত। তৈরী পোশাক শিল্প ও ব্যাকআপ শিল্পের উত্থানের সাথে সাথে কিছু কিছু শিল্প মার খেয়েছে বা অবহেলিত হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তন্মধ্যে বুনন শিল্প। ঢাকেশ্বরী, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ইত্যাদি বুনন কারখানা ছাড়াও অনেক দেশীয় তাঁতের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও চাহিদার অনুপাতে পাওয়ার লুম কারখানা এবং তৈরী পোশাক শিল্পের ব্যাক-আপ শিল্প দেশের ভেতরে যথেষ্ট নয়।

পুরানো কটন মিলগুলোকে বন্ধ করে পরিত্যক্ত না করে এগুলোকে বেসরকারী মালিকানায় ছেড়ে দিলেই অর্থনীতি লাভবান হতো। বিরাষ্ট্রীয়কৃত টেক্সটাইলও স্পিনিং মিলগুলো যে দক্ষতার সাথে ব্যবসা চালিয়ে মুনাফা করছে, সেটা তারই প্রমাণ। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্প দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। দ্বিতীয় স্থানে আছে আদম রপ্তানি। এ দুটো শিল্পের স্থায়িত্ব ও বিকাশ নির্ভর করে পররাষ্ট্র নীতি, বিদেশীদের চাহিদা, টেকনোলজীর উন্নতি ইত্যাদি কারণগুলোর উপর।

যে কোন সময় এ দুটোতে নিম্নগতি আসতে পারে। সে রকম বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার জন্য দেশের পাট, চিনি, কাগজ, বস্ত্র, ওষুধ ইত্যাদি শিল্পগুলোকে অবহেলা করলে অদূরদর্শীতার পরিচয় দেয়া হবে। চলমান কোন কারখানাগুলোকে বন্ধ না করে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে সেগুলোকে চালু রাখাই হবে দক্ষ রাষ্ট্র প্রশাসনের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। (আমার এই লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার পাঠকদের পাতায় প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।