নাজমুল ইসলাম মকবুল
(সুত্র: মানবজমিন ২৩-১২-২০১০)
উইকিলিকস থেকে এবার চারটি বিষয়ে নতুন তথ্য জানা গেল। প্রথমত, দু’বছর আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছিল।
দ্বিতীয়ত, র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ সরকার উভয়ে মনে করে র্যাব নিষিদ্ধ হওয়া উচিত নয়। তারা বরং জনগণের শ্রদ্ধা পাচ্ছে।
তৃতীয়ত, এই দু’টি দেশই বাংলাদেশের অনিয়ন্ত্রিত মাদরাসার পাঠ্যসূচিকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কাজ করছে। চতুর্থত, ২০০৬ সালে ফুলবাড়ীতে সহিংস বিক্ষোভের মুখে কয়লা খনির কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ. মরিয়ার্টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে গত বছর জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর কাছে তদবির করেছিলেন। বৃটিশ কোম্পানি গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট (জিসিএম)-কে ওই খনিতে কাজ পাইয়ে দিতে তিনি অনুরোধ করেন। ওই কোম্পানিতে ৬০ ভাগ মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, র্যাবকে সহায়তা প্রদান প্রশ্নে বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
এক দলের মতে র্যাবকে সহায়তা দেয়া দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলের অংশ। অন্য দল মনে করে, র্যাবকে এভাবে সহায়তা দিলে তা বৃটিশদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে।
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগে উইকিলিকস মার্কিন গোপন কেবল প্রকাশ করে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টির পর এবারই প্রথম সরাসরি ঢাকা থেকে পাঠানো অর্ধ ডজন কেবল পাওয়া গেল। এসব কেবল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো প্রায় ১৭০০ কেবলের কয়েকটি।
আওয়ামী লীগের বিজয়: উইকিলিকস প্রকাশিত কেবল থেকে দেখা যায়, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিল।
কারণ ভারত মনে করেছে, তার জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ শেখ হাসিনা অবসান ঘটাবেন। যুক্তরাষ্ট্রও মনে করেছে এর মাধ্যমে তাদের ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ এজেন্ডা অনেকটা হাসিল হতে পারে। সে কারণে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি আওয়ামী লীগের বিজয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়, সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পরপরই শেখ হাসিনা সন্ত্রাস দমনে একটি আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেন। তার প্রতি দিল্লির ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত হয়।
মরিয়ার্টির ভাষায়, এর মধ্য দিয়ে এমন একটি শক্তিশালী সহযোগিতার সম্পর্ক ব্যক্ত হয়েছে, যাতে কিনা ‘ব্যাপক মার্কিন স্বার্থ’ নিহিত রয়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে ১৩ই জানুয়ারি ২০০৯ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের সঙ্গে তারা নিরাপত্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে উন্নত সহযোগিতা স্থাপনে আশাবাদী।
বাংলাদেশের এফবিআই: র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকার পরেও বৃটিশ পুলিশ কি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলো সেটা নিয়ে বৃটেনে হৈচৈ পড়ে গেছে। কারণ এ বিষয়ে বৃটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান গতকাল বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা কেবল থেকে দেখা যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত র্যাবকে বৃটিশ সরকার মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ হাইকমিশন উভয়ে বাংলাদেশে কাউন্টার টেররিজম অপারেশনকে শক্তিশালী রাখার স্বার্থে র্যাবকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে জোরালো মত ব্যক্ত করেছে। মরিয়ার্টি যুক্তি দিয়েছেন, ‘বিগত দশক ধরে অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ভীতসন্ত্রস্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে র্যাব বিরাট শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করেছে। ’ মরিয়ার্টি এমনকি ভবিষ্যতে র্যাব একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডেলে ‘বাংলাদেশী এফবিআই’তে পরিণত হতে পারে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য আরেকটি কেবলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি মার্কিন সিনেটর লেহি’র উদ্যোগে প্রণীত আইনের আওতায় ‘কথিত মানবাধিকার সংক্রান্ত অভিযোগের কারণে র্যাব প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেতে অযোগ্য’ বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
র্যাব নিষিদ্ধ না করার পক্ষেও নির্দিষ্ট মত দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি।
একটি কেবলে তিনি উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’বছর আগে নির্বাচনে জিতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সন্ত্রাসবাদ দমনে তিনি একটি আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠন করবেন। মরিয়ার্টির বর্ণনায়, সেটা হলো শেখ হাসিনার একটি কভার বা আড়াল নেয়া। তাকে যাতে ভারতের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ না মনে করা হয়, সেটা অর্জন করাই তার লক্ষ্য। অবশ্য ভারতের তদানীন্তন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন বিষয়টি বুঝেছিলেন বলেই মরিয়ার্টি স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছিলেন। মি. পিনাক এবিষয়ে মত দেন যে, তিনিও চান এরকম একটা কিছু থাকুক।
তবে সেটা যেন আরেকটি ‘টক শপ’ বা কথার দোকান না হয়, এটা যেন কাজে দেয়।
ঢাকায় মার্কিন দল: ১১ই আগস্ট ২০০৮। তখন ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। এসময় জেমস এফ মরিয়ার্টির এক গোপনীয় তারবার্তা থেকে দেখা যায়, ওই সময়ে বাংলাদেশে মার্কিন সরকারের একটি আন্তঃসংস্থা মূল্যায়ন টিম এসেছিল। তারা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে।
এবিষয়ে মরিয়ার্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র্যাব পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এপর্যন্ত এ সংস্থার বিরুদ্ধে যত ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে তারা মার্কিন সরকারকে অতিরিক্ত তথ্য সরবরাহ করবে। দু’দিন ধরে ব্যাপকভিত্তিক তথ্য অনুসন্ধান চালানোর পর র্যাবের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার পাওয়া যায়। সফররত মার্কিন দল দু’টি বিষয় খতিয়ে দেখেছে। প্রথমত, তাদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। অন্যটি হলো, র্যাবের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বজায় রাখার সম্ভাব্যতা যাচাই।
মার্কিন সরকারের ওই মূল্যায়ন দলে পররাষ্ট্র দপ্তর, প্রতিরক্ষা এবং বিচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। ১২-১৬ই জুলাই ২০০৮ ওই সফরটি হয়। তারা র্যাব ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন। তারা ঢাকা ছাড়াও মাঠ পর্যায়েও মতবিনিময় করেন। ওই সময় মার্কিন প্রতিনিধিদল র্যাব নেতৃবৃন্দকে বলেন যে, সিনেটর লেহি’র প্রণীত আইনের কারণে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাবকে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিতে অপারগ থাকছে।
কারণ র্যাবের বিরুদ্ধে কথিত মতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। র্যাবের কর্মকর্তারা যদিও তাদের আশ্বস্ত করেন যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি অধুনা তারা তাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই কেবল থেকে অবশ্য দেখা যায়, ২০০৮ সালে মরিয়ার্টি জানতেন যে, বৃটিশরা র্যাবকে মানবাধিকার বিষয়ে অন্তত একটি প্রশিক্ষণ দানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে তখন পর্যন্ত তা ছিল পরীক্ষামূলক। এটা ছিল পাইলট প্রকল্প।
মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়, দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণের আগে বৃটিশ সরকার ঘনিষ্ঠভাবে তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রভাব র্যাবের ওপর কতটা কি পড়লো, তা তারা যাচাই করে নেবে।
একটি কেবল থেকে দেখা যায়, মরিয়ার্টি বৃটিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছেন, তারা ১৮ মাস ধরে ‘জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল এবং রুলস অব এনগেজমেন্ট’ বিষয়ে র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বৃটিশ ফরেন অফিসের সঙ্গে গার্ডিয়ান পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। বৃটিশ ফরেন অফিস এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন মন্তব্য না করে বলেছে, তারা বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার বিষয়ক সহায়তা দিয়েছেন। র্যাবের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান মেজবাহ উদ্দিন গার্ডিয়ানকে বলেছেন, গত গ্রীষ্মে তিনি তার পদে বহাল হন।
সেই সময় থেকে এপর্যন্ত কোন ধরনের মানবাধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ হয়েছে বলে তার জানা নেই।
গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবলগুলো থেকে স্পষ্ট যে, তিন বছর আগে বিগত লেবার সরকারের আমলে র্যাবকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়।
মাদরাসা শিক্ষা: পৃথক অন্য একটি কেবলে দেখা যায়, জেমস মরিয়ার্টি ঢাকার বৃটিশ হাইকমিশনের সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন নিয়ে কথা বলেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তারা বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। জেমস মরিয়ার্টির কথায় প্রকাশ পায় যে, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কর্মপরিকল্পনার আওতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘অনিয়ন্ত্রিত মাদরাসাগুলোতে একটি মানসম্মত পাঠ্যসূচি’ চালু করতে রাজি করাতে তারা সচেষ্ট হবেন।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণে হাজার হাজার মাদরাসার কারিকুলাম পরিবর্তনে বৃটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইড মাদরাসা ‘পাঠ্যসূচি উন্নয়ন কর্মসূচি’র প্রস্তাব দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ফুলবাড়ী প্রকল্প:মরিয়ার্টি গত বছর জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টাকে বলেছেন, ‘ওপেন-পিট মাইনিং’ ব্যবস্থাই সবচেয়ে উত্তম। মরিয়ার্টি তার কেবলে নোট দেন যে, ফুলবাড়ী প্রকল্পের পেছনে থাকা এশিয়া এনার্জিতে ৬০ ভাগ মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে। রাষ্ট্রদূত সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সামনের মাসগুলোতে ওই প্রকল্পের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জ্বালানি উপদেষ্টার বরাতে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে অনগ্রসর ও দারিদ্রপীড়িত উপজাতিদের বসবাস। সেকারণে কয়লার খনি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। অবশ্য মরিয়ার্টির বক্তব্য অনুযায়ী ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি একমত হন। তবে সেটা করতে হবে সংসদীয় প্রক্রিয়ায়।
গার্ডিয়ান লিখেছে, জিসিএম চেয়ারম্যান স্টিভ বাইওয়াটার চলতি মাসের গোড়ায় বলেছেন, বাংলাদেশের একটি সংসদীয় কমিটি ওপেন-পিট পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।