আমি খুবই Innocent...!!!
আপেল মাহমুদ
দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশের কলসেন্টার খাত। আউট সোর্সিং ডেস্টিনেশন হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব, গুণগত এজেন্ট, ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অভাব, নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ এবং বিদ্যুতের অভাবের কারণে সেক্টরটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় পরিকল্পনার অভাবে অনেক কলসেন্টার চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। ভারত ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশ এই শিল্পে উন্নতি সাধন করে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ এ খাতে কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। শুরুতে ৪২৬টি কল সেন্টারকে লাইসেন্স প্রদান করা হলেও বর্তমানে মাত্র ৬০টি চালু আছে বলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন(বিটিআরসি) ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কলসেন্টার এন্ড আাউটসোসিং (বাকো) দাবি করেছে তবে সরজমিনে মোট ২৬টি কলসেন্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
জানা যায়, বিনিয়োগকারীরা এ খাতে ২শ থেকে ৩শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আটকে গেছে। তারা এখন হতাশ।
বাতিল হচ্ছে ২৮৫টি লাইসেন্স
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কলসেন্টার, হোস্টেড কলসেন্টার ও হোস্টেড কলসেন্টার সার্ভিস প্রোভাইডার এই তিন ক্যাটাগরিতে ৪২৬টি কল সেন্টারের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
এর কিছুদিন পর ৪৮টি কল সেন্টারের উদ্যোক্তা নিজেদের লাইসেন্স প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া সরকার চারটি লাইসেন্স বাতিল করেছে। ৩৩৭টি লাইসেন্স এখন অকার্যকর অবস্থায় পরে আছে। বর্তমানে ২৮৫টি লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কসমিকা কলসেন্টারের চেয়ারম্যান সৈয়দ শাহিন সৈকত জানান, শুরুতে লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটাই ঠিক ছিল না।
এক ধরনের হুজুগের মধ্যে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এখন বিটিআরসি মনে করছে, কলসেন্টার করে উদ্যোক্তারা খারাপ কাজ করবে তাই লাইসেন্স কেড়ে নিচ্ছে। টিসিআরএল কলসেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিকদার এম জাকির বলেন, লাইসেন্স বাতিল করার ফলে অনেক উদ্যোক্তা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিটিআরসি যদি কারো লাইসেন্স বাতিল করতে চায় তাহলে অফিসিয়ালি বাতিল করুক।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, লাইসেন্স দেওয়ার সময় শর্ত দেওয়া হয়েছিল ছয় মাসের মধ্যে কল সেন্টার চালু করতে হবে।
কিন্তু যারা ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কলসেন্টার চালু করতে পারেনি তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, কেউ যদি মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করে তাহলে তা ভেবে দেখা হবে।
নতুন লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রেও বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করছে বিটিআরসি। শুধু আবেদন করলেই নয় আসলে তার কলসেন্টার খোলার যোগ্যতা আছে কিনা সেদিকগুলোও যাচাই বাছাই শেষ করে লাইসেন্স প্রদান করছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগের সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, একসাথে তিনশ’র অধিক লাইসেন্স দেওয়া হয় অথচ এখন অধিকাংশ লাইসেন্সই বাতিল হচ্ছে।
সম্ভব হচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
কলসেন্টারের যাত্রাকালে বলা হয়েছিল তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়ের তুলনায় কল সেন্টারে আয় বেশি হবে। প্রাথমিকভাবে এখাতে বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর এক শতাংশও অর্জিত হয়নি। অথচ আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত কলসেন্টার খাত থেকে বছরে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। দেশের কয়েকজন কলসেন্টার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বাংলাদেশ কলসেন্টার মার্কেটে অল্প কিছুদিন আগে ঢুকেছে।
তাই এখন পর্যন্ত বাজার সৃষ্টি হয়নি। তবে অল্পদিনের মধ্যে এ বাজার সৃষ্টি হবে বলে তারা আশা করেন। তারা আরো মনে করেন যদি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে কলসেন্টারের ব্যবসা ধরা যায় তাহলে এ সেক্টর থেকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্পকিত প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানীর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১০ সালের শেষ নাগাদ সারা বিশ্বে বিজনেস প্রসেস আউটসোসিং বানিজ্যের পরিমান দাাঁড়াবে ১৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে শীর্ষে থাকবে ভারত।
বাংলাদেশ যদি এই বাজারের একটি অংশ অর্জন করতে পারে তাহলে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ এই খাতের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে।
নেই কলসেন্টার ভিলেজ
বাংলাদেশের অধিকাংশ কলসেন্টার ঢাকার ভেতরে অবস্থিত। ঢাকা ছাড়া রাজশাহী, সিলেট ও চট্টগ্রামে বাকিগুলোর অবস্থান হলেও সবগুলো রয়েছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। ফলে কলসেন্টারগুলো লাভের মুখ দেখছে না। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং থেকে জানান হয়, একটি কলসেন্টার ভিলেজ থাকলে দ্রুত এই সেক্টর উন্নতি করতে পারবে।
তবে সেই ভিলেজে কলসেন্টার বান্ধব সব ধরনের আধুনিক যোগাযোগ ও সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, দেশের সম্ভাবনাময় শিল্পক্ষেত্র হিসাবে কলসেন্টারগুলোকে এক জায়গায় এনে কলসেন্টার ভিলেজ গড়ে তোলার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
অনুমোদনের অপেক্ষায় ঋণ সুবিধা নীতিমালা
ঋণ সম্পর্কিত নীতিমালা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এক বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন কলসেন্টার এই ঋণ সহায়তা পাবে। এই সুবিধা পেতে হলে কনসেন্টারের ২০ শতাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কম্পিউটার বিজ্ঞান বা আইটি ডিগ্রি বা স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা থাকতে হবে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইটি তহবিল নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে কলসেন্টার খাতকে এই ঋণের আওত্তাভুক্ত করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আইটি শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকার একটি আইটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আইটি খাতের ২০০কোটি টাকার তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তহবিল বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখাশোনা করছে।
কলসেন্টার ভিলেজ গড়ে তোলা হবে
হাসানুল হক ইনু
সভাপতি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সম্পকিত স্থায়ী কমিটির
বাংলাদেশে কলসেন্টারগুলো এগোতে পারছেনা, কারণ এগুলোর রয়েছে অবকাঠামোগত সংকটই এবং দক্ষ জনবলের অভাব ও প্রশিক্ষণের সমস্যা।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কলসেন্টার ভিলেজ গড়ে তোলার সুপারিশ করেছি। সেখানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে। ২ থেকে ৪ মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হবে। বর্তমানে ৬১টি কলসেন্টারে ছয় হাজার জনবল কাজ করছে। প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তারা তা জানে না।
এক্ষেত্রে বিটিআরসি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে পারে। বর্তমানে যে সব প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের কলসেন্টার একটি সম্ভাবনার দিকে যাবে।
কলসেন্টার কি?
কলসেন্টার হচ্ছে একটি কেন্দ্রীভূত অফিস যা বিশাল সংখ্যক কল রিসিভ এবং ট্রান্সমিশনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। কলসেন্টার অপারেশন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয় যেখানে ইনকামিং প্রোডাক্ট সার্ভিস সাপোর্ট অথবা কনজ্যুমারদের যেকোন অনুসন্ধানের তথ্য সরবরাহ করা হয়। টেলিমার্কেটিং এর জন্য আউটগোয়িং কল, প্রোডাক্ট সার্ভিস, বকেয়া বিল সংগ্রহ, ফ্যাক্স, লাইভ চ্যাট এবং ইমেইল সংক্রান্ত কার্যাবলিও কলসেন্টারে সম্পাদিত হয়ে থাকে।
অধিকাশ বড় প্রতিষ্ঠানই কাস্টমারদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কলসেন্টার সেবা পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের কলসেন্টার পরিচালনার দায়িত্ব কোনো তৃতীয় পক্ষকে দেয় যারা নিজেদের অবকাঠামো এবং জনবল দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। কাস্টমারের সঙ্গে ফিজিক্যাল যোগাযোগ না থাকায় কলসেন্টারের ভৌগলিক অবস্থানগত ব্যাপারটি কোনো সমস্যা নয়। আর তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টারগুলো ভারত, চীন এবং ফিলিপাইনের মত দেশগুলো হতে পরিচালিত হচ্ছে। এসব দেশের খরচ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম হওয়ায় উন্নত দেশগুলো তাদের কলসেন্টার কার্যক্রম আউটসোর্সিং করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আর এখানেই বাংলাদেশের আশার কথা। বাংলাদেশি ইংরেজি জানা তরম্ননদের উচ্চারণ স্টাইল ভারত, ফিলিপাইন এবং চীনের কলসেন্টার এজেন্টদের চাইতে উন্নত হওয়ায় এবং খরচের পরিমাণ সেসব দেশের তুলনায় কম হওয়ায় বাংলাদেশে কল সেন্টার শিল্পের সম্ভাবনা অনেক উজ্জল বলে ধারণা করছেন দেশের আইটির বিশেষজ্ঞগন। কলসেন্টারের মাধ্যমে দেশে বড় ধরণের চকুরির সুযোগ গড়ে উঠেছে। প্রতিটি কলসেন্টারে তিনটি ভাগ রয়েছে, প্রথম ভাগকে বলা হয় জুনিয়র লেভেল যেখানে বেতন ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার। এরপর আছে মিড লেভেল যেখানে বেতন ১৫ থেকে ৩০ হাজার এবং শেষ পর্যায়ে আছে টপ লেভেল যেখানে বেতন ৩০ থেকে ২ লাখ পর্যন্ত।
কলসেন্টারের ধরন
কন্টাক্ট সেন্টার: এই ধরনের কলসেন্টারের মাধ্যমে কাস্টমারদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সাপোর্ট প্রদান করা হয়। টেলিফোন, ইমেইল এবং ইন্টারনেট চ্যাটসহ আরও অনেকগুলো যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়।
ইনবাউন্ড কলসেন্টার: এই ধরনের কল সেন্টারের সাধারনত কাস্টমারগন ফোন করে বিভিন্ন তথ্যের অনুসন্ধান করে থাকেন এবং কলসেন্টার এজেন্টগন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে থাকেন।
আউটবাউন্ড কলসেন্টার: এখানে কলসেন্টার এজেন্টগণ কাস্টমারদের কাছে আউটবাউন্ড কল করে থাকেন। সাধারণত কোনো প্রোডাক্টের অফার সম্পর্কে সম্ভাব্য কাস্টমারদেরকে তথ্য দিয়ে তা বিক্রয় করাই থাকে মূল লক্ষ্য।
এই প্রক্রিয়ার পন্য বিক্রয় করতে পারলে সংশ্লিষ্ট কলসেন্টার নির্দিষ্ট পরিমান কমিশন পেয়ে থাকে।
ডাটা এন্ট্রি: ডাটা এন্ট্রির সাথে অনেকেই কমবেশি পরিচিত। এসব কলসেন্টার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইমেইল নোটিফিকেশন এবং স্ট্যাটাস আপডেট সংক্রান্ত কাজ সমূহ করে থাকে।
পেমেন্ট পাচ্ছে না কলসেন্টার
দেশের বাইরে যে সব কোম্পানির সঙ্গে দেশের কলসেন্টার কাজ করছে তাদের বেশিভাগই কাজ শেষ হলেও পেমেন্ট পাচ্ছে না। ফলে অনেক কলসেন্টার হাতাশার মধ্যে কাজ করছে।
অনেকে আবার বাধ্য হচ্ছে কলসেন্টার বন্ধ করে দিতে। বিদেশী কোম্পানিগুলো সামান্য কিছু পেমেন্ট দিয়ে কাজ শুরু করলেও মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এটিএন কলসেন্টারের পরিচালক আবদুল মাননান বলেন, গত কয়েক মাস হলো বিদেশি কোম্পানিগুলো কোনো পেমেন্ট করছেনা। অধিকাংশ কোম্পানি মাত্র দুই ভাগ টাকা দিলেও বাকি টাকা দেওয়ার কোন নাম নাই। লন্ডনে অবস্থিত ভারতের সেনারবি’র সঙ্গে কাজ করেছি, তারা কোন টাকা দেয়নি।
আমেরিকার ৪টি কোম্পানির সাথে ৬ মাস কাজ করেছি কিন্তু কোনো বিল তারা পরিশোধ করেনি। শুরুতে ১০ ভাগ টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেছে কিন্তু বাকি টাকার কথা বললে তারা কোন উত্তর দেয় না। আগে সাপ্তাহিক কনফারমেশন রির্পোট দিলেও এখন তারা কোন যোগাযোগ করে না। আরো কয়েকটি কলসেন্টারের কর্তৃপক্ষ বিটিআরসি আমাদের কাজের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে ফলে আমাদের কাজের কোয়ালিটি খারাপ হচ্ছে, আর এই সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো আমাদের পেমেন্ট আটকে দিচ্ছে। তারা আরো বলেন বাংলাদেরশর এমন কোন কলসেন্টার নেই যাদের টাকা আটকে নেই।
ইন্টারনেট সংযোগে ভোগান্তি
ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া কলসেন্টার অচল কিন্তু সেই সংযোগের ক্ষেত্রে সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মাত্র ৫ হাজার টাকায় কলসেন্টার লাইসেন্স পাওয়া গেলেও পাওয়া যাচ্ছেনা ইন্টারনেট সংযোগ। আর এ ক্ষেত্রে বিটিআরসি একধরণের জটিলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। বিটিআসি নিয়ম অনুসারে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে হলে প্রথমে কাজের অর্ডার পারমিশন কপি দেখাতে হবে। কপিটি বিটিআরসি যাচাই বাছাই করে যদি মনে করে এই কোম্পনিকে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যাবে তবে তাকে সংযোগ দেবে।
কিন্তু কলসেন্টারগুলোর বক্তব্য যদি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকে তাহলে ক্লায়েন্ট কেন কাজের অর্ডার দেবে? বিদেশি বক্তব্য, প্রথমে আমাদের কাজের কোয়ালিটি দেখে এর পর কাজের অর্ডার দেয় কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে আমরা এগোতে পাচ্ছিনা। কসমিক কলসেন্টার থেকে বলা হয় ইন্টারনেট সংযোগ পেতে হলে বিটিআরসি এর যে সব শত পূরণ করা দরকার তার সবটাই আমরা পূরণ করেছি কিন্তু তার পরেও আমাদেরকে সংযোগ দেওয়া হচ্ছেনা। কসমিকসহ আরো কয়েকটি কলসেন্টার মালিকের দাবি সংযোগ না দেওয়ার ফলে প্রায় প্রত্যেকে ৪থেকে ৫টি কোম্পানির কাজ হাতে পেয়েও শুরু করতে পারেনি। বিটিআরসি সূত্র জানায়, কাজের অর্ডার পেতে হলে ইন্টারনেট সংযোগের দরকার নাই। দেশে প্রচলিত অন্যান্য সংযেগের মাধ্যমে কাজের অর্ডার পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু কলসেন্টার ব্যবসায়িদের দাবি এতে ভয়েস কোয়ালিটি খারাপ হয় ফলে কেউ সহজে কাজের অর্ডার দিতে চায়না।
ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে অনেক মালিক কলসেন্টার চালু করতে পাচ্ছে না। বিটিআরসি থেকে বলা হচ্ছে লাইসেন্স নেয়ার ছয় মাসের মধ্যে কলসেন্টার চালু না করলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে আবার কলসেন্টার থেকে ইন্টারনেট সংযোগও দেওয়া হচ্ছেনা ফলে একেরপর এক লাইসেন্স বাতিল হচ্ছে বলে বাকো সূত্রে জানা যায়।
দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও বিটিএস কমিনিউকেশনের মালিক বিটিআরসি থেকে ইন্টারনেট সংযোগ না পেয়ে ভারতে চলে গেছেন। সেখানে সংযোগ পেতে কোন ঝামেলা না হওয়ার কারণে তিনদিনের মধ্যে পুরোদমে ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি।
তার মতো আরো অনেকে আছেন যারা লাইসেন্স নিলেও সংযোগ ভোগান্তির কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। কিছু কলসেন্টার ইন্টারনেট সংযোগ পেলেও তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে। ইকরা কলসেন্টার থেকে জনান হয়, বিটিআরসি’র নিদ্দিষ্ট কিছু লোকের অবহেলার কারণে লাইসেন্স পেয়েও বাতিল করা হয়েছে।
ডাউন ব্যান্ডউইথ
নিরবিচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ না থাকার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কলসেন্টার ব্যবসা। প্রতি মাসে প্রায় ৩ থেকে ৪ বার ব্যান্ডউইথ লিংক ডাউন থাকার কারণে ভয়েস কোয়ালিটি খারাপ হচ্ছে।
ধীরগতির কারণে লোডিং হতে অনেক সময় নেয় ফলে ডায়াল করতে অনেক সময় লাগছে। ডাউন ব্যান্ডউথের কারণে প্রায়ই বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে থেকে অভিয়োগ শুনতে হয় বলে কলসেন্টার ব্যবসায়িদের দাবি। কলসেন্টার এজেন্ট নাজমুল জানান, যখন ভাল ব্যান্ডউইথ পাওয়া যায় তখন সহজে যেকোন জায়গায় যোগাযোগ করা যায় কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় ডাউন ব্যান্ডউইথের কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অথবা দেখা যায় কথা ঠিকভাবে শোনা যাচ্ছেনা। এতে আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ শুনতে হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য ব্যান্ডউইডথ ক্যাপাসিটি ৪৪.৬ এনঢ়ং, তার মধ্যে মাত্র ৮ এনঢ়ং ব্যান্ডউইডথ সারাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের চাহিদা পূরনের পরও ৩৬.৬ এনঢ়ং ব্যান্ডউইডথ অব্যবহৃত রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে আগামী ৫ বছর পর্যন্ত সারাদেশের চাহিদা নিরূপন করা হয়েছে ৩৭.০৭৫ এনঢ়ং। তারপরও উদ্বৃত্ত থাকবে ৭.৫২৫ এনঢ়ং। কিন্তু তারপরেও নিরবিচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ পাওয়া যাচ্ছেনা।
একমাত্র সাবমেরিন ক্যাবল
২০০৭ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হলেও এটি বাংলাদেশের একমাত্র সাবমেরিন ক্যাবল।
ভারত যেখানে ৫টি সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে সেখানে দেশে রয়েছে মাত্র একটি লাইন। বছরে বিভিন্ন সময় লাইনটি বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ক্ষতি গুনতে হয় কলসেন্টার ব্যসায়িদের। কারণ কোনো কারণে লাইনটি বিচ্ছিন্ন থাকলে বিকল্প আর কোন পদ্ধতি থাকে না। বাকো’র সদস্যরা জানান, সরকার ইচ্ছা করলে মংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে আরো একটি সাবমেরিন ক্যাবলের লাইন আনতে পারে যা বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। তবে পাশাপাশি কলসেন্টার ব্যবসায়িরা এটাও দাবি করেন, সাবমেরিন ক্যাবলের পাশাপাশি সরকার যদি ভিস্যাট ব্যবহারে অনুমতি দিলে অনেক বেশি ভাল হবে।
সাবমেরিন ক্যাবল যদি কোনো ঝামেলা করে তাহলে যে কেউ বিকল্প হিসেবে ভিস্যাট ব্যবহার করতে পারবে। তাছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশে ভিস্যাট সংযোগ আছে।
মেলার ফলাফল শূন্য
বাংলাদেশে কলসেন্টার যাত্রা শুরু করার পর দেশের বাইরে দুইবার মেলা করে কিন্তু দুটি মেলার ফলাফল শূন্য। এক টাকার কাজের অর্ডারও আজ পর্যন্ত মেলেনি মেলা সূত্রে। বাংলাদেশের মূল বাজার আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া হলেও প্রতিবারের মতো এবারও ইংল্যান্ডের বামিংহামে করা হচ্ছে মেলা।
ইকরা কলসেন্টার থেকে বলা হয় প্রতি বছর বিটিআরসি এক থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ করছে কিন্তু কোনো ভাল রেজাল্ট আসছে না। আমরা যদি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মেলা করি তাহলে আমরা কাজ পাব কিন্তু বিটিআরসি কোনো এটা করছে বোঝা যাচ্ছে না। সময় এখন মধ্যপ্রচ্যর বাজার ধরা কিন্তু পুরো বাজার মিসর দখল করে রেখেছে। এখানে মেলা করতে পারলে একটি বড় বাজার ধরা যাবে বলে এই কলসেন্টার থেকে জানান হয়। একটি সূত্র জানায় বিটিআরসি কর্মকর্তারা একটা কমিশন পায়, যদি অন্যকোন দেশে মেলার আয়োজন করে তাহলে এই কমিশন পাবে না।
গত দুই বছরে সাতটি কলসেন্টার মেলায় অংশগ্রহন করে এবং তারা প্রত্যকে কাজ পেয়েছে এমন দাবি বিটিআরসি’র সহকারি পরিচালক করলেও এখন পর্যন্ত এমন কোন কলসেন্টার বলতে পারেনি তারা কাজ পেয়েছে।
নেই দক্ষজনবল
কলসেন্টারের মূল পুঁজি হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি জানা ব্যক্তিরাই এখানে কাজ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে দক্ষ বা ইংরেজি জানা ব্যক্তির অভাবে কলসেন্টার দাঁড়াতে পাচ্ছে না। বর্তমানে কলসেন্টারগুলোর মূল টার্গেট ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থী।
কিন্তু তাদের মধ্যে সামান্য কিছু শিক্ষাথী এ পেশায় আগ্রহ দেখালেও অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার যারা আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা অল্প বেতনের কারণে অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থী আহমেদ জুয়েল মনে করেন দেশে না থেকে বিদেশে চাকরি ও পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া ভালো, কারণ এখানে অধিক শ্রম, কম টাকার চেয়ে বিদেশে অল্প শ্রমে বেশি টাকা রোজগার সম্ভব। টাইমস এএসএল কল সেন্টারের চেয়ারম্যান বলেন, ইংরজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা শেষ করে দেশের বাইরে যেত কিন্তু বর্তমানে আমরা চেষ্টা করছি দেশেই তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে। বিটিআরসি-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঢাকার ভেতরে যদি দক্ষ জনবল পাওয়া না যায় তাহলে ঢাকার বাইরে থেকে ব্যবস্থা করতে হবে, এতে অল্প টাকায় দক্ষ জনবলের সংস্থান করা সম্ভব হবে।
টেলিমেডিসিন রেফারেন্স সেন্টারের সিইও বলেন, দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়ে ইংরজি ভুলে গেছে। ফলে ইংরেজিতে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সান ইনফো টেক কলসেন্টার থেকে জানান হয়, যারা আলু-পোটলের ব্যবসা করতো বিটিআরসি তাদেরকে লাইসেন্স দিয়েছে। এদের মধ্যে ইংরেজি জ্ঞান না থাকায় সঠিক লোক নিয়োগ দিতে পারছেনা। এছাড়া এসব কলসেন্টার নিজেদের অদক্ষ আত্বীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে কলসেন্টারগুলো দাঁড়াতে পারছেনা।
সান ইনফো কলসেন্টারের কোয়ালিট কন্ট্রোলার শেখ সাফায়াত জানান, আমাদের দেশে কোন রিত্রুটিং এজেন্সি নেই ফলে সঠিক লোক বাছাই হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের কলসেন্টারগুলো বিডি জবস সহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞাপন দেয় কিন্তু সেখান থেকে কোন লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অথবা বিট্রিশ কাউন্সিল সহ বিভিন্ন জায়গায় ভাল রেজাল্ট করেছে তাদেরকে নিয়োগ দিতে পারলে বাংলাদেশের কলসেন্টার দাঁড়াতে পারবে। এটিএন কলসেন্টারের পরিচালক আবদুল মাননানও দক্ষ জনবলের অভাবের কথা স্বীকার করেন।
কলসেন্টারগুলো নিজস্ব উদ্যোগে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করলেও বিটিআরসি থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
আবার ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করলেও প্রতিটি এজেন্টদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে এজেন্টরা অভিযোগ করেন।
দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত
কলসেন্টারগুলোতে বিদ্যুত ঘাটতি এখন অন্যতম বড় সমস্য। এক ঘন্টা বিদ্যুত থাকলে দুই ঘন্টা বিদ্যুত থাকে না। ফলে অনেক কলসেন্টারকে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কয়েকটি কলসেন্টারের চেয়ারম্যান জানান, জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাদেরকে প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।
এ ছাড়া কম ভোল্টেজের কারনে এই সময় কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তারা আরো জানান,তাদেরকে দুটি শিফটে কাজ করতে হয় একটি বিকাল ৩টা থেকে রাঁত ১১টা এবং অন্যটি রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং দেখা যায়। কলসেন্টারের চেয়ারম্যানরা আলাদা বিদ্যুত সংযোগের দাবি করেন যেখানে চব্বিশ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাওয়া সম্ভব হবে।
লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।