আজ ০৫ সেপ্টেম্বর।
বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের ৪২তম শহীদ দিবস।
একাত্তরের আজকের দিনে যশোরের ঝিকরগাছা থানার গোয়ালহাটি গ্রামে সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরিয়ে নেবার জন্য কাভারিং ফায়ার দিতে গিয়ে পাকি হানাদারদের বেয়নেটের আঘাতে নিমর্মভাবে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ।
কতটা বেশি দেশপ্রেম থাকলে নিশ্চিত ভয়ংকর মৃত্যুকে একজন মানুষ বরণ করে নেয়, তার উদাহরণ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ।
নূর মোহাম্মদ জানতেন তাঁর কি পরিণতি হবে।
তারপরও দেশের জন্য, সহযোদ্ধাদের জন্য নিজেকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
এই লেখাটি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সৃত্মির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর একাত্তরের দিনগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
==============================================================================
১৯৭০ সালের জুলাই মাসে ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ বদলি হয়ে যশোর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে আসেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্টেই ছিলেন নূর মোহাম্মদ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলায় পাকি হানাদারদের বাঙালী গণহত্যার খবর শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না।
মার্চের শেষদিকেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
পরবর্তীতে আট নং সেক্টরে কোম্পানী প্রধান হিসেবে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেন।
সেপ্টেম্বর মাস।
বিজয়ের লক্ষণ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
যশোরের শার্শা উপজেলার ঝিকরগাছা থানার গোয়ালহাটি গ্রাম মুক্তিবাহিনীর দখলে।
পাশেই ছুটিপুর গ্রামে হানাদারদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পটি দখল করলে শার্শা হানাদার মুক্ত হবে।
০৫ সেপ্টেম্বর।
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ সহ পাঁচ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোয়ালহাটি-ছুটিপুর গ্রামের সীমান্তে পাকি হানাদারদের ক্যাম্পের দিকে নজর রাখছিলেন, পাকিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
তখন বিকেল হয়ে গেছে।
কিভাবে যেন হানাদাররা নূর মোহাম্মদদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। আচমকা টহলরত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে পাকিরা আক্রমন করে।
শুরু হয় সন্মুখ যুদ্ধ।
পাকিদের ভারী আক্রমনের ধরন দেখে কিছুক্ষণের মাঝেই নূর মোহাম্মদ পাকিদের ভয়ংকর পরিকল্পনা বুঝে ফেলেন।
পাকিদের পরিকল্পনা ছিল সারপ্রাইজ এ্যাটাকের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারকৃত অঞ্চলগুলো দখল করা।
কোম্পানী অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ তাঁর চার সহযোদ্ধাদের নিয়ে বারবার স্থান পরিবর্তন করে গুলি করছিলেন। ফলে, পাকিরা মনে করে, মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় অনেক।
দু:সাহসী এই পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা এভাবে ফায়ারিং চালিয়ে যান ঘন্টাখানেক। হঠাৎ, মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মিয়া পাকিদের গুলিতে আহত হন। আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচাতে ছুটে আসার সময় হানাদারদের মর্টার শেলের আঘাতে মারাত্মক আহত হন কোম্পানী অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ।
নান্নু মিয়া আর নূর মোহাম্মদকে বাঁচাতে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা। বাকি দুই মুক্তিযোদ্ধা শ'খানেক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ছিলেন। কিন্তু এত বড় হানাদার বাহিনীর সামনে পেরে উঠছিল না ওঁরা।
কোম্পানী অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ বুঝতে পারলেন, এভাবে আর বেশিক্ষন পাকিদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন নূর মোহাম্মদ।
সহযোদ্ধাদের বললেন, নান্নুর আঘাতটা সেরে উঠবে। তোমরা নান্নুকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাও। আমি তোমাদের জন্য কাভারিং ফায়ার করবো।
সহযোদ্ধারা তাঁদের অধিনায়ককে ছেড়ে যেতে চাইলেন না।
নূর মোহাম্মদ মুখটা শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বললেন, আমার যখমটা এমনিতেই মারাত্মক।
তোমরা নান্নু আর আমাকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারবে না। সেই পরিস্থিতি নেই। তোমরা নান্নুকে নিয়ে দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে যাও। ব্যাকআপ নিয়ে দ্রুত ফিরে এসো। আমি হানাদারদের ঠেকিয়ে রাখছি।
সহযোদ্ধারা জানতেন, অধিনায়কের কথা শোনা ছাড়া তাঁদের আর কিছু করার নেই। নূর মোহাম্মদ ব্যাকআপ নিয়ে ফিরে আসার যে কথাটি বলেছেন, তা শুধুই স্বান্তনা। আসলে, নূর মোহাম্মদ নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন।
অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ রেখে সহযোদ্ধারা আহত মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মিয়াকে নিয়ে চলে যান।
নূর মোহাম্মদ শুরু করেন কাভার ফায়ারিং।
সর্বশক্তি দিয়ে মারাত্মক আহত শরীরটি নিয়ে বারবার স্থান পরিবর্তন করতে থাকেন।
স্থান পরিবর্তন করে গুলি চালানোর কারণে শ্লথ হয়ে যায় হানাদারদের গতি আর এদিকে দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে চলে যান মুক্তিযোদ্ধারা।
এক সময় নূর মোহাম্মদের বুলেট শেষ হয়ে যায়...নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে নিজেকে সপে দিলেন।
পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে শহীদ নূর মোহাম্মদের নিথর দেহটি পাশের ঝোপের আড়ালে পড়ে থাকতে দেখে। তাঁর সারা শরীর জুড়ে ছিল পাকি হানাদারদের পৈশাচিক নির্যাতনের চিহ্ন।
তাঁর সারা শরীর জুড়ে ছিল বেয়নেটের আঘাত, চোখ দু'টো বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
সেদিন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন চার সহযোদ্ধার জীবন, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।
নিজের বুকের তাজা খুনে রাঙিয়ে উজ্জ্বল করেদিলেন স্বাধীনতার পথ।
দেশকে কত বেশি ভালোবাসা যায়, দেশের জন্য কতটুকু আত্মত্যাগ করা যায়, তার উদাহরণ হয়ে অমর হয়ে আছেন নূর মোহাম্মদ।
নূর মোহাম্মদরা আমাদের কাছে দেশপ্রেমের দিশারী।
বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী অধিনায়ক ল্যান্স কর্পোরাল নূর মোহাম্মদ শেখকে দেশের জন্য অসামন্য আত্মত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ স্বরূপ "বীরশ্রেষ্ঠ" উপাধিতে ভূষিত করে।
বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
...বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখকে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি...
==============================================================================
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।