আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বীরশ্রেষ্ঠ: রুহুল আমিন (১৯৩৪-১৯৭১)

আমি তোমাদেরই একজন, খুবই সাধারণ !!!
ছবি:- বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন (১৯৩৪-১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসীকতার জন্য যে ৭ জন শহীদকে বাংলাদেশ সরকার বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করেছেন তাদের নিয়ে আমার ৭ পর্বের ধারাবাহিক পোষ্টের আজ ২য় পর্ব বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনকে নিয়ে। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পরিচিতি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের জুন মাসে নোয়াখালী জেলার সাবেক বেগমগঞ্জ থানার বর্তমানে সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাদুরা বর্তমান নাম আমিননগরে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷তাঁর পিতার নাম মোঃ আজহার পাটোয়ারী এবং মায়ের নাম মোছাঃ জুলেখা খাতুন৷ তিনি ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। খুব অমায়িক ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন এই বীরশ্রেষ্ঠ৷ ভালোবাসতেন দেশ, দেশের মাটি আর দিগন্তবিস্তারী সমুদ্র৷তাই বেছে নিয়েছিলেন নৌবাহিনীর চাকুরী। পড়ালেখার শুরু করেন নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে৷ হাইস্কুলে পড়তে হয় পার্শবর্তী থানার আমিষাপাড়ায়৷ প্রথম দিকে তাঁদের সংসারে অভাব-অনটনের ছোঁয়া না লাগলেও ছেলেমেয়ে বড় হতে হতে পরিবারে দেখা দেয় অসচ্ছলতা৷ তাই হাইস্কুল পাস করার পরই রুহুল আমিনকে জীবিকার সন্ধানে বের হতে হয়৷ পরিবারে পিতাকে সাহায্য করার মানসে ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন জুনিয়র মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তত্কালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে৷ চাকরি হবার পরই শুরু হয় প্রশিক্ষণ৷ প্রথমেই তাঁকে যেতে হয় করাচির অদূরে আবর সাগরের মধ্যে অবস্থিত মনোরা দ্বীপে পিএমএস বাহাদুর-এ৷ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে তিনি যোন দেন পিএনএস কারসাজে অর্থাৎ নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে৷ ১৯৫৮ সালে শেষ হয় তাঁর পেশাগত প্রশিক্ষণ৷ ১৯৬৫ সালে তিনি নির্বাচিত হন মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য এবং পিএনএস কোর্স সমাপ্তির পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন৷ ১৯৬৮ সালে তিনি বদলি হন চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে৷ ১৯৭১ সালের মার্চে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বর্বরতম ঘটনার সময় রুহুল আমিন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন৷ নৌঘাঁটিতে বসে বসে শুনেছেন নির্দয়ভাবে তাঁর স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের হত্যার খবর৷ শুনেছেন আর ফুঁসে ওঠেছেন৷ মনে মনে নিজেকে তৈরি করেছেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য৷ দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে কিভাবে নিজেকে যুক্ত করা যায় সে পথ খুঁজছেন৷ কিন্তু নৌঘাঁটিতে বসে তা সম্ভব নয়৷ সুতরাং সবার আগে এখান থেকে বের হতে হবে৷ বাঙালি সৈনিকরা তখন পাকিস্তানি সেনাদের চবি্বশ ঘন্টা নজরদারীর মধ্যে৷ এখান থেকে বের হওয়াও তো চাট্টিখানি কথা নয়৷ তিনি মনে মনে পালানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন৷ এবং একদিন সবার অলক্ষ্যে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে পড়েন নৌঘাঁটি থেকে৷ পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে তিনি চলে যান ত্রিপুরা৷ যোগ দেন ২ নং সেক্টরে৷ মেজর শফিউল্লাহ্র নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরে তিনি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং স্থলযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দেন৷ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়৷ এ উদ্দেশে নৌবাহিনীর সদস্যদের যাঁরা বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন তাঁদেরকে সেপ্টেম্বর মাসে একত্রিত করা হয় আগরতলায় এবং গঠন করা হয় ১০ নং সেক্টর৷ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্রিত হয়ে কলকাতায় আসেন এবং যোগ দেন ১০ নং নৌ সেক্টরে৷ ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ পলাশ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে এক 'ভুল বোঝাবুঝির যুদ্ধে' গোলার আঘাতে শহীদ হন আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন৷ যুদ্ধে তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷তিনি যে ভাবে শহীদ হন- ছবি:- বাংলাদেশের গৌরব ৭ বীরশ্রেষ্ঠ। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর৷ মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা অসম বিক্রমে দখল করে নেন যশোর সেনানিবাস৷ এর পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে ধরা হলো মংলা বন্দরকে হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করা৷ মংলা বন্দরে পাকিস্তান বাহিনীর দখলকৃত নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখল তাঁদের পরবর্তী উদ্দেশ্য৷ ৯ ডিসেম্বর, রাত৷ বাধাহীনভাবেই গানবোটগুলো সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টে অবস্থান করে৷ সেখানে রাতযাপনের পর ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে যাত্রা করে মংলা বন্দরের দিকে৷ কোনোরকম প্রতিরোধ ব্যতীতই তিনটি রণতরী পৌঁছে গেল মংলা বন্দরে৷ সকাল তখন সাড়ে সাতটা৷ মংলা বন্দরেই থেকে গেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী পেট্রলক্রাস্ট 'চিত্রাঙ্গদা'। শুরু হলো মূল অভিযান৷ মংলা বন্দর পার হয়ে গানবোটগুলো আরও ভেতরে খুলনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ একসময় গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ড ছেড়ে পৌঁছায় রূপসা ফেরিঘাটের কাছে৷ তখন দুপুর ১২টার কাছাকাছি৷ ঠিক এমনি সময় আকাশের অনেক উঁচুতে দেখা গেল তিনটি জঙ্গি বিমান৷ পাকিস্তানিদের বিমান অনুমান করে 'পদ্মা' ও 'পলাশ' থেকে চাওয়া হলো বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে গুলি ছোড়ার অনুমতি৷ কিন্তু মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টের মনেন্দ্রনাথ সামন্ত জানালেন, বিমানগুলো ভারতীয়৷ ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের এয়ারফিল্ড থেকে এসেছে এগুলো৷ সুতরাং উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো কারণ নেই৷ শুনে সবাই আক্রমণের প্রস্তুতি থেকে বিরত থাকল৷ কারণ ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানানো হয়েছিল এই এলাকায় যাতে কোনো ভাবেই বোম্বিং না করা হয়৷ আর তাছাড়া গানবোটগুলোর উপরিভাগ হলুদ রঙেও রাঙানো হয়েছিল৷ এবং মিত্রবাহিনীকে জানানো হয়েছিল হলুদ রং করা গানবোটগুলো আমাদের, অর্থাৎ এই গানবোটগুলোতে আক্রমণ করা যাবে না৷ কিন্তু হঠাৎ শুরু হলো পটপরিবর্তন৷ ভারতীয় বিমানবাহিনীর অতি উৎসাহী কয়েকজন বিমান সেনার খামখেয়ালির কারণে সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দিতে হয়েছিল বিপুল খেসারত৷ এক প্রকার অবাক করে দিয়ে বিমানগুলো নিচে নেমে এল৷ দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়ে গেল খুব নিচু দিয়ে৷ তারপর পাক দিয়ে এসেই হঠাৎ বোমা ফেলল৷ একটা বোমা গিয়ে পড়ল পদ্মার ইঞ্জিনরুমে৷ ইঞ্জিনরুম হলো একেবারে বিধ্বস্ত৷ স্প্লিন্টারের আঘাতে হতাহত হলো বহু নাবিক৷ পুরোপুরি অচল হয়ে গেল পদ্মা৷ আবারও ফিরে এল বিমানগুলো৷ এবারের বোমাগুলো থেকে কোনোরকমে রক্ষা পেল 'পলাশ' ও 'পানভেল'৷ কিন্তু সকলে ভয় পেয়ে গেল৷ কে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷ ঠিক তখন পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী সকলকে জাহাজ ত্যাগ করার জন্য আদেশ দেন৷ এমন আদেশ শুনে বেশ ক্ষুব্ধ হলেন রুহুল আমিন৷ যুদ্ধ না করে তিনি ভীরুর মতো জাহাজ ছেড়ে যাবেন না৷ তিনি সকলকে আহবান করলেন জাহাজ ত্যাগ না করার জন্য৷ তিনি হানাদার বাহিনীর বিমানগুলোতে গুলি চালাতে অনুরোধ জানালেন ক্রুদের৷ নিজে চলে গেলেন ইঞ্জিনরুমে দায়িত্ব পালন করার জন্য৷ যে করেই হোক বিমান হামলা থেকে গানবোটকে বাঁচাতে হবে৷ কিন্তু কেউই অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে ঝুঁকি নিতে রাজি হলো না৷ আর তাই বিমানগুলোকেও আর চ্যালেঞ্জ করে আক্রমণ করা হলো না৷ এবার বিমানগুলো পেছন দিক থেকে উড়ে এল৷ কোনোরকম বাধা ছাড়াই চালাল বোমাবর্ষণ৷ একটা বোমা এসে পড়ল পলাশের ওপর৷ ধ্বংস হলো পলাশের ইঞ্জিনরুম৷ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলো না৷ বরং জাহাজে রাখা গোলাবারুদ ফুটতে শুরু করল৷তিনি পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে নদীর কূলে সাঁতার কেটে উঠতে গিয়ে পাকিস্তানী সৈনদের হাতে ধরা পড়েন এবং পাকিস্তানী সৈনরা রুহুল আমিনকে বেনটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন৷ এই অসম সাহসী বীরের শবদেহ সমাহিত করা হয় খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর তীরে৷ তাঁর কবরটি আজও তাঁর বীরত্বের শক্তি ও শোককে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরে৷ ছবি:- খুলনা জেলার রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরের এই কবরে মহান এই বীর চিরশায়িত আছেন৷ সংক্ষিপ্ত জীবনী নাম: রুহুল আমিন জন্ম : জুন, ১৯৩৪ সাল। জন্মস্থান : নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বর্তমানে সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাদুরা গ্রামে৷ পিতা : মোঃ আজহার পাটোয়ারী৷ মা : মোছাঃ জুলেখা খাতুন৷ কর্মস্থল : নৌবাহিনী৷ পদবী : স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার৷ মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১০নং সেক্টর৷ মৃত্যু : ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল৷ সমাধিস্থল : রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরে৷ ছবি ও তথ্য সূত্র:- মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর,ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র। বিশেষ কৃতজ্ঞতা: গবেষক এহসান হাবীবকে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.