যেতে হবে অনেক দূর..
সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে জানালার ধারে দাঁড়াতেই হঠাৎ মোতালেব সাহেবের কথা মনে পড়ল নীলুর । মাস দুয়েক আগের ঘটনা, ওর একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল, ছেলে বুয়েট পাশ এঞ্জিনীয়ার, নাম মোতালেব হোসেন,ভাল চাকরী করে, নিজেই বললেন উনি খুব সৎ; আবার দেশের দুরবস্থা নিয়েও চিন্তা করেন। নীলুকে দেখে জানালেন পছন্দ হয়েছে, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী নীলু বা তার পরিবারও তাকে অপছন্দ করেনি। কিন্তু মোতালেব সাহেব কিছু ব্যাক্তিগত আর পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে আরও ছয় মাস পরে বিয়ে করবেন বলে জানান, এসময় তিনি নীলুর সাথে ফোনালাপ করতে চাইলেন।
পারিবারিক বৃত্তান্ত আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে ফোনালাপ শুরু হল ।
নীলুর বৃত্তান্ত শুনে উনি বললেন আপানারতো সবই ভাল কিন্তু আপনার বড় বোন ডিভোর্সড, নীলু চুপচাপ শুনল। উনি ডিভোর্সের কারন জানতে চাইলে ও বলল যৌতুকের জন্য শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন তবে উনার মতে নীলুর বড় বোনের নাকি ধৈর্য্য কম আর পারিবারিক কারনে ছোট বোনের ক্ষেত্রেও সেটা কম হতেপারে। ও হেসে বলল হুমম, তাহলেতো আমার পরিণতি আপার চেয়েও খারাপ হবে কারন আমার ধৈর্য্য আসলেই কম, অন্যায় আর বাজে কথা একেবারেই সহ্য হয়না আমার তবে আপার স্বভাব আমার উল্টা, সে কোনও কিছুতেই প্রতিবাদ করতে পারেনা, নিজের মতামত দেয়না। মোতালেব সাহেব বললেন না না তা হবে কেন; সে যাই হোক আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ও আচ্ছা, ধন্যবাদ। তবে আমার কিছু শর্ত আছে, নীলু জানতে চাইল কি শর্ত? উনি বললেন,
১। আমার স্ত্রী জব করতে পারবেনা
২। “নারী স্বাধীনতা” শব্দটা আমি ঘৃণা করি
৩। আমার স্ত্রীর ব্যাক্তি স্বাধীনতা থাকবেনা তবে ভয়ের কিছু নেই, তার জন্য আমি সবসময় সবচেয়ে ভালটাই চাব, তাই তার সব সিদ্ধান্ত আমি নেব।
৪। আমার ছোট ভাই বোনেরা যতদিন স্বাবলম্বী নাহয় তাদেরকে আমার দেখতে হবে, আমার বৌয়ের ভাত কাপড়ের অভাব হলেও ভালবাসার অভাব হবেনা কোনওদিন।
৫। বাঙ্গালী মেয়েদের আল্লাহর পরে স্বামীই সব, আমার মাকে দেখেছি কখনও বাবার ওপরে কথা বলেনি, তারা জীবনে অসুখী ছিলেননা। আমি চাই আমার স্ত্রীও আমাকে সেভাবেই ভালবাসুক।
৬। আমার স্ত্রীকে আধুনিকমনা না হলে কিন্তু চলবেনা। চাকরি আর যুগের খাতিরে নারী বা পুরুষ অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক থাকতে পারে, সব স্মার্টলি মেনে নিতে হবে।
নীলু বলল হুমম, আপনার পরিকল্পনা বেশ পরিষ্কার, ভাবতে সুবিধা হবে। তারপর ওর বর্তমান পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন, ওর বর্তমান-ভবিষ্যতের রূপরেখা টানতে লাগলেন উনি, এভাবে কথা আগাতে থাকল আর ও তলিয়ে গেল এতগুলো শর্তনিয়ে মোতালেব সাহেবের সাথে ওর দাম্পত্য জীবনের যোগ, বিয়োগ, আর কাটাকাটির ভাবনায় ।
নীলু ভাবছে মোতালেব সাহেব কত অকপট! নইলে “নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে উচ্ছন্নে নিয়েগিয়ে সমাজের বারোটা বাজানো হচ্ছে তাই নারী স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই” এ জাতীয় মনোভাবের বেশীরভাগ পুরুষেরা যখন নারী বিদ্বেষী বা নারী নির্যাতনকারী বিশেষণে আখ্যায়িত হওয়ার ভয়ে মুখে নারী স্বাধীনতা বিরোধী কোনও কথা না বলে প্রকৃত মনোভাব গোপন করে বিয়ের পর সচেতন বা অচেতনভাবে নারী নির্যাতন করেযাচ্ছে তখন উনি মন খোলাভাবে নিজের মতামত জানিয়ে দিলেন! ভালইতো, ভন্ডামী নেই। তাছাড়া মেয়েরা শুধু নারী স্বাধীনতা বলে চেঁচিয়েই যায়, প্রকৃত স্বাধীনতা কজন পায়? প্রেম অথবা পারিবারিক যেভাবেই বিয়ে করুক কোনও নারীই সে অর্থে স্বাধীন না, ব্যাতিক্রমে কেউ যদি ভাগ্যগুনে সংবেদনশীল ও সচেতন জীবনসংগী পান।
এই সংবেদনশীল ও সচেতন জীবনসংগী পাওয়ার আশা করাও ভীষণ কঠিন কারন কোনো পুরুষ নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হলেও যদি স্ত্রৈন বা মেরুদন্ডহীন বলে আখ্যায়িত হন এই ভয়ে সচেতনতাটা আর আয়ত্ত করতে পারেনা। সে খাতিরে মোতালেব সাহেবের ২ ও ৩নং শর্ত মেনে নেওয়াই যায়।
৪নং শর্তে নীলুর কোনো সমস্যা নেই; স্ত্রী পেয়ে মা, বাবা, ভাই, বোনকে ভুলে যাওয়াটা ভালোনা।
দুপক্ষকে ম্যানেজ করাটা কঠিন, তাইবলে কাউকেই অবহেলা করা যাবেনা, আবার এ দায়িত্ব স্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াটাও ঠিক না।
৫নং শর্তে নীলুর মনেহল উনার বদ্ধমূল ধারনা মেয়েরা কথা বললেই অনর্থ হবে তাই যেকোনো উপায়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখতে হবে, এধরনের মানসিকতাও এযুগে এমন শিক্ষিতমানুষের মধ্যে থাকতে পারে! হয়ত নিকটাত্মিয়ের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা দেখারপর এমন ধারনা হয়েছে তার,ও জিজ্ঞেস করেছিল এমন অনর্থ ঘটানো কোনো দজ্জাল মেয়ে আছে নাকি তার পরিবারে , উনি বললেন না নেই, কোনো বান্ধবী? নাহ্। তাহলে এত নারীবিদ্বেষ!
আরেকটা ব্যাপার, ভালবাসতে হবে তাই ভালবাসবো নাকি ভালবাসাটা তৈরী হওয়ার বিষয়, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোতালেব সাহেব কোনও সদুত্তর দিলেননা। নীলু জিজ্ঞেস করল আপনি অল্প বয়সী কোন মেয়েকে কেন বিয়ে করছেন না? উনি বললেন আমার মাস্টার্স পাশ মেয়ে লাগবে, পড়াশুনার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই, ও বলল কিন্তু মাস্টার্স পাশ মেয়েরাতো কিছু জিনিস নিজেরা বুঝতে চাইবে, বলতে চাইবে, সবকিছু আপনি বুঝিয়ে দেয়ার অপেক্ষা করবেনা। উনি কিছু বললেন না।
ও ভাবলো দেখাযাক কি হয়।
৬নং শর্তে নীলু পুরোপুরি হোঁচট খেল, অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক স্মার্টলি মেনে নেওয়া আবার বাঙ্গালী মেয়েদের কাছে আল্লাহ্র পরে স্বামীই সব দুটো সম্পুর্ন বিপরীতধর্মী কথা, মোতালেব সাহেব বললেন অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক মানে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে দেখলে যেন ভুল না বুঝেন, ও বলল আমি প্রাপ্তবয়স্ক চাকরিজীবি একজন মেয়ে এ ব্যাপারটা ধরতে পারবনা বলে মনেহল আপনার? হয়ত উনার চারপাশের মানুষ উনাকে বেশিরভাগ সময়ই ভুল বুঝে, একই ভুল যেন নীলুও না করে সে সতর্কতাবশতই হয়ত একথা বলেছেন।
কিন্তু নীলু ভাবছে, উনি বলেছেন আপার ধৈর্য্য কম, তারমানে কি আপার উচিৎ ছিল ধৈর্য্য ধরে মারধর সহ্য করা? যদিও আপা ডিভোর্স চায়নি। আমার ক্ষেত্রেওকি এমন হতেপারে? আর সে ক্ষেত্রে মারধর করাটা খুব স্বাভাবিকভাবেই নেবেন মোতালেব সাহেব? কিন্তু তা সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করাটা অন্যায় বা বোকামী বলে মনেকরবেন?
আবার চাকরি করা উনার পছন্দ না, আমি চাকরিজীবি জেনেশুনেও কেন উনি বললেন আমাকে উনার ভালো লেগেছে? তবেকি উনি চাচ্ছেন আমি চাকরি ছেড়ে উনাকে বিয়ে করি?
আমাদের সমাজে অবশ্য অনেকেই চাননা স্ত্রী চাকরি করুক; পরপুরুষের কুনজর, সন্তান ঠিকমত মানুষ হবেনা, পরকীয়ার সম্ভাবনা, প্রভৃতি নানা সমস্যা তুলে ধরার পেছনে মূল কারন যাইহোক, মোটাদাগে চাকরি করতে না দেয়াটা খুব একটা খারাপ বলে মনেকরেনা নীলু। সে চাকরি করে এটুকু বুঝেছে যে স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া চাকরি করলে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দেয়া সম্ভব হবেনা।
তাই সন্তানের খাতিরে চাকরি ছাড়তে রাজি নীলু কিন্তু অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে অন্য অনেক দিক থেকে নির্ভরশীল হয়ে স্বামীর সংসারে সে মর্যাদার কথা নাহয় বাদই থাকল কতটা মানবিক আচরণ পাবে তা কি ধারনা করা সম্ভব যখন আমাদের শিক্ষিত সমাজই এখনও খোলামেলা যৌতুক চাইতে লজ্জাবোধ করেনা অথবা বাপের বাড়ী নিয়ে খোঁটা দিয়ে কাউকে মানসিকভাবে আহত করাটা যে অন্যায় সে বোধ যে সমাজের নেই অথবা বিয়ের ৭ দিনের মাথায় তোমার চেয়ে সুন্দর মেয়েকে ছেলের বউ করাতে পারতাম, মেয়ের বাবার অবস্থা ভালো না হওয়ায় করাইনি জাতীয় কথা বলা বা সমর্থন করায় অপরাধবোধ নেই যে সমাজের?
এতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে কি ওর এ বিয়েতে রাজি হওয়া উচিৎ ? নীতুর বয়স কম হলনা, দুতিন বছর পর হয়ত তার বিয়ের সম্বন্ধ আসবে কালে ভদ্রে, ইতোমধ্যেই পাড়াপড়শীর কথার চাপে ওর বাবার ঘুম হারাম হয়েছে, ও ভাবে এ জন্যেই কি ওর তাড়াহুড়ো করা উচিৎ? ওর কি ছাড় দেয়ার মানসিকতা নেই নাকি এ বিষয়গুলো ছাড় দেয়ার মত না? নাকি ওর পারিবারিক ১টা দুর্ঘটনা আছে জেনেই এত শর্ত চাপিয়ে দেয় ছেলেপক্ষ? মোতালেব সাহেবের মনের মত হয়ে চাকরি ছেড়ে, বোবা হয়ে , পতি সেবায় মন ডুবিয়ে সে কি জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাবে? স্বামীর মন আসলেই তৃপ্ত হবে তার কি নিশ্চয়তা? যে ব্যাক্তি পারস্পরিক সমঝোতার পরিবর্তে মারধর খেয়ে সংসার করার কথা ভাবে তাকে তৃপ্ত করাটা কতখানি কঠিন হবে নীলু ভাবতে পারছেনা, তাই সে মোতালেব সাহেব কে ফিরিয়ে দিল।
পরিচিত মহল মাঝে মাঝেই ওকে বলে ও সব সম্বন্ধ সবকিছু না ভেবেই না করে দেয়; নীলু এটা মানতে চায়না, তবু মনে মনে ভাবে ও কি আসলেই ভুল করল? আজ হঠাৎ করেই যেন নিজের ভেতর থেকে সাড়া পেল, না সে ভুল করেনি, কিন্তু এ বিষয় গুলি কি আসলেই ছাড় দেয়া যেত? এভাবে কি জীবনে সুখী হওয়া যায়? আর সবাই কি ভাবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।