নাজমুল ইসলাম মকবুল
নাজমুল ইসলাম মকবুল
স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বিশ্বনাথে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিবর্গের তালিকা আজও প্রণয়ন করা হয়নি। ইতোপূর্বে বহুবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংযোজন বিয়োজন পরিমার্জন পরিবর্ধন করা হলেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও সেসময়ে আত্মদানকারীদের কোন নাম নিশানা আজ পর্যন্ত কোথাও লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি। অথচ তাদের মহান আত্মত্যাগের ফলেই বিজয় সুচিত হয়েছিল। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বনাথ উপজেলাবাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসী বিশ্বনাথীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীণ প্রবাসীরা কষ্টার্জিত অর্থ প্রেরণ করে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিলেন। ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় বিশ্বনাথের কয়েকজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ তাদের সহায়তাকারী প্রায় বিশজন স্বাধীনতাকামী নাগরিক দেশ মাতৃকার লড়াইয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তন্মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সুলেমান (শহীদ সুলেমান নগর), শহীদ শামছুল হক, শহীদ আব্দুল আহাদ (বাওনপুর) শহীদ দীগেন্দ্র কুমার দাশ (বাবুনগর)। জীবন উৎসর্গকারীরা হলেন ধীরেন্দ্র কুমার দাশ, বমকেশ দেব, নারায়ন সেন, জীতেন্দ্র দাশ, বসন্ত কুমার দাশ, সুরুজ আলী, নৃপেন্দ্র কুমার দাশ, আয়ূব আলী সহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও প্রায় দশজন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ পাক হানাদার বাহিণীর হাতে নির্মমভাবে নিহত দেশ প্রেমিক স্বজন সহযোদ্ধাদের স্মৃতি আজও চেতনায় উজ্জ্বল উদ্ভাসিত।
পরিবার পরিজনদের স্বজন হারানোর করুন আর্তি আজও গুমরে উঠে বার বার। বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের অদুরে হরিকলস বাবুর বাড়ী প্রকাশিত সেনারগাও নিবাসী নিহত বমকেশ দেবের পরিবার পরিজনের খোজ কেউ নেয়নি আজও। তাঁর বিধবা স্ত্রী আজ মৃত্যুপথযাত্রী। সিলেট শহরস্থ তার এক আত্মীয়ের বাসায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে বসবাস করছেন।
ধীরেন্দ্র কুমার দাশ বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে ব্যবসা করতেন।
পাক সেনারা তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর বিধবা স্ত্রীকে আজ পর্যন্ত কেহ কোন শান্তনা দেননি কিংবা খোজখবর নেননি। প্রতিবন্ধি এক পুত্র সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত কষ্টে জীবন যাপন করছেন। অনুরূপভাবে নিহত অন্যান্য সহযোদ্ধাদের পরিবার পরিজনদেরও খোজ খবর নেয়া হয়নি।
বিশ্বনাথের গর্ব শহীদ সুলেমান সম্পর্কে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে ‘যুদ্ধ তখনও চলছিল, বাংলার ভাগ্যাকাশে লাল সুর্য তখন উদিত হয়নি। দেশ মাতৃকার সবুজের বুকে লাল সুর্য পতাকা ছিনিয়ে আনতে সোলেমানের মত দুঃসাহসী ছেলেরা জন্ম নিয়েছিল বলেই মাত্র নয় মাসের রক্তয়ী যুদ্ধে বাংলার মাটিকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এক সোলেমান নয়, এমনিভাবে বহু বহু সোলেমান ঘটনায়, দুর্ঘটনায় দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্য, আদর্শ পরিকল্পনা ছিল অতীব মহৎ। এদেশ স্বাধীন হবে, স্বাধীন দেশের হবে একটা স্বাধীন পতাকা, থাকবে গণতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেতা, সবার জন্য হবে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান।
’
এ প্রসঙ্গে সিলেট-২ আসনের এমপি আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট অর্জন। এই অর্জনকে যথাযথ মর্যাদায় ধরে রাখতে হবে অনন্তকাল ব্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের এই অবিনাশী যুগসন্ধিণকে অমর অমলিন অব্যয় করে রাখতে হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায়। তিনি বলেন বিশ্বনাথ ও জগন্নাথপুর উপজেলার সীমান্ত রেখায় শ্রীরামশী নামক স্থানে সংগঠিত বধ্যভুমির স্মৃতিকে লালন ও ধারন করার অংশ হিসেবে বিশ্বনাথের করচাখেলী গ্রামে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ আমাদের পরিবার পরিজন নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন হানাদার বাহিনীর দোসরদের রোষানলে পড়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেবার কারনে প্রায় ৮০/৮৫টি অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছিল আমাদের বিরুদ্ধে। সঙ্গত কারনে চান্দভরাং গ্রামটি ছিলো বৈশিষ্ঠ্যপুর্ণ। তিনি বলেন মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি এলাকায় থেকে নানাভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং নিজে নৌকা বেয়ে তথ্য আদান প্রদানে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন’।
এবিষয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক আহবায়ক, বর্তমান নির্বাচিত উপজেলা কমান্ডের কার্যনির্বাহী সদস্য সাপ্তাহিক অনুপম সম্পাদক মোঃ মনির উদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রেকর্ডপত্রে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ বিশ্বনাথ উপজেলার কোথাও কোন গণহত্যার খবর পাওয়া যায়নি।
তবে বিপ্তি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হয়তোবা পরিস্থিতির নির্মম শিকার হয়ে আরো অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন।
এব্যাপারে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিশ্বনাথ উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুল মালিক বলেন বিশ্বনাথের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তিনজনের নাম রয়েছে তারা হলেন শহীদ সুলেমান, শহীদ আব্দুল আহাদ, শহীদ শামছুল হক।
শহীদ সুলেমানের সহোদর বুরহান হোসেন বলেন শহীদ সুলেমানকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান এবং বিশ্বনাথের কোন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা কিংবা রাস্তাঘাটের নামকরণের মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চিরঞ্জীব করে রাখা এখন সময়ের দাবী। সেেেত্র তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরীর ভুমিকাসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
উল্লেখ্য বিশ্বনাথে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসহ যুদ্ধকালীণ আহত নিহতদের বিবরন জানার জন্য ভারতের উত্তর ত্রিপুরার কৈলাসহর থেকে প্রকাশিত একসময়ের হবিগঞ্জ জেলার অধিবাসী সাংবাদিক কলামিষ্ট মোহিত পাল সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট ও পশ্চাৎভূমি কৈলাসহর’ গ্রন্থ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদনে সংযোজন করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।